বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করো | Buddhist Education System in Bengali

Q: বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করো | Buddhist Education System in Bengali

উত্তর:

ভূমিকা :

ভারতীয় সভ্যতা বিবিধের মিলনক্ষেত্র। যুগে যুগে বিভিন্ন জাতির মানুষ ভারতে এসেছে এবং তাদের বিভিন্ন সংস্কৃতির সমন্বয়ে এই সভ্যতাকে বিকশিত করছে। ভারত কাউকে পর বলে দুরে সরিয়ে দেয় নি। বরং সব কিছুকে উদারভাবে গ্রহণ করেছে এবং তাকে আপন করে নিয়েছে। তাই ভারতকে পৃথিবীর ক্ষুদ্র সংস্করণ বলা হয়ে থাকে। ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা সভ্যতার সূচনা লগ্ন থেকেই ভারতীয়দের চাহিদা ও লক্ষ্যকে সামনে রেখেই গড়ে উঠেছে। ভারতের এই শিক্ষা ব্যবস্থার মূলে ছিল আর্য ও অনার্য শিক্ষা সংস্কৃতির সমন্বয় যা পরবর্তিকালে বাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি মানুষের ক্ষোভের ও অসন্তোষের পরিণাম স্বরুপ বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটায়।

বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা :

ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল জটিল ও ব্যয়বহুল। ফলে এই শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি জনগণের মধ্যে অসন্তোষ পুঞ্জিভূত হতে থাকে। এই শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল মোটামুটি উচ্চ শ্রেণীর কুক্ষিগত। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় সর্ব সাধারণের কোন স্থান ছিল না বিশেষ করে নিম্ন বৃত্তদের মধ্যে। ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থার এই ত্রুটিগুলি দূর করতে গৌতম বুদ্ধ প্রয়াসী হন। তিনি জনগণের সার্বিক চাহিদা পূরণ করতে এবং জড়া,ব্যধি ও মৃত্যুকে জীবনের দুঃখের কারণ হিসাবে চিহ্নিত করে তাকে দূর করতে প্রয়াসী হন। তিনি নির্বাণ লাভকেই জীবনের পরমার্থ হিসাবে চিহ্নিত করে তার হাত থেকে জীবকে মুক্তি দিতে যে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন তাকেই বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা বলা হয়ে থাকে।

বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য : বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থার কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। সেগুলি নিম্নরুপ – 

বুদ্ধদেব মনে করতেন যে জড়া, ব্যধি ও মৃত্যুই মানুষের দুঃখের অন্যতম কারণ। এই দুঃখের কারণ আছে. এবং এই দুঃখকে প্রতিরোধ করার পথও আছে ।বৌদ্ধ ধর্মে মানুষের দুঃখের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে অজ্ঞতাকেই এর মূল কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমেই এই অজ্ঞতাকে দূর করা সম্ভব৷ ফলে তারা শিক্ষার মাধ্যমে মনের অন্ধকার দূর করে জ্ঞানের আলো জ্বালাতে প্রয়াসী হয়েছেন। বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রতিটি মানুষের আত্মবিকাশের উপর প্রধান্য দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিতদের বৌদ্ধ ধর্মের প্রচলিত রীতিনীতি,আচার আচরণ পদ্ধতি ইত্যাদি প্রশিক্ষণের জন্য বৌদ্ধশিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

পাঠ্যক্রম : বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থায় লৌকিক শিক্ষার সঠিক কোন পাঠক্রম ছিল না। বৌদ্ধ শিক্ষার্থীরা প্রত্যহ সকাল ও সন্ধ্যায় আচার্যের সামনে উপস্থিত হতেন এবং আচার্য তাদের বৌদ্ধদের মূল ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটকের বিষয়বস্তু হৃদয়াঙ্গমের ব্যবস্থা করতেন। এ ভাবেই বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থার সূচনা হলেও পরবর্তিকালে তা বিস্তৃত হয় এবং এই শিক্ষা ব্যবস্থায় ভেষজ বিজ্ঞান, রসায়ন, স্থাপত্য প্রভৃতি বিষয় পঠন পাঠনের ব্যবস্থা করা হয়।তা ছাড়া যে সমস্ত গৃহীরা শিক্ষার জন্য সংঘে আসত তাদের জন্য বৃত্তি শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। তবে বলা যায় যে বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থার পাঠ্যক্রম বৈদিক শিক্ষার পাঠ্যক্রম অপেক্ষা অনেক বেশী উদার ও বিস্তৃত ছিল।

শিক্ষণ প্রণালী : বৌদ্ধিক শিক্ষা ব্যবস্থায় লিপির ব্যবহার খুবই সীমিত ছিল। ফলে বৌদ্ধিক শিক্ষা প্রণালীতে মৌখিকতার প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন দৃষ্টান্ত, আলোচনা, বিতর্ক, উপদেশ মূলক গল্পের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার প্রচলন দেখতে পাওয়া গেছে। বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থায় ভ্রমনের মাধ্যমেও শিক্ষা দেওয়া হত। যদিও শিক্ষা ক্ষেত্রে মাতৃভাষার প্রচলন ছিল তা সত্তেও অনেক সময় পালি ও সংস্কৃত ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হত। উচ্চ শিক্ষার জন্য সংস্কৃত ভাষা শিক্ষার অন্যতম অবলম্বন ছিল। শিক্ষাকে সহজ বোধ্য করে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার করা হত বলে তা সর্বসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল।

শিক্ষক শিক্ষার্থীর গভীর সম্পর্ক : শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীর প্রতি যথেষ্ঠ স্নেহ পরায়ণ ছিল। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক গুরু ও শিষ্যের হলেও শিক্ষক যেমন শিক্ষার্থীর বিপদে আপদে শিষ্যের পাশে এসে দাঁড়াত তেমনি শিক্ষার্থী ও গুরুর প্রতি শ্রদ্ধাবান ছিল। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী পরস্পরের প্রতি দায়বদ্ধতার জন্য তাদের মধ্যে এক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থায় ধনী দরিদ্র, জাতপাত ও বর্ণের কোন বৈষম্য না থাকায় সকল শ্রেণীর মানুষই শিক্ষার সমান সূযোগ ও সুবিধা পেতেন। প্রকৃত শিক্ষাই জীবনের অন্ধকার দূর করে মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে এই দৃঢ় বিশ্বাস থেকেই বৌদ্ধ শিক্ষকগণ শিক্ষা বিস্তারে যথেষ্ট আন্তরিক ছিলেন বলেই বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সুতরাং বলা যায় ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় বৌদ্ধদের অবদান যথেষ্ট ছিল। বৌদ্ধদের অনাড়ম্বর শিক্ষা ব্যবস্থায় সমাজের নিম্ন শ্রেণীর মানুষ ব্রাহ্মণ্য ধর্মের নীপীড়ণ থেকে রক্ষা পায় এবং সমাজ জীবনে জাতপাত বর্ণের ভেদ শীথিল হয়ে আসে।

নিয়ম শৃঙ্খলা : বৌদ্ধ বিহারের জীবনযাত্রা শৃঙ্খলা পরায়ন ছিল। গুরু শিষ্য প্রত্যেকের জন্যই কিছু নিয়মকানুন প্রচলিত ছিল এবং সেগুলিকে তারা মেনে চলতে বাধ্য হতো। ফলে বৌদ্ধ বিহার গুলিতে নিয়ম

শৃঙ্খলার কোন সমস্যা দেখা দিত না। কোন কারণে দায়িত্ব কর্তব্য ও নিয়ম শৃঙ্খলা ভঙ্গ হলে ১০ জন ভিক্ষু মিলে অপরাধের বিচার করে শাস্তি দেওয়া হত। যদি অপরাধ গুরুতর হত তবে অপরাধকারীকে মঠ থেকে বের করে দেওয়া হত। তবে বিভিন্ন উৎস থেকে জানা যায় যে বৌদ্ধ সংঘগুলির জীবন যাত্রা কঠোর নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। তা সত্তেও বৌদ্ধ সংঘের জীবন যাত্রা নিরস ছিল না। এখানে বিভিন্ন ধরনের খেলা ধুলা, নাচ গান ও অন্যান্য আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থা ছিল। দেশ ভ্রমন ছিল বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম অঙ্গ।

গুরুত্ব :

1) বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থায় জাতি ধর্ম নির্বিশেষে যে সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তার গুরুত্বকে বর্তমানেও অস্বীকার করার কোন উপায় নেই ৷

2) শিক্ষা ক্ষেত্রে জাতি,ধর্ম ও বর্ণের ভেদ ছিল না। শিক্ষার ক্ষেত্রে সকলেই সমান সূযোগ সুবিধা পেত। বর্তমান শতাব্দিতেও তাকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।

3) বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থাকে জনসাধারণের বোধগম্য করে গড়ে তোলার জন্য আঞ্চলিক ভাষার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। বর্তমানেও শিক্ষার ক্ষেত্রে এই নীতিটিকেই প্রধান্য দেওয়া হয়।

4) শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রাঞ্জল করে তোলার জন্য বিভিন্ন দৃষ্টান্ত, বিতর্ক ও গল্পের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার প্রচেষ্টা করা হত। ফলে শিক্ষার্থীর সেই শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি বিরাগ জন্মাতো না। শিক্ষকদের যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ করা হত শতাব্দিতেও সেই রীতি প্রচলিত আছে।

উপসংসহার :

বৌদ্ধ শিক্ষার পূর্বে ভারতে ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ছিল সমাজের উচ্চশেণীর মুষ্ঠিমেয় মানুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ফলে সমাজের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষরাই এই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিল। তা ছাড়া এই শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল আচার আচরণ সর্বস্ব ও কঠোর। ফলে এই শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি জনগণের কোন আস্থাই ছিল না। বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থার এই ত্রুটি বিচ্যুতি দূর করে তাকে সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল করে তাকে সর্বজনীন করতে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। বর্তমানে শিক্ষা ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছে তার ভিত্তি বৌদ্ধ যুগেই রচনা করা হয়ে ছিল বললে সত্যের অপলাপ হয় না৷

আরো পড়ুন

মধ্যযুগের শিক্ষা ব্যবস্থা বা ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থা | Islamic Education During Medieval Period

ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর | Brahmanical System of Education in Bengali

প্রয়ােগবাদ (Pragmatism) কি | প্রয়ােগবাদী দর্শনের মূলনীতি | শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োগবাদের প্রভাব

দর্শন কি | দর্শনের সংজ্ঞা দাও | দর্শনের স্বরূপ বা প্রকৃতি আলোচনা করো

যোগ দর্শন (Yoga Philosophy) | Indian Philosophy (ভারতীয় দর্শন)

সাংখ্য দর্শন (Sankhya Philosophy) | Indian Philosophy (ভারতীয় দর্শন)

ন্যায় দর্শন কি | শিক্ষায় ন্যায় দর্শনের প্রভাব কি | What is Nyaya Philosophy in Bengali

ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর | Brahmanical System of Education in Bengali

Leave a Comment

error: Content is protected !!