ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি | Principles of Decentralization of Power

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি | Principles of Decentralization of Power

উত্তর:

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি (Principles of Decentralization of Power)

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের ধারণাটি অনেক প্রাচীন। চতুর্থ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অ্যারিস্টটলের রচনায় প্রথম এই ধারণাটি পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে রোমান দার্শনিক পলিবিয়াস ও সিসেরো ফরাসি দার্শনিক বোঁদা, ইংরেজ দার্শনিক জন লক ও হ্যারিংটন প্রমুখ চিন্তাবিদ ও দার্শনিকদের রচনায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বিশেষ আলোচনা লক্ষ করা যায়। তবে, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটিকে প্রথম সুসংবদ্ধভাবে তুলে ধরেছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কু। মন্টেস্কু তাঁর The Spirit of Laws (১৭৪৮) গ্রন্থে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ সম্পর্কে সুস্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরেন। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির অর্থ হল সরকারের তিনটি বিভাগের স্বতন্ত্রতা।

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি :

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বলতে সরকারের তিনটি বিভাগ যথা আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য প্রদান করার নীতিকে বোঝায়। ভারতে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি থাকলেও তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো কঠোরভাবে মানা হয় না। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মূল নীতি গুলি হল-

(১) সরকারের তিনটি বিভাগ অর্থাৎ আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ পরস্পর পরস্পরের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র থাকবে। 

(২) এক বিভাগ অপর কোনো বিভাগের কাজ করবে না। প্রত্যেকটি বিভাগের কাজের ক্ষেত্র থাকবে সম্পূর্ণ আলাদা। 

(৩) একই ব্যক্তি একাধিক বিভাগের সঙ্গে যুক্ত থাকবে না। 

(৪) এক বিভাগ অন্য কোনো বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করবে না। 

ক্ষমতা স্বতন্ত্রকরণ নীতির পক্ষে যুক্তি : 

১. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে সরকারের তিনটি বিভাগ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র সঙ্গে কাজ কর্ম পরিচালনা করায় একে অপরের কাজে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পায় না বলে বিভাগীয় স্বাধীনতা অক্ষুন্ন থাকে ৷

২. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বাস্তবায়িত হলে সরকারের তিনটি বিভাগ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে কাজকর্ম করার সুযোগ পায় বলে তাদের কর্মকুশলতা বৃদ্ধি পায় ৷

৩. অনেকে মনে করেন ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বাস্তবায়িত হলে সরকারের স্বৈরাচারী প্রবণতা রোধ করা সম্ভব হয় ৷ কারণ এক্ষেত্রে প্রতিটি বিভাগ প্ৰায় সমমর্যাদার অধিকারী হওয়ায় কোনো একটি বিভাগের স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা হ্রাস পায় ৷ 

৪. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়োগের ফলে সরকারের তিনটি বিভাগের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় বলে কাজকর্মের তাগিদে প্রত্যেকটি বিভাগের মধ্যে দায়িত্বশীলতার বিকাশ ঘটে।

ক্ষমতা স্বতন্ত্রকরণ নীতির বিপক্ষে যুক্তি : 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যবাইন, গিলক্রিস্ট, লাস্কি, লিপসন এরা ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বিপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন।

১. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পূর্ণ প্রয়োগ আদৌ সম্ভব নয় ৷ কারণ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারের প্রধান তিনটি বিভাগকে কখনোই পুরোপুরি স্বতন্ত্র করা যায় না ।

২. গিলক্রিস্ট, স্যাবাইন এদের মতে আইন বিভাগ যদি স্বৈরাচারী হয় তবে তার দ্বারা প্রণীত স্বৈরাচারী আইন কে কার্যকর করতে শাসন বিভাগ যেমন বাধ্য থাকে তেমনি সেই আইন অনুসারে বিচার কার্য সম্পাদন করতে বিচার বিভাগ ও বাধ্য থাকে ৷ সুতরাং ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি কখনোই ব্যক্তি স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হতে পারে না ৷ 

৩. ব্রিটেন, ভারতের মতো যেসব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র বা মন্ত্রিসভা চালিত শাসন ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় থাকার ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ সম্ভব নয় ৷

সাংবিধানিক মর্যাদা :

ভারতে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটিকে কঠোরভাবে মানা হয় না। তবে ভারতের সংবিধানে যে ধারাগুলিতে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির অনুশীলন লক্ষ করা যায় সেগুলি হল:

(১) সংবিধানের ৫০ নং ধারায় বলা হয়েছে রাষ্ট্র সরকারের বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে পৃথক করতে চেষ্টা করবে। কিন্তু যেহেতু এটি রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশমূলক নীতির অন্তর্ভুক্ত সেকারণে এটির প্রয়োগ বাধ্যতামূলক নয়।

(২) সংবিধানের ৫৩ নং ধারা অনুযায়ী কেন্দ্রের শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত থাকবে এবং ১৫৪ নং ধারা অনুযায়ী রাজ্যের শাসন সম্পর্কিত ক্ষমতা রাজ্যপালের উপর ন্যস্ত থাকবে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপাল উভয়েই দেওয়ানি ও ফৌজদারি দায় থেকে মুক্ত থাকবেন।

(৩) সংবিধানের ১২১ এবং ২১১ নং ধারা অনুযায়ী আইনসভা সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টের বিচারপতিদের আচরণ নিয়ে আলোচনা করতে পারে না।

(৪) সংবিধানের ১২৩ নং ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি জরুরি আইন (Ordinace) জারি করার ক্ষমতা ভোগ করেন। এই ক্ষমতা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টের অধিবেশন বন্ধ থাকাকালীন সময়ে বিশেষ প্রয়োজনে পার্লামেন্টের এক্তিয়ারভুক্ত যেকোনো বিষয়ে আইন জারি করতে পারেন, যা আইনের মতোই কার্যকর হবে।

(৫) ৩৬১ নং ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বা কোনো অঙ্গরাজ্যের রাজ্যপাল তাঁদের ক্ষমতার প্রয়োগ ও কর্তব্য সম্পাদনের জন্য আদালতের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকেন না।

নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য:

ভারতে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির যে উদাহরণগুলি আলোচনা করা হল, সেই প্রেক্ষিতে বলা যায় ভারতে কোনো বিভাগ যাতে স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে না পারে সে কারণে নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের (checks and balances) ব্যবস্থা রয়েছে। নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের নীতি অনুযায়ী রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগ নির্দিষ্ট সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী পরস্পরের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে।

মূল্যায়ন :

কঠোরভাবে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের নীতিটি অবাস্তব এবং সে কারণে এখনও পর্যন্ত কোনো দেশেই এই নীতিটি সম্পূর্ণরূপে গৃহীত হয়নি। তবে তার অর্থ এই নয় যে বর্তমানে এই নীতিটির কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই। রাষ্ট্রের বিভাগগুলি স্বৈরাচারিতা রোধে, নাগরিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে, দক্ষ প্রশাসন তৈরিতে, বিচার বিভাগের স্বকীয়তা রক্ষায় এই নীতির প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না।

আরো পড়ুন

গঠনবাদ | শিখনের গঠনবাদ তত্ত্ব | ভিগটস্কির শিখন মতবাদ | Constructivism in Bengali

লর্ড কার্জনের শিক্ষানীতি | Lord Curzon-Educational Policy in Bengali

শিক্ষণ কি | শিক্ষনের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য | What is Teaching | Nature and Characteristics of Teaching

ব্যতিক্রমধর্মী শিশু | ব্যতিক্রমধর্মী শিশুর সংজ্ঞা ও শ্রেণিকরণ | বিশেষ শিক্ষা | Special Education in Bengali

Leave a Comment

error: Content is protected !!