নাট্যকার বাদল সরকার | বাংলা নাট্য সাহিত্যে বাদল সরকারের অবদান
উত্তর:
নাট্যকার বাদল সরকার
বাদল সরকার বর্তমান সময়ের এক বিশিষ্ট নাট্যকার। তার প্রকৃত নাম সুধীন্দ্র সরকার। ভিন্ন রীতির নতুন ধারায় নাট্য রচনার ক্ষেত্রে বাদল সরকার বাংলা নাটকের ইতিহাসে স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। এছাড়া বিদেশী নাটকের আদর্শে বাদল সরকারের নাট্যচিন্তা ও নাট্য রূপায়ণ যে বাংলা নাট্য সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
তাঁর রচিত বিশিষ্ট নাটকগুলি হল – ‘বড়ো পিসীমা’ (১৯৫৮), ‘শনিবার’ (১৯৫৯), ‘’এবং ইন্দ্রজিৎ’ (১৯৬৫), ‘পাগলা ঘোড়া’ (১৯৬৭), ‘বাকি ইতিহাস’ (১৯৬৭), ‘সারা রাত্তির’ (১৯৬১), ‘কবিকাহিনী’ (১৯৭০), ‘মিছিল’ (১৯৭৪), ‘ভোমা’ (১৯৭৬) ইত্যাদি। তাঁর অধিকাংশ নাটক বিভিন্ন ভারতীয় ও ইংরেজী ইত্যাদি ভাষায় অনুদিত হয়েছে।
তার রচিত বিশেষ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাটক নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১) ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ নাটকটি অ্যাবসার্ড নাটকের আবহে সৃষ্টি। বাদল সরকারকে এই নাটক রচনায় উৎসাহিত করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি, ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মোহভঙ্গজনিত বিষাদ ও সেইমতে ব্যাপক গণহত্যা ও কপট রাজনীতির প্রতি বিতৃষ্ণা। প্রথাসিদ্ধ নাটকের মতো এই নাটকের কোনো কাহিনি নেই। রয়েছে কয়েকটি চরিত্র- অমল, বিমল কমল, লেখক এবং ইন্দ্রজিৎ। সেইসঙ্গে রয়েছে দুজন নারী চরিত্র— মাসীমা ও মানসী। প্রত্যেকটি চরিত্রের মধ্যে রয়েছে স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের প্রকাশ। নাটকের এইসব চরিত্রের মুখের সংলাপে রয়েছে অসংগতি। বিভিন্ন মুদ্রা ও মূকাভিনয়ের মাধ্যমে চরিত্রের বিভিন্নভাব সংকেতিত হয়েছে। সঙ্গতি, সামঞ্জস্য ও অর্থময়তার বিরুদ্ধে যেহেতু অ্যাবসার্ড জীবনদর্শন গড়ে উঠে তাই ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ নাটকে লেখক ইন্দ্রজিৎ চরিত্রের মাধ্যমে সেই শূন্যতা ও হতাশারূপ জীবনদর্শনের রূপ উপস্থাপিত হয়েছে।
২) ‘বাকি ইতিহাস’-এর কাহিনি দুটি। খবরের কাগজে একটি আত্মহত্যার কাহিনি অবলম্বনে প্রথম অর্ধে বাসন্তী এবং দ্বিতীয় অর্ধে শরদিন্দু দুটি নাটক রচনা করেছে। শরদিন ও বাসন্তী সুখী দম্পতি। এক ছুটির দিনে খবরের কাগজে জনৈক সীতানাথের আত্মহতার কাহিনি পাঠ করে শরদিন্দু ও বাসন্তী যে যার মতন দুটি গল্প অনুমান করে। সেই গল্পের স্বামী-স্ত্রী সীতানাথ ও কণা। এই আত্মহত্যার মূল কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বাসন্তী একজন মেয়ের মতোই ঘটনাকে বিশ্লেষণ করেছে। আবার শরদিন্দুর উক্ত ঘটনার কারণ বিশ্লেষণে প্রতিফলিত হয়েছে পুরুষসুলভ মানসিকতার সূত্র যা আত্মহত্যার বিকৃত মানসিকতার ইঙ্গিত বহন করে।
৩) বাদল সরকারের ‘পাগলা ঘোড়া’ আর একটি উল্লেখযোগ্য নাটক। ‘পাগলা ঘোড়া’ নাটকে রয়েছে সাংকেতিকতা। কেননা ‘পাগলা ঘোড়া’ হল প্রবল প্রদীপ্ত প্রেমের প্রতীক। প্রত্যেক মানুষের হৃদয়ে এই পাগলা ঘোড়ার জন্য থাকে গভীর প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু এই আকাঙ্ক্ষার যথাযথ রূপায়ণ সম্বন্ধে দ্বিধা থেকে যায়। তাই পাগলা ঘোড়া যখন হাজির হয় তাকে বরণ করে নেবার অক্ষমতা প্রকট হয়ে ওঠে। সেই অক্ষমতার প্রকাশ দেখিয়েছে শশী, হিমাদ্রী, সাতু ও কার্তিক। এরা একরাত্রে শ্মশানে নিয়ে এসেছে এক অনাত্মীয়া তরুণীর মৃতদেহ সৎকারের জন্য। মৃতদেহটি যখন চিতায় জ্বলছে তখন এই চারটি যুবক মদ্যপানের নেশায় তাদের অক্ষমতার গল্প বিবৃত করে গেছে। নাটকটি বিষাদে ভরা হলেও এর পরিণতি আশাব্যঞ্জক।
৪) “ভোমা’ হল দেহাতি, দেশজ এবং মাটির মানুষ নিয়ে লেখা। ভোমা চরিত্রটি প্রতীকী— ‘এই ভারতবর্ষের বিচিত্র অর্থনীতির পাকে ও শোষণে রিক্ত নিঃস্ব গ্রামীন মানুষের গোটা চেহারাটা তার মধ্যে আভাসিত।’ ক্ষুধার্ত যন্ত্রণাকাতর মানুষের আর্তনাদ শোনা যায় ‘ভোমা’য়। ‘মিছিল’ নাটক মৃত্যুর মিছিল, জীবনের মিছিল, প্রতিবাদের মিছিল। ক্রোধে ক্ষোভে দুঃখযন্ত্রণা নিয়েই মানুষের মিছিল যাতে শেষ পর্যন্ত শোনা যায়। আশার গান, ভবিষ্যতের গান- তা হয় স্বপ্নের মিছিল।
বাদল সরকারের নাটকের বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ করা যায় –
প্রথমত, তিনি বাংলায় তৃতীয় ধারার নাট্যরীতির বিশিষ্ট প্রবক্তা। থার্ড থিয়েটাররূপে অভিহিত টিকিট বিক্রীর শর্ত নেই, যা প্রথামুক্ত, যা হতশ্রী দরিদ্র অসহায় ক্ষুধাকাতর যন্ত্রণাবিদ্ধ মানুষের কথা বলে। এছাড়া এতে খরচ কম, তা সহজে বহনযোগ্য এবং বিভিন্ন উপকরণ বা বিন্যাসের উপাদান (prop) বাদ দিয়ে শরীরী ক্রিয়ায় ও বিন্যাসে মঞ্চ নির্মাণ করে।
দ্বিতীয়ত, বাদল সরকার absurd রীতির অন্যতম প্রবক্তা বাটা জীবনের অবক্ষয় ও ক্লান্তি, মৃত্যুচেতনা, শূন্যতার বোধ তাঁর অনেক নাটকেই আছে।
তৃতীয়ত, স্বদেশ ও সমাজকে তিনি পরিহার করেন নি, ‘মিছিল’, ‘ভোমা’ ইত্যাদি নাটক প্রখর ও প্রবলভাবে শোষিত অত্যাচারিত নিম্নবর্গের মানুষের কথা বলে।
চতুর্থত, বাদল সরকারের নাটকের ভাষা অত্যন্ত আকর্ষণীয়, কখনও কাব্যিকতা তার মধ্যে নিবিড় ছায়া ফেলেছে।
অর্ধশতাব্দীরও অধিককাল নাট্যচর্চায় ব্যাপৃত বাদল সরকার একদিকে গেয়েছেন নিন্দাবাদ, অন্যদিকে অর্জন করেছেন বিপুল মহিমা ও মর্যাদা। সারা ভারতবর্ষেই সমাদৃত হয়েছেন বহুমুখী প্রতিভা সম্পন্ন বাদল সরকার। তিনি নাটকের সঙ্গে সঙ্গে কাব্যসৃজনে, চিত্রাঙ্কনে এবং কোলাজ নির্মাণে দক্ষ। নাট্যকর্মের জন্য তিনি পেয়েছেন ‘সঙ্গীত নাটক অ্যাকাদেমি পুরস্কার’ (১৯৬৮) ও ‘পদ্মশ্রী’ (১৯৬৯)।
আরো পড়ুন
বাংলা শিশু সাহিত্যের ইতিহাসে দক্ষিণারঞ্জণ মিত্র মজুমদারের অবদান
বাংলা কাব্য সাহিত্যে বিহারীলাল চক্রবর্তীর অবদান
বাংলা নাট্য সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো
বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে শ্রীরামপুর মিশনের অবদান আলোচনা করো
বাংলা নাট্য সাহিত্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদান আলোচনা করো
বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবদান
বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করো
বাংলা নাট্য সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো