বেদান্ত দর্শন (Vedanta Philosophy) | বেদান্তের প্রধান তত্ত্ব | শিক্ষার পদ্ধতি | পাঠক্রম

বেদান্ত দর্শন (Vedanta Philosophy) | বেদান্তের প্রধান তত্ত্ব | শিক্ষার পদ্ধতি | পাঠক্রম

উত্তর:

বেদান্ত দর্শন (Vedanta Philosophy) :

বেদান্ত দর্শন হল আস্তিকবাদী দর্শন। ভারতীয় ছয়টি আস্তিক দর্শনের মধ্যে ভাববাদী মতে বেদান্ত দর্শনকে শ্রেষ্ঠ দর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কেননা ভাববাদের চূড়ান্ত রূপ এই বেদান্ত দর্শনের মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়।

বেদান্ত দর্শন
বেদান্ত দর্শন

ব্যুৎপত্তিগত অর্থে ‘বেদান্ত’ বলতে বোঝায় বেদের অন্ত বা শেষ। বৈদিক সংস্কৃতির ধারক হিসেবে হিন্দুদের কাছে বেদ সকল জ্ঞানের আকর বলে বিবেচিত। বলা হয়ে থাকে, প্রাচীন মুনি-ঋষিরা তাঁদের উপলব্ধ সত্যকে যে সাহিত্য-ভাণ্ডারে সঞ্চিত করে রেখেছেন, তাই হল বেদ। বেদই আস্তিক ষড়দর্শনের ভিত্তি ও উৎস। বেদের চারটি অংশ — মন্ত্র বা সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং উপনিষদ। সুতরাং বেদের অন্ত অর্থাৎ উপনিষদকেই বেদান্ত নামে অভিহিত করা হয়। অর্থাৎ, উপনিষদ তত্ত্বের দার্শনিক ব্যাখ্যা ও সমর্থনই হল বেদান্ত দর্শন। 

বেদান্ত কী ?

বেদ নামক গ্রন্থরাশি প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত—কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড। বেদের কর্মকাণ্ডে প্রধানত বেদবিহিত যাগযজ্ঞ এবং চতুরাশ্রমের কর্তব্যের নির্দেশ আছে। অন্যদিকে বেদের জ্ঞানকাণ্ড বেদের আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক আলোচনায় সমৃদ্ধ অংশ। এরই নাম বেদান্ত অর্থাৎ বেদের অন্ত বা শেষ ভাগ যা বেদের চরম লক্ষ্য। বেদের সারাৎসার হল বেদান্ত বা উপনিষদ। সকল পণ্ডিত-দার্শনিকরা মনে করেন, ভারতীয় দার্শনিক চিন্তাধারার ও আধ্যাত্মিক অনুভূতির সর্বশ্রেষ্ঠ বিকাশ ঘটেছে বেদান্তে বা উপনিষদে ।

উপনিষদ সংখ্যায় বহু এবং বিভিন্ন শাখাবিশিষ্ট। উপনিষদসমূহের মধ্যে মূলগত ঐক্য থাকা সত্ত্বেও ব্রহ্ম সংক্রান্ত আলোচনা অনেক স্থানে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় আছে। আবার, বিভিন্ন উপনিষদের সিদ্ধান্তের মধ্যেও কিছু কিছু দুরূহতা পরিলক্ষিত হয়। মহর্ষি বাদরায়ণ উপনিষদের মূল সূত্রটিকে অবলম্বন করে ‘ব্রহ্মসূত্র’ প্রণয়ন করেন। বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্র রচনার উদ্দেশ্য ছিল—উপনিষদগুলির বিভিন্ন মত ও চিন্তাধারার সমন্বয় ঘটিয়ে সেগুলিকে একটি সুসংহত ও সুবিন্যস্ত রূপ প্রদান করা এবং বেদের সিদ্ধান্তগুলিকে সর্বজনগ্রাহ্য করে তোলা।

মূলমন্ত্র : “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম” অর্থাৎ “সর্ব বিশ্ব-জগৎ ব্রহ্মময়” অথবা এটাও বলা যায় যে “একমাত্র ব্রহ্মই হলেন পরমতত্ত্ব”। 

বেদান্তের প্রধান তত্ত্ব :

ব্রহ্মজিজ্ঞাসাই বেদান্তের প্রধান বিষয়, যার আলোকে বেদান্তের সর্বতত্ত্ব আলোকিত। বেদান্তের প্রধান তত্ত্বগুলি নিম্নরূপ —

• ব্রহ্ম পরম সত্য, অদ্বিতীয়, সৎ-চিৎ-আনন্দস্বরূপ। ব্রহ্ম নামরূপহীন, নির্গুণ, নির্বিশেষ, সর্বপ্রকার ভেদরহিত। ব্রহ্ম অনাদি, অনন্ত, অব্যয়, অপরিণামী এবং দেশ-কাল-কারণের অতীত। এক ও অনন্ত ব্রহ্ম স্বীয় অনির্বচনীয় মায়াশক্তির দ্বারা জগৎ ও জীবরূপে প্রকাশমান হন। ব্রহ্ম যখন মায়াবিশিষ্ট হন, তখন তিনি ঈশ্বর। 

• যে জগৎ সত্য বলে প্রতিভাত হয়, সেই জগৎ প্রকৃতপক্ষে মরীচিকায় দৃষ্ট জলের ন্যায় ভ্রমাত্মক। সদা পরিবর্তনশীল এই জগৎকে আমরা দেশ, কাল ও কারণত্বের সীমার মধ্যে প্রত্যক্ষ করি। জীবের দেহধারণের মুহূর্ত থেকেই ‘অনাদি অনন্ত দেশে’র খণ্ডিত রূপ হিসেবে দেশের ধারণা হয়। আবার, চিন্তায় প্রবৃত্ত হবার মুহূর্ত থেকে জাগতিক ঘটনাবলির সাক্ষী হিসেবে ‘অনাদি-অনন্ত কাল’কে খণ্ড খণ্ড রূপে প্রত্যক্ষ করা হয়। আর দেশ ও কালের সীমাবদ্ধতায় কারণত্বের সূচনা হয়। সুষুপ্তি বা সমাধি অবস্থায় এই দৃশ্যমান জগৎ আমাদের চেতনা থেকে অন্তর্হিত হয়, আবার জাগ্রত অবস্থায় আমাদের চেতনায় জগৎ পুনর্বার আবির্ভূত হয়। অতএব এই জগতের অস্তিত্ব আমাদের মনে।

• বাস্তব অভিজ্ঞতায় জীব-সত্তা বলে যা জানা হয়, সেই জীবসত্তার অন্তর্নিহিত আত্মার অস্তিত্ব অবশ্য স্বীকার্য। এটি জীবাত্মা— যা সকল অভিজ্ঞতার মূল সত্তা। এই জীবাত্মা অনন্ত, শাশ্বত, শুদ্ধ, স্বপ্রকাশ, নিত্যমুক্ত, আনন্দময় এবং পরমাত্মা তথা ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন। আত্মজ্ঞানের অভাবই অজ্ঞানতা, অজ্ঞানতাবশত জীব সংসারে অনেক দুঃখ ভোগ করে। কিন্তু আত্মার স্বরূপ উপলব্ধি করার সঙ্গে সঙ্গে অবিদ্যা বা অজ্ঞানতা দূরীভূত হয়। অতএব, অজ্ঞানতার অন্ধকারে জীবের বন্ধন বোধ, আর জ্ঞানের আলোতে জীবের মুক্তির বোধ। বন্ধন ও মুক্তি উভয়ই মানসিক বোধ। তাই স্বামী বিবেকানন্দ মনে করেন, নিজেকে দুর্বল ও বদ্ধ মনে করেই মানুষ দুর্বল ও বদ্ধ হয়ে যায়।

বেদান্ত মতাদর্শে শিক্ষার তাৎপর্য :

বেদান্ত মতে শিক্ষার মূল লক্ষ্য বিদ্যার্থীকে মোক্ষ বা মুক্তির পথ নির্দেশ। এই লক্ষ্য অর্জনের উপায় হল অবিদ্যা বা অজ্ঞানতার অপসারণ। অবিদ্যা বা অজ্ঞতার অপসারণে ব্রহ্মন ও জীবের একাত্মতার উপলব্ধি হয় এবং আত্মপলব্ধি ঘটে। জীব এবং ব্রহ্মের একাত্মতার উপলব্ধি বেদান্ত শিক্ষার সারকথা। অদ্বৈত বেদান্ত দুই ধরনের শিক্ষার কথা বলেছেন।

১) পরাবিদ্যা – পরাবিদ্যার সাহায্যেই পারমার্থিক সত্তাকে জানা যায়। পরাবিদ্যা হল ব্রহ্মবিদ্যা বা আধ্যাত্মিক জ্ঞান। অধ্যবসায় বা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের মাধ্যমে সত্য উপলব্ধি করা সম্ভব হয়।

২) অপরাবিদ্যা – অপরাবিদ্যা হল ব্যাবহারিক বা পার্থিব বিষয়ের জ্ঞান। এটি কর্মকেন্দ্রিক জ্ঞান। 

শিক্ষার পদ্ধতি (Method of Education) :

শিক্ষার পদ্ধতি সম্পর্কে শংকরাচার্য বিভিন্ন বিধির কথা বলেন। যেমন—শ্রবণ বিধি, মনন বিধি, নিদিধ্যাসন বিধি, প্রশ্ন-উত্তর বিধি, তর্ক বিধি, দৃষ্টান্ত বিধি, উপদেশ বিধি ইত্যাদি।

এইসব পদ্ধতি অবলম্বনের পরিশেষে বিদ্যার্থীর শিক্ষার উদ্দেশ্য পূরণ হবে। সে পরমজ্ঞান লাভ করবে এবং পরিপূর্ণ মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটবে।

শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন ব্রহ্মজ্ঞান লাভের তিনটি উপায়। ব্রহ্ম থেকেই শ্রুতির উৎপত্তি। শ্রুতি প্রদীপের মতো সর্বভাসক। শ্রুতি ছাড়া অন্য কোনো কিছু থেকেই জীব ও ব্রহ্মের ঐক্যজ্ঞান লব্ধ হতে পারে না। ‘তত্ত্বমসি’, ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ প্রভৃতি শ্ৰুতি ছাড়া অন্য কোনো প্রমাণেই জানা যায় না। শ্রুতি স্বতঃপ্রমাণ। শ্রুতি প্রামাণ্য, কিন্তু শংকর বিচারবুদ্ধিকে উপেক্ষা করেননি। শ্রুতিলব্ধ জ্ঞানের যৌক্তিকতা উপলব্ধি করার জন্য যুক্তি তর্কের প্রয়োজন আছে। কিন্তু শ্রুতির কথায় বিশ্বাস না থাকলে নিছক যুক্তিতর্কের দ্বারা আত্মোপলব্ধি সম্ভব নয়। যে তর্ক শ্রুতির অনুগামী, সেই তর্কই গ্রহণযোগ্য। সুতরাং বেদান্ত মতে, যুক্তি-তর্কের দ্বারা অত্মোপলব্ধি (Self-realization) শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য।

পাঠক্রম (Curriculum) :

অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে গুরুকুল আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত।

বেদ এবং উপনিষদ পাঠ পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত। তা ছাড়া ব্যাবহারিক কলাবিদ্যা পাঠের বিধানও দেওয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য আত্মজ্ঞান বা মোক্ষ যেহেতু শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য, সেহেতু বেদ-উপনিষদ পাঠ পাঠক্রমে মুখ্য স্থান অধিকার করেছে।

সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি (Co-curricular activities) :

অদ্বৈত বেদান্ত পাঠক্রমে নানান সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যথা—সৎসঙ্গ, তীর্থভ্রমণ, উপবাস পালন এবং যোগকে কারিকুলামে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষে, অঙ্ক, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিদ্যা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইত্যাদি এবং গার্হস্থ্য আশ্রমজীবন শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

উপসংহার :

আধুনিক কালে বেদান্ত শিক্ষা শুধু প্রাসঙ্গিকই নয়, ভোগসর্বস্ব জীবনের হাহাকার থেকে মানুষকে মুক্তির মন্ত্র শোনায় বেদান্তের ‘আত্মোপলব্ধি’র উদাত্ত বাণী।

আধুনিক শিক্ষা চিন্তায় বৈদান্তিক ধ্যানধারণার প্রভাব যে বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করে, তা হল—সমগ্র মানবসমাজের স্বার্থে এবং সকল মানুষের উন্নতিকল্পে মানুষকে একই সঙ্গে বিজ্ঞানমনস্ক ও আধ্যাত্মিক চেতনাসম্পন্ন হতে হবে। অন্যথায়, মানবজাতির অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে।

অদ্বৈত বেদান্তের এক ও অদ্বিতীয় ব্রহ্মের ধারণা তো প্রকৃতপক্ষে আত্মজ্ঞান। আত্মার স্বরূপ সম্বন্ধে জ্ঞাত হলে, মানুষে-মানুষে, জাতিতে-জাতিতে এবং ধর্মে-ধর্মে ভেদজ্ঞান থাকে না। সামাজিক ঐক্য ও সংহতির শিক্ষা আত্মজ্ঞানপ্রসূত।

একথা অনস্বীকার্য যে, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ও সমাজের চাহিদারও পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু বিচার করে দেখতে হবে যে, মনুষ্যসমাজের তথা সমষ্টির কল্যাণের সঙ্গে কোন্ চাহিদাগুলি সংগতিপূর্ণ।

যুগ মানসিকতাকে স্বীকার করার অর্থ হল—শুদ্ধচিন্তাকে শুভকার্যে প্রয়োগ করে সমস্ত মানুষকে জাগতিক দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্তির পথ দেখানো। এখানে বৈষয়িক উন্নতির সঙ্গে আধ্যাত্মিক উন্নতির কোনো বিরোধ থাকবে না। কারণ মানুষের ব্যাবহারিক জীবন ও পারমার্থিক জীবন—উভয়ই স্বীকার্য। বরং আধ্যাত্মিক চেতনা মানুষকে শেখাবে জাগতিক বিষয়ের সদ্বব্যবহার ও সুখদায়ক এবং অসুখদায়ক বস্তুর পার্থক্য।

স্বামী বিবেকানন্দ সঠিকভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন, বেদান্তের সারসত্তা কেবল তত্ত্বে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, পৃথিবীর ঘরে-ঘরে, প্রতিটি মানুষের চেতনায় ও শিক্ষায় পৌঁছে দিতে হবে বেদান্ত বা উপনিষদের শাশ্বত বাণী।

আরো পড়ুন

শিক্ষায় বৌদ্ধ দর্শনের প্রভাব কি | Significance of Buddhism in Education in Bengali

প্রয়ােগবাদ (Pragmatism) কি | প্রয়ােগবাদী দর্শনের মূলনীতি | শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োগবাদের প্রভাব

দর্শন কি | দর্শনের সংজ্ঞা দাও | দর্শনের স্বরূপ বা প্রকৃতি আলোচনা করো

যোগ দর্শন (Yoga Philosophy) | Indian Philosophy (ভারতীয় দর্শন)

সাংখ্য দর্শন (Sankhya Philosophy) | Indian Philosophy (ভারতীয় দর্শন)

ন্যায় দর্শন কি | শিক্ষায় ন্যায় দর্শনের প্রভাব কি | What is Nyaya Philosophy in Bengali

Leave a Comment

error: Content is protected !!