প্রকৃতিবাদ কাকে বলে | শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকৃতিবাদী দর্শনের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করো

প্রকৃতিবাদ কাকে বলে | শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকৃতিবাদী দর্শনের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করো

উত্তর:

প্রকৃতিবাদ (Naturalism)

প্রকৃতিবাদী দর্শনকে ভাববাদী দর্শনের ঠিক বিপরীত বলে মনে করা হয়। প্রকৃতিবাদী দার্শনিকদের মতে প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতি হল বাস্তব আর সবই মিথ্যা। প্রকৃতিবাদী দার্শনিকরা সবকিছুকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করেন। তাদের মতে বাস্তব জগতের বাইরে কিছুই নেই, মানুষ হল এই বাস্তব জগতের অংশবিশেষ। দার্শনিক Rusk বলেছেন, “Naturalism is a philosophical position adopted by those who approach philosophy from purely scientific point of view”। প্রকৃতিবাদের প্রবক্তা হলেন- অ্যারিস্টোটল, হারবার্ট স্পেনসার, ডারউইন, ফ্রয়েবেল, পেস্তালৎসী, লক, হবস, মাক্স, রুশাে।

প্রকৃতিবাদের প্রধান সূত্র 

1. দৃশ্যমান জগৎই সত্য, আর সবকিছুই মিথ্যা। মন বা আত্মার কোন অস্তিত্ব নেই, জড় বস্তুই প্রকৃত বাস্তব। প্রকৃতিবাদ আধ্যাত্মিকতা চরম বিরােধী। তারা সত্য শিব সুন্দরকে বিশ্বাস করেন না। 

2. প্রকৃতিবাদীদের মতে প্রাকৃতিক কোন ঘটনা আকস্মিকভাবে ঘটে না। বিশ্ব প্রকৃতি কঠোর শৃঙ্খলা মেনে চলে। 

3. বিশ্বের সব কিছুকে প্রকৃতিবাদীরা জড়বস্তু, শক্তি ও গতি দিয়ে বিচার করেন। তারা জগতের সব কিছুকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করেন। 

4. প্রাকৃতিক সকল ঘটনা সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী ঘটে। মানুষ এই প্রকৃতিরই একটি অংশ। সুতরাং প্রাকৃতিক নিয়মে মানবজীবনের রীতিনীতি নিয়ন্ত্রণ হয়ে থাকে মানুষের সামর্থ্য বা ইচ্ছাশক্তি প্রাকৃতিক নিয়মের কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। 

5. প্রকৃতিবাদীদের মতে মানসিক সুখের থেকে দৈহিক সুখী অধিকতর কাম্য। তারা মনে করেন সুখই জীবনের কাম্য বস্তু। যে কাজ সুখদায়ক সেই কাজ ভালাে, যে কাজ দুঃখদায়ক সেই কাজ মন্দ।

6. সমাজের সবকিছুই কৃত্রিম। তাই প্রকৃতিবাদীদের নির্দেশ হল – ‘প্রকৃতির মধ্যে ফিরে যাও’ (Go back to nature) রুশো বলেছেন – ‘God makes all things good man meddles with them and they become evil’. ঈশ্বর সব কিছুকে সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন, মানুষ সেগুলিকে খারাপ করছে ।

প্রকৃতিবাদের শ্রেণীবিভাগ

প্রকৃতিবাদের প্রবক্তারা প্রকৃতিবাদের মতামতগুলিকে মােটামুটি ভাবে পাঁচটি শ্রেণীতে বিশ্লেষণ করেছেন। সেগুলি হল – i) জড় প্রকৃতিবাদ (Physical Naturalism) ii) জৈবিক প্রকৃতিবাদ (Biological Naturalism) iii) যান্ত্রিক প্রকৃতিবাদ (Mechanical Naturalism) iv) মনােবৈজ্ঞানিক প্রকৃতিবাদ (Psychological Naturalism) v) কল্পনাপ্রবণ প্রকৃতিবাদ (Romantic Naturalism)

i) জড় প্রকৃতিবাদ (Physical Naturalism): একদল দার্শনিক জড়প্রকৃতির উপর ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করেছেন। তাদের মতে জীবন জড় প্রকৃতির নিয়মে পরিচালিত হয়। মানুষের জীবনও অন্যান্য জড় বস্তুর মত প্রাকৃতিক নিয়মে পরিচালিত হয়। সেজন্য প্রাকৃতিক নিয়ম ভালােভাবে মেনে চলার জন্য মানুষের শিক্ষার প্রয়োজন।

ii) জৈবিক প্রকৃতিবাদ (Biological Naturalism): ইতর প্রাণী থেকে ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের সৃষ্টি হয়েছে। ইতর প্রাণীর মতাে মানুষের মধ্যেও আবেগ, প্রবৃত্তি ও ভীতি রয়েছে। এই পরিবর্তনশীল পরিবেশে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শিক্ষার প্রয়োজন।

iii) যান্ত্রিক প্রকৃতিবাদ (Mechanical Naturalism): প্রকৃতিবাদীদের মতে মানুষ একটি যন্ত্রমাত্র। আর এই যন্ত্র প্রাকৃতিক নিয়মেই কাজ করে। তাই মানুষের বিকাশও যান্ত্রিক নিয়মে চলে। মানুষকে সক্ষম যন্ত্র হিসাবে করে গড়ে তােলার জন্য শিক্ষার প্রয়োজন। যাতে এই প্রাকৃতিক পরিবেশে অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে।

iv) মনােবৈজ্ঞানিক প্রকৃতিবাদ (Psychological Naturalism): প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যে তার নিজস্ব শক্তি, আগ্রহ, প্রবণতা, আকাঙ্ক্ষা থাকে। সেগুলিকে অবদমিত না করে তার যথাযথ বিকাশ করাই হল শিক্ষার লক্ষ্য। তাই ব্যক্তি বৈষম্যের কথা মাথায় রেখে এমনভাবে পাঠক্রম রচনা করতে হবে যাতে সমস্ত ধরনের শিক্ষার্থীর পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। 

v) কল্পনাপ্রবণ প্রকৃতিবাদ (Romantic Naturalism): মানব শিশু স্বভাবতই সরল ও পবিত্র। শিক্ষার লক্ষ্য হল শিশুর মন যাতে এই জটিল সমাজের চাপে কলুষিত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা। শিশুকে উন্মুক্ত পরিবেশে রেখে, উপযুক্ত স্বাধীনতা দিয়ে তার স্বাভাবিক মানসিক শক্তির যথাযথ বিকাশ ঘটাতে হবে। দার্শনিক রুশাের প্রকৃতিবাদ কল্পনাপ্রবণ প্রকৃতিবাদ নামে পরিচিত।

শিক্ষায় প্রকৃতিবাদের প্রভাব

আধুনিক শিক্ষাক্ষেত্রে যে পরিবর্তন এসেছে তা প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতিবাদী দর্শনের অবদান। শিক্ষাক্ষেত্রে মনস্তত্বের ধারণা এসেছে প্রকৃতিবাদীদের কাছ থেকে। তাদের মতে শিশু নিজস্ব আগ্রহ, চাহিদা, পছন্দ, সামর্থ্যের উপর ভিত্তি করে শিক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকৃতিবাদী শিক্ষা দর্শন নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। সেগুলি হল – 

1) শিক্ষার লক্ষ্য:

শিক্ষার লক্ষ্য সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকৃতিবাদী দার্শনিকরা বিভিন্ন মতামত প্রকাশ করেছেন। 

i) প্রকৃতিবাদীদের মূল কথা হল আত্ম-বিকাশ (self expression)। শিশু তার নিজের প্রকৃতি অনুযায়ী বিকাশ লাভ করবে। সেখানে সমাজের কোনাে প্রভাব থাকবে না। দার্শনিক Nun এর মতে – Development of individuality is the central aim of education। ব্যক্তিজীবনের পরিপূর্ণ বিকাশই হল শিক্ষার লক্ষ্য। 

ii) সমাজে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শিশুকে জীবন সংগ্রামের উপযুক্ত করে গড়ে তােলা।

iii) মানুষকে আধুনিক সমাজের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। 

iv) বর্তমান শিক্ষা গ্রহণ করে শিশু যাতে ভবিষ্যতে সুখের অধিকারী হতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। 

v) প্রকৃতিবাদীরা শিশুর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিকের বিকাশ একেবারে অগ্রাহ্য করেছেন।

2) শিক্ষার পদ্ধতি:

প্রকৃতিবাদী দার্শনিকরা গতানুগতিক ও পুথি কেন্দ্রিক শিক্ষা পদ্ধতির বিরােধী ছিলেন। শিক্ষার পদ্ধতি সম্পর্কে রুশাে বলেছেন – “Give your scholar no verbal lessons , he should be taught by experience”। অর্থাৎ, শিশুকে কোন মৌখিক শিক্ষা দেওয়ার প্রয়ােজন নেই সে তার অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিখবে। 

i) প্রকৃতিবাদী দার্শনিকদের মতে শিশুর শিক্ষার জন্য শিক্ষক ও পাঠ্যপুস্তক এর বিশেষ প্রয়ােজন নেই। শিশুকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে যাতে সে হাতে কলমে কাজের মাধ্যমে শিখতে পারে।

¡¡) শিশুর স্বাভাবিক প্রবণতা হল খেলা করা। তাই খেলাভিত্তিক (play way) শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিদ্যালয় পরিবেশকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখতে হবে।

iii) শিশুরা বিজ্ঞান শিখবে পরীক্ষাগারে। জ্যামিতি শিখবে খেলার মাঠ ও অন্যান্য জমি পরিমাপ করে। ভূগােল বাংলা শিখবে পর্যটনের মাধ্যমে। আইন কানুন শিখবে বিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসন এর মধ্য দিয়ে। 

iv) শিক্ষা হবে সহ-শিক্ষামূলক (co-education)। ছেলে এবং মেয়েদের একইসাথে শিক্ষা দিতে হবে। পৃথকভাবে তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করলে পরস্পরের মধ্যে অস্বাভাবিক মনােভাব সৃষ্টি হতে পারে। 

3) পাঠক্রম: 

প্রকৃতিবাদী দার্শনিকরা নির্দিষ্ট কোন পাঠক্রমের পক্ষপাতি ছিলেন না। প্রত্যেকটা শিশুর নিজস্ব চাহিদা, আগ্রহ, ক্ষমতা, আছে। শিশু তার চাহিদা অনুযায়ী পাঠক্রম ঠিক করবে। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে প্রকৃতির কাছ থেকে শিখবে। জীবনের মূলনীতি হল আত্ম-সংরক্ষণ। তাই যেসব বিষয় আত্ম-সংরক্ষণে সহায়ক এবং প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সেই সমস্ত বিষয়গুলি পাঠক্রমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সেগুলি হল – 

i) প্রকৃতি বিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, মনােবিজ্ঞান। 

ii) গণিত, রসায়ন, সমাজবিদ্যা, জীববিদ্যা, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি ইত্যাদি। 

¡¡¡) কৃষ্টিমূলক বিষয়গুলিকে (Cultural Subjects) প্রকৃতিবাদীরা পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষপাতি ছিলেন না।

4) শিক্ষকের কর্তব্য:

বাংলা শিক্ষকের প্রভুত্ব এখানে থাকবে না। প্রকৃতিবাদীদের মতে শিক্ষক এখানে দর্শকের ভূমিকা পালন করবেন। তিনি কেবল শিশুর বৃদ্ধির ওপর লক্ষ্য রাখবেন। শিশুর আগ্রহ ও চাহিদা অনুযায়ী স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। তিনি তার কোনাে কাজে বাধা দেবেন না। রুশাে বলেছেন, – “Nature would have them children before they are men”. পূর্ণবয়স্ক মানুষ হবার আগে সে একটি পবিত্র শিশু, এ কথা মনে রেখে শিক্ষক কাজ করবেন। তিনি শুধু তার স্বাভাবিক বিকাশের জন্য একটি আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি করবেন। আদর্শ চরিত্র গঠন সম্পর্কে কোন উপদেশ দেবেন না।

প্রকৃতিবাদের মূল লক্ষ্য হল শিশুকে বিনা বাধায় আত্মবিকাশের সুযােগ দেওয়া। যেখানে শিক্ষকের প্রভুত্ব, কৃত্রিম বিদ্যালয় পরিবেশ, নির্দিষ্ট পাঠক্রমের বােঝা থাকবেনা। শিশু তার আগ্রহ, চাহিদা, সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষার বিচার্য বিষয় স্থির করবে। কিন্তু শিশুর শিক্ষা যদি প্রকৃতির ওপর ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে তার বাঞ্ছিত ফল পাওয়া যাবেনা। Ross এর মতে – “Naturalism needs supplementing and correcting by idealism, because it is only idealism can give a clear vision of a satisfactory goal for educative effort”.

আরো পড়ুন

গঠনবাদ | শিখনের গঠনবাদ তত্ত্ব | ভিগটস্কির শিখন মতবাদ | Constructivism in Bengali

সনদ আইন (1813) | সনদ আইনের উদ্দেশ্য | সনদ আইনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

মুদালিয়র কমিশনের মতে মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলি কী কী | এই প্রসঙ্গে সপ্ত প্রবাহ ধারণাটি বর্ণনা করাে

শিক্ষা মনােবিজ্ঞানের প্রকৃতি আলোচনা করো | Nature of Educational Psychology in Bengali

শিখনের গেস্টাল্ট তত্ব | শিক্ষাক্ষেত্রে গেস্টাল্ট তত্বের প্রয়ােগ | Gestalt Theory of Learning in Bengali

শিখন ও পরিনমনের মধ্যে পার্থক্য ও সম্পর্ক কি | Difference and Relation between Learning and Maturation in Bengali

Leave a Comment

error: Content is protected !!