ডেভিড হেল্ড এর গণতন্ত্র মডেলটি আলোচনা করো | David Held’s Model of Democracy

ডেভিড হেল্ড এর গণতন্ত্র মডেলটি আলোচনা করো

উত্তর:

ডেভিড হেল্ড এর গণতন্ত্র মডেল (David Held’s Model of Democracy) :

ডেভিড হেল্ড এর গণতন্ত্র মডেল
ডেভিড হেল্ড

গণতন্ত্র কেবল একটি শাসনব্যবস্থা বা সরকারের ধরনকেই বোঝায় না, গণতন্ত্র বলতে এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝায়, যেখানে জনগণের সম্মতি ও রাজনৈতিক মর্যাদা- সাম্যের নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমতার নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা। ‘গণতন্ত্র’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল— ‘জনগণের কর্তৃত্ব’ বা ‘জনগণের শাসন। Models of Democracy-States and Societies’ নামক গ্রন্থে ডেভিড হেল্ড গণতন্ত্রের যে ধারণা দিয়েছেন তাকে সাধারণভাবে ২ ভাগ করা যায়।

১) সনাতন মডেল :

গণতন্ত্রের সনাতন মডেল হিসেবে তিনি চার ধরনের গণতন্ত্রের কথা বলেছেন। সেগুলি হল –

ক) এথেন্সের ধ্রুপদী গণতন্ত্র: এথেনীয় গণতন্ত্রের পরিধি বা ক্ষেত্র হল নগর রাষ্ট্র। ক্ষুদ্র নগর-রাষ্ট্রই হল এই গণতন্ত্রের এলাকা। এখানে নাগরিকরা আইন বিভাগীয় ও বিচার বিভাগীয় কার্যাবলীতে সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। এথেন্সের গণতন্ত্রে সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস হল ‘নাগরিক সভা’। এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাস করা হয়। যে, প্রত্যেক নাগরিকই শাসন করবে এবং শাসিত হবে পর্যায়ক্রমে। এথেন্সীয় গণতন্ত্রে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে নাগরিকদের রাজনীতিক সাম্যের উপর। 

খ) সংরক্ষণমূলক গণতন্ত্র: সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন সংরক্ষণমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। জনসাধারণের হাতে সার্বভৌম ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে বৈধ শাসকই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হন। এখানে রাষ্ট্রক্ষমতা প্রকৃতিগত বিচারে নৈর্ব্যক্তিক এবং আইনগতভাবে সীমাবদ্ধ। সংরক্ষণমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারের দায়িত্বশীলতার ব্যবস্থা আছে। সরকারের দায়বদ্ধতা কার্যকর হয় বিবিধ উপায় পদ্ধতির মাধ্যমে। এই উপায়গুলি হল- গোপন ভোট ব্যবস্থা নির্দিষ্ট সময় অন্তর নিয়মিত নির্বাচন ব্যবস্থা : বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, উপদল ও রাজনীতিক নেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্কের অস্তিত্ব প্রভৃতি। এই ব্যবস্থার সমর্থক দার্শনিক হলেন- জন লক, মন্তেসু, বেন্থাম প্রমুখ।

গ) উন্নয়নমূলক: উন্নয়নমূলক গণতন্ত্রের কতকগুলি বৈশিষ্ট্যসূচক বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই বিষয়গুলি হল- প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র, , প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার নীতি ; জনসাধারণের সার্বভৌমিকতার ধারণা, জনগণের কার্যকলাপের স্বাধীনতা; জনগণের স্বাধীনতায় রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের সীমাবদ্ধতা, বাজার অর্থনীতি প্রভৃতি। এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক বিষয়াদিতে নাগরিকদের অংশগ্রহণের কথা বলা হয়। এই কারণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ও বিশেষভাবে উদ্যোগী নাগরিকের কথা বলা হয়। এরূপ নাগরিক গড়ে তোলার ব্যাপারে রাষ্ট্রের ভূমিকাই মূখ্য। এই গণতন্ত্রের মুখ্য সমর্থক হলেন- জন মিল।

ঘ) মার্কসীয় ধারার প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র: প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের এই মডেলটির মূল মার্কসীয় দর্শনের মধ্যেই নিহিত আছে। মার্কসীয় বক্তব্যের ভিত্তিতে গণতন্ত্রের এই মডেলের কথা বলা হয়েছে। এই মডেলের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বাজার অর্থনীতি, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার, শ্রেণীর অস্তিত্ব, শ্রেণী শোষণ, অভাব প্রভৃতির অবলুপ্তির কথা বলা হয়েছে। মার্কসীয় প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অর্থনীতিক এবং রাজনীতিক সাম্যের উপর বিশেষ জোড় দেওয়া হয়। পীড়নমূলক যাবতীয় ব্যবস্থার স্থানে মানুষজনের নিজেদের পরামর্শদাতাদের ভূমিকার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। মার্কসীয় প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক মডেল অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যক্তির স্বাধীন বিকাশের মধ্যেই নিহিত আছে সকল ব্যক্তির স্বাধীন বিকাশ।

২) সমকালীন গণতন্ত্র : 

ডেভিড হেল্ড চার ধরনের সমকালীন গণতন্ত্রের কথা বলেছেন। এগুলি হল-

ক) অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র: এই মডেল অনুযায়ী সমাজের কতকগুলি প্রধান প্রতিষ্ঠান বর্তমান। এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানে নাগরিকদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ আবশ্যক। যেমন- স্থানীয় শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ ও বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ। এ ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল- নারীজাতির অধিকার ও অংশগ্রহণ সুনিশ্চিতকরণ ; আমলাতন্ত্রের কর্তৃত্ব হ্রাস। রাজনীতিক দলব্যবস্থার পুনর্গঠন, রাজনীতিক দল ও দলের সদস্যদের মধ্যে দায়িত্ববোধের উন্মেষ, সংবাদ ও তথ্যাদির স্বাধীনভাবে প্রকাশনার ব্যবস্থা, জনসাধারণের স্বার্থে ভূমিকা পালন; হত-দরিদ্র মানুষজনের স্বার্থ সংরক্ষণ প্রভৃতি। বলা হয় যে, সরকারী কাজে সরাসরি অংশগ্রহণের মাধ্যমে নাগরিকদের সরকারি কাজে আগ্রহ, আন্তরিকতা ও অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পাবে।

খ) প্রতিযোগিতামূলক এলিটবাদী গণতন্ত্র: সাম্প্রতিককালের সমাজ হল শিল্প- সমাজ। আধুনিক কালের এই শিল্প সমাজই হল প্রতিযোগিতামূলক এলিটবাদী গণতন্ত্রের ক্ষেত্র। এ ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কতকগুলি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। এগুলি হল- সংসদীয় গণতন্ত্র, সূদৃঢ় শাসন বিভাগ, কেন্দ্রীভূত নেতৃত্ব প্রভৃতি। এখানে নেতৃত্বের অধিকা অস্বীকৃত। নেতৃত্বে থাকেন প্রভাবশালী ব্যক্তি। তিনি দক্ষ, উদ্যোগী ও অনুপণিত। 

গ) আইনমূলক গণতন্ত্র: আইনমূলক গণতন্ত্রেরও কতকগুলি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এগুলি হল- আইনের অনুশাসন, উন্মুক্ত বাজার অর্থনীতি, শাসনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, ব্যক্তিমানুষের ও সমষ্টির কাজকর্মের স্বাধীনতা, এই স্বাধীনতায় রাষ্ট্রের ন্যূনতম হস্তক্ষেপ প্রভৃতি। এখানে আইনের অনুশাসনের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। বলা হয় যে, আইনের অনুশাসনের ভিত্তিতেই সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন কায়েম হবে এবং প্রতিষ্ঠিত হবে নাগরিকদের রাজনীতিক ও আর্থিক স্বাধীনতা।

ঘ) বহুত্ববাদী গণতন্ত্র: বহুত্ববাদী গণতন্ত্র হল উদারনীতিবাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার রকমফের। এ ধরনের গণতান্ত্রিক মডেলে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থার বিবিধ বৈশিষ্ট্য বর্তমান। এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল- নির্দিষ্ট সময় অন্তর নিয়মিত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা বহু ও বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর অস্তিত্ব এবং স্বার্থগোষ্ঠীসমূহের প্রভাব-প্রতিপত্তি; নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের নীতি অনুসরণ সংখ্যালঘু গোষ্ঠীসমূহের স্বাধীনতার স্বীকৃতি প্রভৃতি।

আরো পড়ুন

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কাকে বলে | আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য

রামমোহন রায়ের উদারনীতিক ভাবনার বৈশিষ্ট্য গুলি লেখো

ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকার | Fundamental Rights of Indian Constitution

ভারতের অধস্তন আদালতের কার্যাবলী | Functions of Subordinate Courts in India

সমাজ কাকে বলে | What is Society in Bengali

সামাজিক পরিবর্তন কি | সামাজিক পরিবর্তনের বৈশিষ্ট্য | Meaning and Characteristics of Social Change

সমাজবিজ্ঞান | Sociology শব্দের অর্থ | সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা | সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি

Leave a Comment

error: Content is protected !!