শিখন ও পরিনমনের মধ্যে পার্থক্য ও সম্পর্ক কি | Difference and Relation between Learning and Maturation in Bengali
উত্তর:
শিখন ও পরিনমনের মধ্যে পার্থক্য
শিখন | পরিনমন |
যে মানসিক প্রক্রিয়া অতীত অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণের প্রভাবে আচরণ ধারার পরিবর্তন ঘটিয়ে ব্যক্তির মানসিক বিকাশের মাধ্যমে তাকে পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে সার্থকভাবে অভিযােজন করতে সাহায্য করে তাই হল শিখন। | পরিনমন হল শিশুর জন্মগত সম্ভাবনা গুলির বাস্তবায়িত হওয়ার প্রক্রিয়া। যার মাধ্যমে শিশুর আচরণের পরিবর্তন ঘটে। |
শিখন অনুশীলন নির্ভর প্রক্রিয়া। | পরিনমন অনুশীলন নির্ভর নয়। |
শিখন এর ফলে মানসিক পরিবর্তন হয়। | পরিণমনের ফলে জৈবিক পরিবর্তন হয়। |
শিখন একটি উদ্দেশ্য ভিত্তিক ও লক্ষ্য অভিমুখী প্রক্রিয়া। | পরিমন প্রক্রিয়াটি উদ্দেশ্যভিত্তিক নয়। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। |
শিখন ব্যক্তির চাহিদা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ব্যাক্তি তার চাহিদা পূরণের জন্য নতুন আচরণ সম্পন্ন করে। | পরিমন চাহিদার ওপর নির্ভরশীল নয়। |
শিখনের জন্য পূর্বপ্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। | পরিণমনের ক্ষেত্রে কোন পূর্ব প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় না। |
শিখন একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া ব্যক্তিজীবনে চলতে থাকে। | পরিণমন একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ঘটে। ব্যক্তির ক্ষেত্রে বৃদ্ধি একটি নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছালে পরিণমন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। |
শিখন একটি সক্রিয়তা ভিত্তিক প্রক্রিয়া। শিখনের জন্য প্রাণীর সক্রিয়তা অপরিহার্য। | পরিণমনের ক্ষেত্রে প্রাণীর সক্রিয়তার কোন প্রয়োজন নেই। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। |
শিখন ও পরিনমনের সম্পর্ক
শিখন ও পরিনমনের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও, মানব জীবনে এদের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। উভয়েই ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং ব্যক্তিজীবনের বিকাশে সহায়তা কর। তাই একটিকে বাদ দিয়ে অপরটি চলতে পারেনা। প্রকৃতপক্ষে পরিণমনের ওপর নির্ভর করে শিখন এর প্রস্তুতি আসে। পরিনমন যেমন মানবজীবনের মৌলিক আচরণগুলাে সম্পন্ন করতে সাহায্য করে। অপরদিকে শিখনের মাধ্যমে ব্যক্তি সক্রিয় ভাবে আচরণে গুণগত ও প্রকৃতিগত পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়। সেই কারণে মনােবিজ্ঞানীরা শিখন ও পরিনমন কে একে অপরের পরিপূরক বলে ব্যাখ্যা করেছেন।
জন্মগ্রহণের পর প্রত্যেকটি প্রাণীকে পরিবেশের সঙ্গে তার অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য সামঞ্জস্য বিধান করে চলতে হয়। প্রাণী কিছু সহজাত প্রবৃত্তি নিয়ে জন্মায় যেগুলি প্রাণীকে মৌলিক কতগুলি আচরণ সম্পন্ন হতে সাহায্য করে। কিন্তু পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য এই আচরণগুলাে যথেষ্ট নয়। তাই প্রাণীর পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন আচরণ সম্পন্ন করে সার্থক অভিযােজনে সক্ষম হয়। পরিবেশের উপযােগী এই নতুন ধরনের আচরণ আয়ত্ত করার নামই হল শিখন।
জন্মের পর থেকে ব্যস বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রাণীর ক্ষেত্রে কিছু আচরণের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। মনােবিজ্ঞানীরা এই আচরণ পরিবর্তনের প্রক্রিয়াকে পরিনমন বলেন। এই প্রক্রিয়া পূর্ব অভিজ্ঞতা ভিত্তিক নয়। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত পরিণমন ঘটে। এক্ষেত্রে বাইরের পরিবেশে কোন প্রভাব দেখা যায়না। পরিণমনের জন্য শিশুকে কোন অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণের প্রয়ােজন হয় না। কোন রকম চেষ্টা ছাড়াই এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। তাই বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে শিশু নিজে থেকেই পর্যায়ক্রমিক ভাবে উপুড়হতে, হামাগুড়ি দিতে, ও চলতে পারে। এই কাজগুলি, তাকে শেখাতে হয় না আপনা আপনি করতে পারে।
বিভিন্ন মনােবিজ্ঞানীরা তাদের বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে শিথন এবং পরিনমন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। মনােবিজ্ঞানী হিলগার্ড (Hilgard) একদল ছাত্রকে সমান দুটি ভাগে ভাগ করেন। একটি দলের নাম দেন পরীক্ষামূলক দল। অপরটির নাম হল নিয়ন্ত্রিত দল। পরীক্ষামূলক দলটিকে বােতাম লাগানাে, কাগজ কাটা, সিঁড়ি বেয়ে ওঠা ইত্যাদি নানা ধরনের কাজ 12 সপ্তাহ ধরে শেখালেন, ফলে ওই দলটি কাজ গুলিতে পারদর্শী হয়ে উঠলাে। এরপর এক সপ্তাহ ধরে তিনি নিয়ন্ত্রিত দলকে এই কাজগুলি শেখালেন। দেখা গেল নিয়ন্ত্রিত দলটি পরীক্ষামূলক দলটির মতােই পারদর্শী হয়ে উঠেছে। এই ঘটনা থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে নিয়ন্ত্রিত দলটি মাত্র এক সপ্তাহ প্রশিক্ষণ নিয়ে পরীক্ষামূলক দলের সমগােত্রীয় হতে পেরেছে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে নিয়ন্ত্রিত দলটিকে যখন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে তখন তাদের বয়স 13 সপ্তাহ হয়েছে এবং সেই মতাে পরিণমনও ঘটেছে। তাই তারা অল্প দিনের প্রশিক্ষণে পরীক্ষামূলক দলটি সমগােত্রীয় হয়েছে। এক্ষেত্রে শিখন পরিণমনের উপর নির্ভরশীল।
মনােবিদ আর্নল্ড গেসেল (Arnold Gesell) দুটি 11 মাস বয়সের শিশুকে নিয়ে গবেষণা করেন। এদের একজনকে তিনি সিঁড়ি দিয়ে ওঠার প্রশিক্ষণ দেন সাত সপ্তাহ ধরে। সাত সপ্তাহ পর দেখা গেল প্রথম শিশুটি কোন প্রকার সাহায্য ছাড়াই সিঁড়িদিয়ে ওঠানামা করতে পারছে। এরপর দ্বিতীয় শিশুটিকে সাত সপ্তাহ পর প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হল। দেখা গেল দু’সপ্তাহের মধ্যে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে পারছে। এর কারণ হল প্রথম শিশুটি যখন অনুশীলন শুরু করে তখন তার দেহে স্নায়ুর উপযুক্ত পরিণতির অভাব ছিল। ফলে তার পক্ষে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে বেশি সময় লেগেছিল। কিন্তু দ্বিতীয় শিশুটির যখন প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন তখন সে দৈহিক দিক থেকে পরিণতি লাভ করেছিল। ফলে অনেক কম সময়ে দ্বিতীয় শিশুটি প্রথম শিশুটির সমকক্ষ হয়ে উঠতে পেরেছে।
সুতরাং, উপরিউক্ত পরীক্ষাগুলির ভিত্তিতে বলা যায় যে শিখন এর অন্যতম উপাদান হল পরিণমন। শিশু যত বড় হয় দৈহিক দিক থেকে তত পরিবর্তন ঘটে, তেমনি আবার মানসিক আচরণ গুলিরও উন্নতি ঘটে। শিশুর পরিণত অবস্থা না এলে শুধুমাত্র অনুশীলনের মধ্য দিয়ে বাঞ্ছিত ফল লাভ করা যায় না। শিশুকে কোন বয়সে কোন বিষয়ে শিক্ষা দিলে সফল হবে তা সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভর করে শিশুর জৈবিক পরিণতির উপর। বয়স বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে শিশুর ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে এবং সে জটিল থেকে জটিলতর আচরণ সম্পাদন করতে পারে। এই কারণে ব্যস অনুযায়ী শিক্ষা ব্যবস্থা এবং তার গ্রহণ ক্ষমতা অনুযায়ী পাঠক্রম নির্ধারণ করা উচিত। সংখ্যা গণনা না শিথিয়ে শিশুকে যােগ-বিয়োগ শেখানাে সম্ভব নয়। কারণ পরিণতি ঘটলেও তা এক্ষেত্রে সাহায্য করে না।
আরো পড়ুন
শিখন অক্ষমতার ধারণা ও শ্রেণীবিভাগ | Concept and Classification of Learning Disability in Bengali
শিখন কি | শিখনের বৈশিষ্ট্য | Characteristics of Learning in Bengali
পরিনমন কি | পরিণমনের বৈশিষ্ট্য | শিক্ষা ক্ষেত্রে গুরুত্ব কি | Maturation in Bengali
হান্টার কমিশন (Hunter Commission) | হান্টার কমিশন কেন গঠিত হয় | হান্টার কমিশনের সুপারিশ
বাল্যকাল | বাল্যকালের বিকাশগত বৈশিষ্ট্য | বাল্যকালের চাহিদা | Childhood in Bengali
প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও পাঠক্রম সম্পর্কে কোঠারি কমিশনের সুপারিশ
অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষা বা অপ্রথাগত শিক্ষা | Informal Education In Bengali
প্রাচীন অনুবর্তন কাকে বলে | প্যাভলভের প্রাচীন অনুবর্তন তত্ত্ব | Classical Conditioning