মধ্যযুগের শিক্ষা ব্যবস্থা বা ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থা | Islamic Education During Medieval Period

মধ্যযুগের শিক্ষা ব্যবস্থা বা ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থা | Islamic Education During Medieval Period

উত্তর:

মধ্যযুগের শিক্ষা ব্যবস্থা বা ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থা

ধর্মীয় গোড়ামী,রাজরোশ ইত্যাদির কারণে ভারতের প্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থা যখন বিলুপ্ত হতে থাকে ঠিক তখনই ইসলাম ধর্মের প্রচার ও ইসলামিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানোর জন্য ভারতবর্ষে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

মধ্যযুগের শিক্ষা ব্যবস্থা

1) শিক্ষার লক্ষ্য : 

মধ্যযুগীয় ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য ছিল ইসলাম ধর্ম গ্রন্থের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করার জন্য মানুষকে শিক্ষিত করে তোলা। হজরত মুহাম্মদ বলেছিলেন, “জ্ঞান মানুষকে সত্য – মিথ্যা, ধর্ম – অধর্ম, ভালো – মন্দ প্রভৃতি বিচার করার সক্ষমতা দান করে। তাই প্রত্যেকের জ্ঞান অর্জন করা হল একান্ত কর্তব্য।”

2) শিক্ষারম্ভ : 

ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থাতেও একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন শুরু হত। একে বলা হত মক্তব অনুষ্ঠান। শিক্ষার্থীর বয়স যখন চার বছর, চার মাস, চার দিন হত শিশুকে রঙিন পোশাক পরিয়ে, হাতে একটি রুপোর ফলক দিয়ে মক্তবের মৌলবির সামনে বসানো হত। ওই ফলকে কোরানের একটি পংক্তি লেখা থাকতো। মৌলবি কোরানের ওই পংক্তিটি বারবার উচ্চারণ করে শিশুকে মুখস্ত করাতেন। এইভাবে মক্তব অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীর বিদ্যারম্ভ হত। এরপর শিশুর শিক্ষার জন্য একজন শিক্ষক নিয়োগ করা হত। শিশুর ৭ বছর বয়স হলে তাকে মক্তবে শিক্ষা লাভের জন্য পাঠানো হত।

3) পাঠক্রম : 

প্রাথমিক শিক্ষা : পাঠক্রমের মধ্যে ছিল লিখন, পঠন ও কোরানের বয়ান মুখস্ত করা ইত্যাদি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গণিত শিক্ষার ব্যবস্থাও ছিল। শিক্ষার মাধ্যম ছিল আরবি। আধ্যাত্মিক ও নৈতিক বিকাশের জন্য দরবেশ ও পীর পয়গম্বরদের জীবনী শোনানো হত। শিক্ষার্থীর সামাজিক বিকাশের জন্য চিঠি লেখা, আবেদন পত্র লেখা এবং কথোপকথনের কৌশল শেখানো হত। মধ্যযুগে আরবি, ফারসি ও হিন্দি ভাষা সংমিশ্রণে উর্দু ভাষার সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে উর্দুভাষাকেও পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

উচ্চশিক্ষা : উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করত। মুঘল যুগেই মাদ্রাসার পাঠক্রম ছিল ব্যাপক। এখানে ব্যাকরণ, আইন, চিকিৎসা বিজ্ঞান, তর্কবিদ্যা, প্রকৃতি বিজ্ঞান, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হত। আকবরের সময়ে মাদ্রাসার পাঠক্রমের পরিধি আরো বিস্তৃত ও ব্যাপক হয়েছিল।

4) শিক্ষাদান পদ্ধতি :

• মক্তব : মক্তবের শিক্ষা পদ্ধতি ছিল মৌখিক। পড়া মুখস্ত করানোই ছিল শিক্ষকের প্রধান কাজ। শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল যান্ত্রিক। শিশুরা স্পষ্টভাবে কথা বলতে শিখলে তাকে কোরানের পংক্তি বারবার উচ্চারণ করিয়ে মুখস্ত করানো হত। শিশুরা কোন কিছু না বুঝে কেবল অনুকরণ করেই মুখস্ত করত। হাতের লেখার উপর বিশেষ নজর দেওয়া হত। শিশুর বয়স সাত বছর হলে তাকে বর্ণমালার সঙ্গে পরিচয় করানো হত।

• মাদ্রাসা : মাদ্রাসায় শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে বক্তৃতা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হত। মুখস্ত ছিল শিক্ষার প্রধান পদ্ধতি। তর্ক বিদ্যা, দর্শন, ধর্ম প্রভৃতি বিষয়গুলি শিক্ষাদানের জন্য আলোচনা সভার আয়োজন করা হত। এতে শিক্ষার্থীদের আত্মশিখনের পাশাপাশি জ্ঞানের গভীরতাও বৃদ্ধি পেত। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক বিষয় সমূহের শিক্ষাদানের জন্য হাতে কলমে কাজের ব্যবস্থা করা হত। চিকিৎসা বিদ্যা, জ্যোতিষ শাস্ত্র,গণিত প্রভৃতি বিষয়গুলির ক্ষেত্রে সক্রিয়তা ভিত্তিক শিক্ষণ পদ্ধতি অনুসরণ করা হত।

5) শিক্ষক শিক্ষার্থীর সম্পর্ক : 

মধ্যযুগের শিক্ষকদের উচ্চ সামাজিক মর্যাদা দেওয়া হত। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল প্রীতিপূর্ণ। মধ্যযুগে উলেমাদের অবশ্যই সৎ চরিত্রের হতে হত। ইসলামীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় সমাজ যেমন শিক্ষককে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন, তেমনি শিক্ষার্থীও শিক্ষককে পিতৃতুল্য মনে করতেন। সম্রাট মোহাম্মদ বিন তুঘলক প্রতিষ্ঠিত ফিরোজশাহী মাদ্রাসাতে শিক্ষক শিক্ষার্থীর একত্রে বসবাসের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই ধরনের আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক শিক্ষার্থী একত্রে বসবাসের ফলে শিক্ষার্থীর জীবনধারার ওপর শিক্ষকের গভীর প্রভাব পড়তো।

6) মূল্যায়ন পদ্ধতি ও ডিগ্রী প্রদান :

ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থায় আধুনিক যুগের মতো পরীক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন ছিল না। বরং শিক্ষার্থীদের ক্রমিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা ছিল। শিক্ষক সারা বছর ধরে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা বিভিন্ন পর্যায়ে বিচার করতেন। সামগ্রিক মূল্যায়নের জন্য সার্বজনীন প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হত। তার জন্য বিতর্ক সভা, আলোচনা সভা ও প্রবন্ধ পাঠ ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা মূল্যায়ন করা হত। যোগ্যতার নিরিখেই শংসাপত্র দেওয়া হত। আলিম, ফাজিল, কাবিল প্রভৃতি উপাধি প্রদান করা হত।

7) নারী শিক্ষা :

ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থায় নারী শিক্ষার বিশেষ কোনো উন্নতি হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে কিছু ব্যবস্থা থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য। পরে পর্দা প্রথা চালু হওয়ায় সাধারণ নারী শিক্ষা সংকুচিত হলেও, উচ্চ বংশের মেয়েদে অন্দররমহলে শিক্ষার জন্য উলেমা এবং চারুকলা শিক্ষার জন্য ওস্তাদ নিয়োগ করা হত। রাজ পরিবারের ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলারা নিজেরা শিক্ষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতাও করতেন।

আরো পড়ুন

বৈদিক শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য | Characteristics of Vedic Education System

বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করো | Buddhist Education System in Bengali

ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর | Brahmanical System of Education in Bengali

স্যাডলার কমিশন (Sadler Commission) | স্যাডলার কমিশনের সুপারিশ

শিক্ষার পরিধি গুলি আলোচনা করো

প্রকৃতিবাদ কাকে বলে | শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকৃতিবাদী দর্শনের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করো

সনদ আইন (1813) | সনদ আইনের উদ্দেশ্য | সনদ আইনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

Leave a Comment

error: Content is protected !!