বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করো।
অথবা, বাংলা গদ্য সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করো ।
উত্তর:
ভূমিকা:
উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার মাটিতে যে সমস্ত মহামানবদের আবির্ভাব ঘটেছিল তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বাংলা গদ্য সাহিত্য বিকাশে বিদ্যাসাগরের অবদান অবিস্মরণীয়। বিদ্যাসাগরের হাতেই সাহিত্যিক গদ্যের জন্ম। বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যকে দিয়েছেন স্বাতন্ত্র্য ও আভিজাত্য। তিনি বাংলা গদ্যের একটি রাজপথ তৈরি করে দিয়েছিলেন। সেই পথে পরবর্তীকালে বহুপদাতিকের আগমন হয়েছে। অ্যাডিশন ইংরেজি সাহিত্যের গদ্যের যা করেছেন বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্য সাহিত্যের জন্য সেই কাজ করেছেন রবীন্দ্রনাথের কথায়— “বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন”।
গদ্য সাহিত্য বিকাশে বিদ্যাসাগরের রচনাবলি বিষয়ভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ করে আলােচনা করা হলাে—
ক. অনুবাদ মূলক রচনা:
১. বেতাল পচ্চীসী থেকে – বেতাল পঞ্চবিংশতি (১৮৪৭)
২. অভিজ্ঞানম শকুন্তলম থেকে – শকুন্তলা (১৮৫৪)
৩. ভবভূতীর উত্তরচরিত এবং বাল্মিকী রামায়ণ থেকে সীতার বনবাস(১৮৬০)
৪. শেক্সপিয়রের কমেডি অফ এররস থেকে ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬৯)
৫. মার্শম্যানের History of Bengal থেকে বাংলার ইতিহাস (১৮৪৮)
৬. ঈশপের ফেবলস থেকে কথামালা (১৮৫৬)
৭. চেম্বারে Biographies এবং Rudiments of Knowledge থেকে জীবনচরিত (১৮৪৯)
খ. সমাজ সংস্কারমূলক রচনা:
১. বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৫)
২. বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার (১৮৭১/১৮৭৩)
– এই সমস্ত পুস্তকগুলােতে তার অভ্রান্ত যুক্তি তথ্যের সমাহার এবং বিশ্লেষণে যথার্থ গদ্য প্রতিভার প্রমাণ দিয়েছেন।
গ. লঘু রচনা:
১. অতি অল্প হইল (১৮৭৩)
২.আবার অতি অল্প হইল (১৮৭৩)
এই দুটি পুস্তকে ভাষার মধ্যে শ্রেষ্ঠ তীর্যক দৃষ্টিভঙ্গি বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
৩. ব্রজবিলাস (১৮৮৬)
৪. রত্নপরীক্ষা (১৮৮৬) (কম্মিদ উপযুক্ত ভাইপােস্য ছদ্মনামে লেখেন)
– এইসব রচনায় রঙ্গপ্রিয় বিদ্যাসাগরের উপস্থিতি চোখে পড়ে।
ঘ. মৌলিক রচনা:
১. প্রভাবতী সম্ভাষণ (১৮৯১) – বন্ধু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যার মৃত্যুতে রচিত। এটি বাংলা গদ্যে লিখিত প্রথম শােক গ্রন্থ।
২. বর্ণপরিচয় (১৮৫৫) – শিশু শিক্ষার ভিত্তি প্রস্তুত করতে এবং শিশু মনস্তত্ত্ব অনুযায়ী তাদের পঠন-পাঠনের উপযােগী পাঠ্যপুস্তক রচনার প্রয়াসে এইগ্রন্থ রচিত।
—— যেনতেন প্রকরণে বক্তব্যকে প্রকাশ করাই সাহিত্যের উদ্দেশ্য নয়, তারমধ্যে লালিত্য, মাধুর্য, সৌন্দর্যের উৎসারণ আছে। এমন ভাব ঘন ব্যঞ্জনাঢ্য ভাষার প্রয়ােগ বিদ্যাসাগরের এই সমস্ত রচনাবলীর মধ্যে সুন্দর ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে বিদ্যাসাগরের অবদান
অ. ধ্বনি ঝংকার অনুসরণ করে উপযুক্ত স্থানে যতি চিহ্ন স্থাপন করে বাক্যাংশ গুলিকে সাজিয়ে তিনি প্রথম গদ্য ছন্দ কে আবিষ্কার করেছিলেন।
আ. বিদ্যাসাগরের ভাষা স্বচ্ছ ও প্রাঞ্জল সন্ধিযুক্ত ও সমাসবদ্ধ শব্দ ও পদ থাকলেও তা গতিকে ব্যাহত করে না বরং ভাষা আরাে গতিময় হয়ে ওঠে।
ই. বাংলা ক্লজ এবং ফ্রেজ বাক্যাংশ প্রয়ােগ করে ভাষার ব্যবহারযােগ্যতা সম্পাদন করেছেন তিনি।
ঈ. কমা সেমিকোলন এর ব্যবহার বিদ্যাসাগরই প্রথম যথার্থ অধিকারীর ঢংএ করতে পেরেছিলেন।
উ. গদ্যকে উপ বাক্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করে, বাক্যকে ভাব অনুসারে ধ্বনি সামঞ্জস্যে ছন্দ স্রোত এনে, বাক্যে গতির পূর্ণতার মাধ্যমে, বাংলা গদ্যের সম্পূর্ণতা এনে দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর।
ঊ. গদ্যের নানা বৈচিত্র্য যেমন- বিবৃতিমূলক গদ্য, আবেগ মূলক গদ্য, বিতর্কমূলক ভাষা,লঘু ধরনের সংলাপ, স্মৃতিচারণ মূলক রচনা, প্রভৃতি তার গদ্যের ভিত্তিকে আরাে সুপ্রতিষ্ঠা করেছে।
এইভাবে পর্যালােচনা করে ব্যাপক অর্থে বিদ্যাসাগরকে নিসংশয়ে বাংলা গদ্যের প্রথম সার্থক স্রষ্টার মর্যাদা দেওয়া যায়। আসলে মধ্যযুগের শেষ ভাগেই গদ্যের অস্পষ্ট আবির্ভাব ঘটে, ফোর্টউলিয়াম কলেজ এর পন্ডিতরা তাদের সীমাবদ্ধ সামর্থে তাকে যথার্থ রূপদান করতে প্রয়াসী হন। রামমােহন তাকে দৃঢ় অবয়ব দান করে। অক্ষয় কুমার দত্তের হাতে সেই ভাষা আরাে মার্জিত হয়ে ওঠে এবং বাংলা গদ্য ভাষাকে প্রথম শিল্প ও সাহিত্য গুণান্বিত করে তােলেন বিদ্যাসাগর, সেই অর্থে বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের জনক, প্রথম মহৎ স্রষ্টা রূপে অভিহিত করা যায়।
আরো পড়ুন
বাংলা কাব্য সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান
বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে শ্রীরামপুর মিশনের অবদান আলোচনা করো
বাংলা নাট্য সাহিত্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদান আলোচনা করো
বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবদান
বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করো
বাংলা নাট্য সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো