যোগ দর্শন (Yoga Philosophy) | Indian Philosophy (ভারতীয় দর্শন)

যোগ দর্শন (Yoga Philosophy) | Indian Philosophy (ভারতীয় দর্শন)

উত্তর:

ভারতীয় দর্শন

ভারতীয় দর্শনের মূলত দুটি দিক- বৈদিক এবং অবৈদিক। বৈদিক দর্শনের মধ্যে রয়েছে সাংখ্য, যােগ, ন্যায়, বৈশেষিক, পূর্ব মীমাংসা ও বেদান্ত। আবার অবৈদিক দর্শনের মধ্যে রয়েছে চার্বাক দর্শন, জৈন দর্শন ও বৌদ্ধ দর্শন। ভারতীয় দর্শনের উৎস হল বেদ। কেউ বেদকে স্বীকার করে, আবার কেউ স্বীকার করে না। যারা বেদকে স্বীকার করে তারা হলেন আস্তিক সম্প্রদায়। আর যারা বেদকে স্বীকার করেন না তারা হলেন নাস্তিক সম্প্রদায়।

যােগ দর্শন 

সাংখ্য দর্শনের ব্যবহারিক দিক হল যােগ দর্শন। ভারতীয় আধ্যাত্মদর্শনে অন্যতম প্রভাবশালী দর্শন হল যােগ দর্শন। মহর্ষি পতঞ্জলি এই দর্শনের সূত্রকার। পতঞ্জলির নাম অনুসারে এই দর্শনকে পাতঞ্জল দর্শনও বলা হয়। যােগ মানে ব্যায়াম নয়। শরীর, মন ও আত্মার ক্রম উন্নয়নের যে পদ্ধতি সমাধী স্তরে পৌঁছায় তাই যােগ (YOGA)। যােগ মানে আদির সঙ্গে প্রান্তের যােগ, বৃহতের সঙ্গে ক্ষুদ্রের যােগ, জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার যােগ, সৃষ্টির সঙ্গে স্রষ্টার যােগ। দার্শনিক তত্ত্বের দিক থেকে সাংখ্য ও যােগ দর্শনের মধ্যে প্রভেদ খুব সামান্য। তাই এদের পরস্পর সমানতন্ত্র দর্শন বলা হয়। মহর্ষি কপিলের সাংখ্য দর্শনে, পঁচিশটি তত্বে কোন ঈশ্বরকে স্বীকার করা হয়নি। পঁচিশটি তত্ব হল –

1) পুরুষ
2) প্রকৃতি
3) বুদ্ধি
4) অহংকার
5) মন
6) পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, জিহ্বা, নাসিকা ও ত্বক )
7) পঞ্চতন্মাত্র (রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দ)।
8) পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় (হস্ত, পদ, পায়ু, উপস্থ ও বাক)।
9) পঞ্চমহাভূত (ক্ষিতি বা পৃথিবী, অপ বা জল, তেজস বা আগুন, মরুৎ বা বায়ু ও ব্যোম বা আকাশ )।

পতঞ্জলির যােগ দর্শনে সাংখ্যের পঁচিশটি তত্বের সাথে অতিরিক্ত একটি তত্ব যুক্ত হয়েছে। ঈশ্বরতত্ব যুক্ত করে ঈশ্বর স্বীকৃত হয়েছে বলে নিরীশ্বর-সাংখ্যের বিপরীতে যােগ দর্শনকে ‘সেম্বর-সাংখ্য’ বলা হয়ে থাকে। 

প্রাচীন উপনিষদ, পুরাণ ইত্যাদিতে যােগ দর্শনের উল্লেখ দেখা যায়। এছাড়াও প্রাচীন সাহিত্য, শাস্ত্র, গ্রন্থ যথামহাভারত, গীতা ইত্যাদিতে এই দুই সম্প্রদায়কে এক বলেই বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন – শ্রীমদ্ভগবদগীতায় বলা হয়েছে-

‘সাংখ্যযােগৌ পৃথগ বালাঃ প্ৰবদন্তি ন পণ্ডিতাঃ। একমপ্যাস্থিতঃ সম্যগুভয়োর্বিন্দতে ফলম্ ।। – (শ্রীমদ্ভগবদগীতা : ৫/৪)

অর্থাৎ : অজ্ঞ ব্যক্তিগণ সাংখ্য ও যােগকে পরস্পরবিরুদ্ধ ও ভিন্ন-ফল-বিশিষ্ট বলে থাকেন, কিন্তু আত্মজ্ঞানীগণ তা বলেন না। কারণ উভয়ের ফল এক মােক্ষ। সেজন্য একটি সম্যক রূপে অনুষ্ঠিত হলে উভয়ের ফল মােক্ষ লাভ হয়। বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থে এই দুই দর্শনকে এক বলা হলেও, ভারতীয় দর্শনে এ দুটি পৃথক সম্প্রদায়। কেননা দুই সম্প্রদায়ের ভিত্তি এক হলেও এদের ব্যবহারিক প্রয়োগ ভিন্ন। তাই মােক্ষশাস্ত্রেও বলা হয়-

‘নাস্তি সাংখ্যসমং জ্ঞানং নাস্তি যােগসমং বলম্। অর্থাৎ : সাংখ্যতত্বের তুল্য জ্ঞান নেই, যােগের তুল্য বল বা শক্তি নেই।

সংস্কৃত “যােগ” শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে। সংস্কৃত ‘যুজ’ ধাতুর সঙ্গে ‘ঘঞ্জ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে ‘যােগ’

শব্দের উৎপত্তি হয়। যার অর্থ হল ‘নিয়ন্ত্রণ করা’, ‘যুক্ত করা’ বা ‘ঐক্যবদ্ধ করা’। তাই ব্যুৎপত্তিগতভাবে ‘যােগ’ শব্দটির অর্থ করা হয় জীবাত্মা ও পরমাত্মার সংযােগ।

* যে দর্শন তপঃ, স্বাধ্যায় ও ঈশ্বর-প্রণিধানরুপ ক্রিয়ার সাহায্যে আত্মসাক্ষাৎকারে বিশ্বাসী, তাকে যােগ বলা হয়।

অন্যদিকে যােগ দর্শনে বিবেকজ্ঞান লাভ ও কৈবল্য প্রাপ্তির জন্য অতিরিক্ত কিছু প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে। এই প্রক্রিয়াগুলিকে এককথায় ‘যােগ’ বলা হয়।

যােগশাস্ত্র মতে এই যােগ-ই তত্বজ্ঞান লাভ এবং দুঃখ-নিবৃত্তির প্রধান উপায়। যােগের দ্বারাই পুরুষ বা আত্মার স্ব-স্বরূপ উপলব্ধি করা যায়। এই মতে ঈশ্বর-প্রণিধান পুরুষের প্রত্যক্ষলব্ধ অভিজ্ঞতা। তাই সাংখ্য দর্শনকে তত্বমূলক দর্শন এবং যােগ দর্শনকে প্রয়োগমূলক দর্শন বলা হয়। 

* যােগ দর্শনের উপর বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এর মূল গ্রন্থ হল মহর্ষি পতঞ্জলির ‘যােগসূত্র’ বা ‘পাতঞ্জলসূত্র’।

মহর্ষি বেদব্যাস যােগসূত্রের উপর অনবদ্য ভাষ্যগ্রন্থ ‘যােগভাষ্য রচনা করেন। অনেকের মতে যােগভাষ্য, যােগশাস্ত্রের উপর রচিত প্রাচীনতম ভাষ্যগ্রন্থ। এটিকে ব্যাসভাষ্যও বলা হয়। এছাড়াও যােগশাস্ত্রের উপর রচিত অন্যান্য তাৎপর্যপূর্ণ গ্রন্থ রয়েছে।

‘যােগসূত্র’ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় সূত্রে মহর্ষি পতঞ্জলি যােগের বর্ননা দিয়েছেন-‘চিত্তবৃত্তি নিরােধ’। চিত্ত এখানে ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত। মন, বুদ্ধি ও অহংকার এই তিনটিকে বিক্ষিপ্ত হওয়া থেকে অর্থাৎ বিপথগামী হওয়া থেকে নিবৃত্ত করাই যােগ। যােগ দর্শনের প্রধান শাখাগুলি হল রাজযোগ, কর্মযােগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযােগ ও হঠযােগ। রাজযােগ বা অষ্টাঙ্গযােগ হল হিন্দু যােগদর্শনের একটি শাখা। এই শাখায় ধ্যানের মাধ্যমে মনঃসংযম এবং মনঃসংযমের মাধ্যমে শেষে মােক্ষ লাভের কথা বলা হয়। রাজযােগ প্রথম আলােচিত হয়েছে পতঞ্জলির যােগসূত্র গ্রন্থে। 

পুরুষ ও প্রকৃতি বিশ্বসৃষ্টির এই দুই সত্তাকে যােগ দর্শন স্বীকার করেছে। যােগ দর্শন বিশ্বাস করে যে মন ও দেহের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তাই এই দুয়ের সমন্বয় সাধনের জন্য যােগ দর্শন অষ্টাঙ্গিক মার্গের কথা বলেছেন। যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি এই আটটি যােগের অঙ্গ স্বরূপ। এর মধ্যে প্রথম পাঁচটি বহিরঙ্গ যােগ ও শেষ তিনটি অন্তরঙ্গ যােগ সাধন।

যম – অহিংসা, সত্য, অচৌর্য্য, ব্রহ্মচর্য্য ও অপরিগ্রহ এই গুলিকে যম বলে। 

নিয়ম – বাহ্য ও অন্তঃশৌচ, সন্তোষ, তপস্যা, স্বাধ্যায় ও ঈশ্বরােপাসনা। 

আসন – যে ভাবে অধিকক্ষণ স্থিরভাবে সুখে বসে থাকা যায় তার নাম আসন। 

প্রাণায়াম- এই আসনের পর স্বাস ও প্রশ্বাস উভয়ের গতি সংযত হয়ে যায়, একে প্রাণায়াম বলে। 

প্রত্যাহার- ইন্দ্রিয়গণ যখন বিষয় পরিত্যাগ পূৰ্ব্বক চিত্তের স্বরূপ গ্রহণ করে তখন তাকে প্রত্যাহার বলে। 

ধারণা- চিত্তকে কোন বিশেষস্থানে বদ্ধ করে রাখার নাম ধারণা। 

ধ্যান- সেই বস্তুবিষয়ক জ্ঞান নিরন্তর একভাবে প্রবাহিত হলে তাকে ধ্যান বলে।

সমাধি- ধ্যান যখন বাহ্যোপাধি পরিহার পূৰ্ব্বক কেবল মাত্র অর্থকেই প্রকাশ করে তখন তাকে সমাধি বলা যায়। 

সমাধি দুই প্রকার – i) সম্প্রজ্ঞাত

ii) অসম্পূজ্ঞাত। 

একাগ্রচিত্তের যােগের নাম সম্প্রজ্ঞাত। নিরুদ্ধচিত্তের যােগের নাম অসম্প্রজ্ঞাত।

যােগ শাস্ত্র

যােগশাস্ত্র মতে ‘আত্মার বন্ধন বিবেকজ্ঞান দ্বারা মুক্তি সম্ভব এবং যােগ সাধনার দ্বারা বিবেকজ্ঞান লাভ হয়। এ জন্য যােগ দর্শন যােগ সাধনা পদ্ধতির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করেছে। আত্মশুদ্ধির জন্য যােগ দর্শনের নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া খুবই সহায়ক। মহর্ষির যােগসূত্র বা পাতঞ্জলসূত্রে যােগ দর্শনের উপর মােট ১৯৪টি সূত্র রয়েছে। এই সূত্রগুলিকে কোন অধ্যায়ে বিভক্ত না করে চারটি পরিচ্ছদ বা পাদে বিভক্ত করা হয়েছে। এই চারটি পাদ হল – (১) সমাধিপাদ- সমাধিপাদে আছে ৫১টি সূত্র। (২) সাধনপাদ- সাধনপাদে আছে ৫৫টি সূত্র। (৩) বিভূতিপাদ – বিভূতিপাদে আছে ৫৪টি সূত্র। (৪) কৈবল্যপাদ – কৈবল্যপাদে আছে ৩৪টি সূত্র।

1) সমাধিপাদ – পাতঞ্জলসূত্রের সমাধিপাদে যােগের লক্ষণ বর্ণনা করা হয়েছে। এজন্য সমাধিপাদকে যােগপাদও বলা হয়। যােগের লক্ষণ, প্রকারভেদ, প্রকৃতি, উদ্দেশ্য, চিত্তভূমির প্রকারভেদ, প্রমাণের লক্ষণ ও প্রকারভেদ, ঈশ্বরের লক্ষণ, ঈশ্বরপ্রণিধানের ফল, চিত্তবৃত্তি নিরােধের উপায় প্রভৃতি এই পাদে আলােচিত হয়েছে। 

2) সাধনপাদ – সাধনপাদে প্রধানত ক্রিয়াযােগের কথা আলােচিত হয়েছে। যােগের জন্য যে সব ক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয় তাদের পরিচয়, আবশ্যিকতা ও ফল। এছাড়াও অবিদ্যার লক্ষণ, কর্মফল, দুঃখের হেতু এবং দুঃখ-নিবৃত্তির উপায় এই পাদে আলােচিত হয়েছে।

3) বিভূতিপাদ- বিভূতিপাদে প্রধাণত যােগলব্ধ অলৌকিক শক্তির বর্ণনা। এর সাথে ধারণার লক্ষণ, ধ্যানের লক্ষণ, সমাধির লক্ষণ, সংযম সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য এবং বিবেকজ্ঞান আলােচিত হয়েছে।

4) কৈবল্যপাদ – কৈবল্যপাদে রয়েছে মােক্ষের স্বরূপ, মােক্ষের প্রকারভেদ, পরলােক প্রভৃতি বিষয়ের আলােচনা।

যােগশাস্ত্র চারটি অঙ্গবিশিষ্ট – হেয়, হেয়হেতু, হান ও হানােপায়। হেয় হল সংসার, হেয়-হেতু হল সংসার বাংলা হেতু। এখানে হেতু বলতে প্রকৃতি ও পুরুষের সংযােগ বােঝায়। হান হল মােক্ষ বা কৈবল্য এবং হানােপায় হল মােক্ষের বা কৈবল্যের উপায়।

এ বিষয়ে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে

• ‘হেয়ং দুঃখমনাগত’- (যােগসূত্র : সাধনপাদ-১৬)

অর্থাৎ : সংসার দুঃখময় বলে তা পরিত্যাজ্য।

 • ‘দ্রষ্টদৃশ্যযােঃ সংযােগাে হেয়হেতুঃ- (যােগসূত্র : সাধনপাদ-১৭)

অর্থাৎ : পুরুষ ও প্রকৃতির সংযােগ হল হের-হেতু বা দুঃখের কারণ।

 • ‘তদভাবাৎ সংযাোগাভাবাে হানং তদ্দৃশেঃ কৈবল্য’- (যােগসূত্র : সাধনপাদ-২৫) 

অর্থাৎ : পুরুষ ও প্রকৃতির সংযােগাভাব হল হান বা কৈবল্য।

• ‘বিবেকখ্যাতিরবিপ্লবা হানােপায়ঃ- (যােগসূত্র : সাধনপাদ-২৬)

অর্থাৎ : পুরুষ ও প্রকৃতির ভেদজ্ঞান বা বিবেকখ্যাতি হল কৈবল্যলাভের উপায় বা হানােপায়।

আরো পড়ুন

ভাববাদ (Idealism) কি | ভাববাদ সম্পর্কে দার্শনিকদের মতামত | ভাববাদ ও শিক্ষার লক্ষ্য, পাঠক্রম, পদ্ধতি

প্রয়ােগবাদ (Pragmatism) কি | প্রয়ােগবাদী দর্শনের মূলনীতি | শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োগবাদের প্রভাব

দর্শন কি | দর্শনের সংজ্ঞা দাও | দর্শনের স্বরূপ বা প্রকৃতি আলোচনা করো

সাংখ্য দর্শন (Sankhya Philosophy) | Indian Philosophy (ভারতীয় দর্শন)

ন্যায় দর্শন কি | শিক্ষায় ন্যায় দর্শনের প্রভাব কি | What is Nyaya Philosophy in Bengali

Leave a Comment

error: Content is protected !!