শাক্ত পদাবলী সাহিত্যে রাম প্রসাদ সেনের কবি প্রতিভা আলোচনা কর

Q: শাক্ত পদাবলী সাহিত্যে রাম প্রসাদ সেনের কবি প্রতিভা আলোচনা কর
Q: ভক্তের আকুতি বিষয়ক পদ রচনায় কবি রামপ্রসাদের কাব্য প্রতিভা নিরূপণ করো।

উত্তর:

শাক্ত পদাবলী সাহিত্যে রাম প্রসাদ সেনের কবি প্রতিভা

বাংলার শাক্তধর্মে এবং শাক্তসাহিত্যে এক নতুন দিক খুলে দিয়েছিলেন সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন। তিনি মূলত ছিলেন সাধক কবি আধ্যাত্ম চেতনার সুরটি তিনি তার পদে ফুটিয়ে তুলেছেন। কাব্যের প্রসাদগুণের মানদন্ডে ও হৃদয় আবেগের গভীর গারো উচ্চারণে রামপ্রসাদ চন্ডীদাস এর মতই সার্থক ভক্ত কবি। তার রচিত শ্যামা সঙ্গীতে একদিকে যেমন মায়ের মহিমা প্রকাশ করেছেন তেমনি মায়ের জন্য সন্তানের আর্তিকে ভাষা ও সুর দিয়ে এমন করে প্রকাশ করেছেন যা তার আগে কোন কবি তা রচনা করেনি। মধ্যযুগীয় দেবদেবীনির্ভর বদ্ধ জলাশয় এর বুকে তার সহজ হৃদয়ের উৎসারিত সংগীত গুলি নতুন প্রাণ ও আবেগ সৃষ্টি করেছিল। এই সঞ্চারিত সঞ্জীবনী ধারাই রামপ্রসাদী গান নামে পরিচিত।

কবি পরিচয় :

চব্বিশ পরগণা জেলার হালিশহর মহকুমার কুমারহট্ট গ্রামের সেন বংশে ১৭২০-২১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহন করেন। পিতা রামরাম সেন এবং মাতা সিদ্ধেশ্বরী। আঠারো বছর বয়সে তাঁর হৃদয়ে সাধন বীজ অঙ্কুরিত হয়। বাইশ বছর বয়সে রামপ্রসাদের বিবাহ দেওয়া হয়। বিবাহের পর কুলগুরু মাধবাচার্যকে আনিয়ে রামরাম পুত্র ও পুত্রবধূর দীক্ষাকার্য সমাপ্ত করেন। পিতার মৃত্যুর পর রামপ্রসাদকে সংসার কার্যে মনোনিবেশ করতে হয়। মা সিদ্ধেশ্বরী ও স্ত্রী সর্বাণী সংসারের উন্নতির জন্য রামপ্রসাদকে নানাভাবে সহায়তা করতে থাকলেন। ইতিমধ্যে রামপ্রসাদের পরমেশ্বরী ও জগদীশ্বরী নামে দুই কন্যা ও রামদুলাল নামে এক পুত্র জন্মগ্রহণ করেছে। পরবর্তীকালে তাঁর রামমোহন নামে আর একটি পুত্র জন্মগ্রহণ করেছিল। মায়ের মৃত্যুর পর রামপ্রসাদের সংসারে অভাব ক্রমশ বেড়ে চলে। কলকাতায় এসে তিনি দুর্গাচরণ মিত্রের কাছে মুহুরীগিরির কাজ করতে থাকেন। পরবর্তীতে নদীয়ার অধিপতি কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে সভাসদ হিসাবে নিযুক্ত করেন। কৃষ্ণচন্দ্র রামপ্রসাদকে একশত বিঘা নিষ্কর ভূমি দান করেন এবং ‘কবিরঞ্জন’ উপাধি প্রদান করেন।

‘ভক্তের আকুতি’ বিষয়ক পদ রচনা :

‘আকুতি’ শব্দের অর্থ হলো ইচ্ছা। ভক্তের আকুতি পর্যায়ের পদে ভক্তের একান্ত ইচ্ছা প্রকাশিত হয়েছে। ভক্তের আকুতি পর্যায়ের পদের সৃষ্টিকর্তা রামপ্রসাদ এবং এই পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি রামপ্রসাদ-ই। আসলে অষ্টাদশ শতকের মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত দরিদ্র মানুষ যেখানে জীবনের প্রত্যহিক দুঃখ-কষ্টের জালে ক্রমশ জড়িয়ে পড়েছে সেই সংকীর্ণ মায়া পাশ বদ্ধ-কষ্ট কর দিন যাপনের দুঃখই ভক্তের আকুতি পর্যায়ের পদে পরিস্ফুটিত হয়েছে। ভক্তের আন্তরিক ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা অভিব্যক্ত হয়েছে ভক্তের আকুতি পর্যায়ের পদে।

সাংসারিক সুখ দুঃখ নয় মায়ের চরণের আকাঙ্খাই হল ভক্তের একান্ত অভিলাষ। জগৎ ও জীবন থেকে মুক্তি চান না। ভক্ত মায়ের রাঙাচরণ সেবা করে দিনপাত করতে চান তিনি। বিশ্ব জননীকে মায়ের স্থানে বসিয়ে কবি নিজেকে ভক্তের আসনে রেখে জগজ্জননীর আরাধনা করেছেন। তাইতো রামপ্রসাদ লিখেছেন –

“দুর্গা দুর্গা দুর্গা বলে তরে গেল পাপী কত।
একবার খুলে দে মা চোখের ঠুলি, দেখি শ্রীপদ মনের মত।।”

সংসার কারাগারে বন্দী জীবের তীব্র আর্তনাদ শোনা গেছে ভক্তের আকৃতি পর্যায়ের পদে। এই পর্যায়ের পদে যেমন একদিকে আছে সংসারে বদ্ধ জীবের অনুশোচন অন্যদিকে তেমনি আবার আছে সমসাময়িক জীবন যন্ত্রণা৷ সামাজিক বৈষম্য ও দুঃখে শাক্ত পদকর্তারা ক্ষতবিক্ষত তথাপি তারা দুঃখকে জয় করার আপ্রাণ প্ৰয়াস চালিয়েছেন। রামপ্রসাদ লিখেছেন-

“আমি কি দুঃখের ডরাই?
দুঃখে দুঃখে জন্ম গেল, আর কত দুঃখ দাও দেখি তাই।”

– বদ্ধ জীবের ভয়াবহ চিত্র রামপ্রসাদের পদে যথার্থই প্রতিফলিত হয়েছে। সংসার জ্বালায় জর্জরিত কবি মাতৃ চারণ কে আশ্রয় করে মুক্তির রাস্তা খুঁজে বেরিয়েছেন।

স্থূল সংসার জীবনে তিনি বাধা পড়তে চাননি, তাইতো সংসার জ্বালায় জর্জরিত হয়ে কবি মায়ের কাছে অনুযোগ করেছেন — “ভবের খেলায় যা হবার তাই হলো। এখন সন্ধ্যাবেলায় কোলের ছেলে, ঘরে নিয়ে চলো।।”

→ মায়ায় বদ্ধ জীবের ভয়াবহ অবস্থা এবং তার থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা কবি ভক্তের আকুতি বিষয়ক পদে ব্যক্ত করেছেন। আসক্তি থেকে মুক্তির জন্য কবি আধ্যাত্মিক সাধনায় মগ্ন হয়েছেন বটে কিন্তু কবির সাধনা প্রতিমুহূর্তে ষড়ঋতু ও পঞ্চ ইন্দ্রের দ্বারা ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। ভবসংসারের ভোগ বাসনায় মত্ত হয়ে কাঙ্ক্ষিত বিষয়ের থেকে বিস্তৃত হয়েছেন। কবি ভোগ বাসনায় মত্ত হয়ে মিঠার লোভে ভিতমুখেই জীবন কাটিয়েছেন। তাইতো কবি বলেছেন-

“মা নিম খাওয়ালে চিনি বলে, কথায় করে ছলো।
ওমা, মিঠার লোভে, তিতমুখে সারাদিনটা গেল” —

উক্ত পদটির মধ্যে কবি নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করেছেন অনিত্য বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নিত্য বস্তুকে কবি হারিয়েছেন।

→ বিচারপতি ঘুষ খাচ্ছেন টাকার জোরে দোষীরা ছাড়া পাচ্ছেন নির্দোষীরা শাস্তি পাচ্ছে। কৃষ্ণচন্দ্রের আর ক্ষমতা নেই যে কবিকে রক্ষা করে। মহামায়ের ষড়যন্ত্রে রাজা নিঃস্ব ও সর্বশ্রান্ত তাই তো কবি মায়ের শ্রীচরণে আশ্রয় চান। অথচ সেই জায়গা দখল করে বসে আছেন মহাদেব—

“মা গো তারা ও শংকরী কোন অবিচারে জারি?”
আমার পরে করলে দুঃখের ডিক্রী”।।

উক্ত পদটির মধ্য দিয়ে তৎকালীন সমাজ চিত্র খুব সুন্দরভাবে কবি পরিস্ফুটিত করেছেন।

→ এই দুঃখ যন্ত্রণাময় জীবন থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করতে ভক্ত কবি তার পদে নানা রূপক ও চিত্রকল্পের প্রয়োগ করেছেন। যেমন—“ ভবের আশা খেলব পাশা” এই পদটিতে কবি ভবসাগর থেকে মুক্তি পাবার সাধনাকে পাশা খেলার রূপকে ব্যক্ত করেছেন। আবার “কলুর চোখ ঢাকা বলদের মতো”- এই উপমাটি ব্যবহার করে কবি দুঃখ যন্ত্রণাময় জীবনের কথা ব্যক্ত করেছেন

অন্যান্য পদরচনা :

– বাল্যলীলা বিষয়ক পদ রচনাতে রামপ্রসাদ যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছেন এই পর্যায়ে তার একটি স্মরণীয় পদ উল্লেখ করছি-

“গিরিবর আর আমি পারিনি হে প্রবোধ দিতে উমারে ওমা কেঁদে করে অভিমান 
নাহি করে স্তন পান নাহি থায় ক্ষীর ননী সরে”।।

জগৎ জননীর লীলামাধুর্য রামপ্রসাদের আলোচ্য বাল্যলীলা পর্যায়ের পদে সহজ ও সরল ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে।

→ রামপ্রসাদ সেন রচিত আগমনী পর্যায়ের পদগুলি যথেষ্ট কাব্য উতকর্ষ লাভ করেছে। তার রচিত এই পর্যায়ের পদে বাঙালি মায়ের চিরকালীন আকুতি প্রকাশিত হয়েছে।

গিরি এবার আমার উমা এলে, আর ওমা পাঠাবো না।
বলে বলবে লোকে মন্দ, কারো কথা শুনবো না”

বাঙালি মাতৃ হৃদয়ের চিরকালীন স্নেহমতা দুঃখ বেদনা এই পদটিতে ব্যক্ত হয়েছে। এ যেন ১৮ শতকের সমাজ জীবন থেকে উঠে এসেছে মাতৃহৃদয়ের এক অন্তর বেদনা।

→ মা মেনকার কাছে উমা ভোরবেলা এসে পৌঁছান। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর মা মেয়ের মিলন ঘটে, তাইতো রামপ্রসাদ লিখেছেন – “আজ শুভনিশি পোহাইল তোমার। এই যে নন্দিনী আইল, বরণ করিয়া আন ঘরে।”

– আলোচ্য পদটিতে বিরহ কাতর জননীর সহিত স্নেহের দুলালী কন্যার মিলন দৃশ্যে মাতৃহৃদয়ের আনন্দ বেদনা ও অতি সূক্ষ্ম মনোভাব অতি নিপুণতার সহিত চিত্রিত হয়েছে। 

→ বিজয়া বিষয়ক পদে মা মেনোকা কে ছেড়ে উমা চলে যাবে পতিগৃহে। সেজন্য মেনকার অন্তরে সীমাহীন ব্যাকুলতা সেই ব্যাকুলতার কথা ব্যক্ত করেছেন রামপ্রসাদ।

“ওহে প্রাণনাথ গিরিবর হে, ভয়ে তনু কাঁপছে।
আমার কি শুনি দারুণ কথা, দিবসে আঁধার।।”
সপ্তমী অষ্টমী নবমী কেটে গেছে উমা ফিরে যাবে

পথিগৃহে মেনোকার পা কাঁপছে বুক টলছে উমাকে চলে যেতেই হবে পতি গৃহে। বিধাতার কি বিরম্বনা কন্যাকে কাছে রাখতে চায় কিন্তু পারেনা। মাতৃ হৃদয়ের এই ট্রাজেডিটি রামপ্রসাদ তার বিজয়া বিষয়ক পদে খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। 

রামপ্রসাদ ১৮ শতকের শ্রেষ্ঠ শাক্ত পদাবলীর রচয়িতা। আগমনী, বিজয়া, ভক্তের আকুতি ও বাল্যলীলা শাক্ত বিষয়ক প্রত্যেকটি বিষয়ে তিনি পদ রচনা করেছেন যার কারনে শাক্ত পদাবলীর রচয়িতা হিসেবে তিনি শ্রেষ্ঠত্বের অধিকার অর্জন করেছেন। 

পরিশেষে রামপ্রসাদ সেনের কাব্য প্রতিভা হিসাবে আমরা বলতে পারি –

এক. রামপ্রসাদ সেন ছিলেন ১৮ শতকের মধ্যবিত্তের যথার্থ প্রতিনিধি তার শাক্তপদাবলীতে তৎকালীন সময়ের দুঃখ জর্জরিত সাধারণ মানুষের জীবন কাহিনী ফুটে উঠেছে। 

দুই. তার রচনার মধ্যে রয়েছে গীতিময়তা ও নাটকীয়তায় পূর্ণ যার কারণে তিনি পাঠকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। 

তিন. ছন্দ অলংকার রচনায় তিনি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। এবং অলংকার, রূপক, উপমা, চিত্রকল্প এবং বাগধারার প্রয়োগে তিনি লোকজীবনের একেবারে কাছে নেমে এসেছেন৷ ৷

চার. রামপ্রসাদের রচিত পদগুলির ভাষা সহজ ও সরল অথচ তেজস্বীয়তা ও ভক্তি রসে পরিপূর্ণ এই কারণেই তার পদাবলী সকলের প্রিয় হয়ে উঠেছে। 

পাঁচ. সাধকত্ব ও কবিত্বের সম্মেলনে রামপ্রসাদের পদগুলি যেন আরো উৎকর্ষ হয়ে উঠেছে। এছাড়া তার কাব্যে আধ্যাত্মিকতা ও বাস্তব জীবনের এক সুন্দর মিলবন্ধন ঘটিয়েছে।

আরো পড়ুন

বাংলা নাট্য সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো

বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে শ্রীরামপুর মিশনের অবদান আলোচনা করো

বাংলা নাট্য সাহিত্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদান আলোচনা করো

বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবদান

বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করো

বাংলা নাট্য সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো

Leave a Comment

error: Content is protected !!