লোকসভার স্পিকারের ক্ষমতা ও কার্যাবলী | Powers of Speaker of Lok Sabha

লোকসভার স্পিকারের ক্ষমতা ও কার্যাবলী | Powers of Speaker of Lok Sabha
অথবা, লোকসভার স্পিকারের ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা করো

উত্তর:

লোকসভার স্পিকারের ক্ষমতা ও কার্যাবলী (Powers of Speaker of Lok Sabha)

লোকসভায় যিনি সভাপতিত্ব করেন, তাঁর নাম স্পীকার বা অধ্যক্ষ। ভারতীয় সংবিধানে স্পীকারের পদ অত্যন্ত সম্মানীয় ও মর্যাদাসম্পন্ন। স্পীকার (Speaker) কথাটি এসেছে ইংলন্ডের শাসনব্যবস্থা থেকে। পূর্বে রাজার কাছে আবেদন জানানোর জন্যে কমন্সসভার পক্ষে একজন Spokesman বা মুখপাত্র হিসেবে কাজ করতেন। তিনি রাজার সঙ্গে কথা বলতেন। সেই থেকে স্পীকার কথাটির উৎপত্তি।

নির্বাচন ও কার্যকাল :

নব-নির্বাচিত লোকসভার প্রথম অধিবেশনেই লোকসভার সদস্যগণ নিজেদের মধ্যে থেকে একজন স্পীকার ও একজনকে ডেপুটি স্পীকার নির্বাচিত করেন। সাধারণত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কোনো নেতা এই পদে নির্বাচিত হন। স্পীকারের কার্যকাল সাধারণভাবে পাঁচ বছর। তবে বিশেষ পদ্ধতিতে তাঁকে অপসারিত করা যায়। এক্ষেত্রে ১৪ দিন পূর্বে লোকসভায় তাঁর পদচ্যুতির নোটিশ দিতে হয়। ১৪ দিন পরে ওই প্রস্তাব সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে গৃহীত হলে, তাঁকে সরে যেতে হয়। অবশ্য স্পীকারকে আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ দেওয়া হয়।

ক্ষমতা ও কার্যাবলী :

স্পীকার হলেন লোকসভার সভাপতি। তাই সভাপতি হিসেবে লোকসভার পূর্ণ দায়িত্ব তাঁর হাতে আছে। এই দায়িত্বের কারণে তিনি বিপুল ক্ষমতা ভোগ করেন। সংবিধান তাঁকে বিশেষ মর্যাদা ও ক্ষমতা দিয়েছে। মর্যাদাগত বিচারে স্পীকার হলেন সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতির সমতুল্য। ভারতের সংবিধান হল—তাঁর ক্ষমতার প্রধান উৎস। তা ছাড়া, অলিখিতভাবে তিনি কিছু ক্ষমতা ভোগ করেন।

অধ্যাপক জোহারী (Johari ) তাঁর ক্ষমতাকে চার ভাগে ভাগ করেছেন। সেগুলি নিম্নে আলোচিত হল :

(ক) সভার কাজ পরিচালনা করাঃ স্পীকারের প্রধান কাজ হল – সভাপতি হিসেবে সভার কাজ পরিচালনা করা। কখন কোন্ বিষয় আলোচনা হবে, কে বলবেন, কতক্ষণ বলবেন তা অধ্যক্ষ ঠিক করে দেন। তাঁর অনুমতি ব্যতীত কোনো মুলতুবি প্রস্তাব তোলা যায় না। কোনো বিষয়ে সভায় ভোট গ্রহণ ও ফলাফল ঘোষণার দায়িত্ব তাঁর। এসব ব্যাপারে স্পীকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এমনকি তাঁর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়া যায় না।

(খ) সভার শৃঙ্খলা রক্ষা করাঃ সভার মধ্যে নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষা করা স্পীকারের অন্যতম কাজ। বক্তৃতায় কোনো অবান্তর বিষয় থাকলে, তিনি তা বন্ধ করতে পারেন। কোনো সদস্য বিশৃঙ্খল আচরণ করলে, তিনি তাঁকে সতর্ক করে দেন। তাতে কোনো কাজ না হলে, তিনি তাঁকে সভা ত্যাগ করতে নির্দেশ দিতে পারেন। সে নির্দেশ না মানলে, মার্শাল দিয়ে তাকে বের করে দিতে পারেন। সভা পরিচালনার কাজে বাধার সৃষ্টি হলে, তিনি সাময়িকভাবে সভার কাজ বন্ধ করে দিতে বা অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করতে পারেন। এখানেও তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এ ব্যাপারে আদালতের কোনো এক্তিয়ার নেই। 

(গ) অর্থবিল নির্ণয় করাঃ অর্থবিল শুধুমাত্র লোকসভায় তোলা যায়। কোনো বিল অর্থবিল কিনা সে সম্পর্কে প্রশ্ন দেখা দিলে, স্পীকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে। তিনি এই মর্মে একটি সার্টিফিকেট দেন।

(ঘ) কমিটি সম্পর্কিত ক্ষমতাঃ সুষ্ঠুভাবে কাজ করার জন্যে লোকসভায় কতকগুলি কমিটি গঠিত হয়। স্পীকার এইসব কমিটির সভাপতি নিয়োগ করে থাকেন। তাঁর অধীনে থেকে কমিটিগুলিকে কাজ করতে হয়। কমিটিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, – আবেদন কমিটি, অধিকার সংক্রান্ত কমিটি, নিয়মকানুন সংক্রান্ত কমিটি প্রভৃতি।

(ঙ) রাষ্ট্রপতির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করাঃ স্পীকার লোকসভা ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করেন। লোকসভার সদস্যরা তাঁদের যাবতীয় বক্তব্য স্পীকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপিত করেন। রাষ্ট্রপতির বক্তব্য স্পীকারের মাধ্যমে লোকসভায় উপস্থাপিত হয়।

(চ) সদস্যদের বিশেষ অধিকার রক্ষা করাঃ পার্লামেন্টের সদস্যদের কতকগুলি বিশেষ অধিকার আছে। সদস্যরা যাতে সেই অধিকারগুলি ঠিকমতো ভোগ করতে পারেন, সে বিষয়ে স্পীকার নজর রাখেন। অধিকার ভঙ্গ হলে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন। শুধু সদস্যের নয়, লোকসভার নিজস্ব অধিকার আছে। যেমন, কেউ লোকসভার অবমাননা করতে পারে না। কেউ যদি অবমাননা করে, তাহলে স্পীকার তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। এমনকি গ্রেপ্তার করার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন।

(ছ) সংখ্যালঘু দলের স্বার্থ রক্ষা করাঃ ভারতে একাধিক দল আছে। স্বল্প সদস্য নিয়ে কিছু বিরোধী দল আছে। তাঁরা যাতে তাঁদের বক্তব্য রাখার সুযোগ পান, স্পীকার সেদিকে লক্ষ রাখেন। এইভাবে স্পীকার গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত করার দায়িত্ব পালন করেন।

(জ) যৌথ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করাঃ কোনো সাধারণ বিল নিয়ে যদি লোকসভা ও রাজ্যসভার মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়, তখন রাষ্ট্রপতি উভয়কক্ষের যৌথ অধিবেশন ডাকেন। এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন স্পীকার। 

পদমর্যাদা :

ভারতে লোকসভার অধিকার রক্ষা এবং সভার কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সংবিধান স্পীকারের উপর গুরুদায়িত্ব দিয়েছে। এ কাজ করতে গেলে স্পীকারকে নিরপেক্ষ হতে হবে। ব্রিটেনে কমন্সসভার স্পীকার নিরপেক্ষভাবে কাজ করেন। তাই নির্বাচনের পর তিনি দলের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেন। এই নিরপেক্ষতার জন্যে সেখানে যিনি একবার স্পীকার হন, তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করলে অন্য কেউ দাবিদার থাকে না।

কিন্তু ভারতে ব্রিটেনের মতো পার্লামেন্টারী শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠলেও স্পীকারের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। অবশ্য লোকসভার স্পীকার অনন্তশায়নম্ আয়েন্সার, এমনকি সঞ্জীব রেড্ড বলেছিলেন,—স্পীকারকে দলের ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করতে হবে। তবে আমরা মনে করি, লোকসভার স্পীকার যদি ব্রিটেনের মতো নিরপেক্ষভাবে কাজ করেন, তাহলে তিনি দলমত নির্বিশেষে সকলের আস্থাভাজন হবেন। তাতে গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে।

আরো পড়ুন

ডেভিড হেল্ড এর গণতন্ত্র মডেলটি আলোচনা করো | David Held’s Model of Democracy

ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকার | Fundamental Rights of Indian Constitution

সমাজ কাকে বলে | What is Society in Bengali

সামাজিক পরিবর্তন কি | সামাজিক পরিবর্তনের বৈশিষ্ট্য | Meaning and Characteristics of Social Change

সমাজবিজ্ঞান | Sociology শব্দের অর্থ | সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা | সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি

Leave a Comment

error: Content is protected !!