বাংলা প্ৰবন্ধ সাহিত্যে প্ৰমথ চৌধুরীর অবদান লেখো

Q: বাংলা প্ৰবন্ধ সাহিত্যে প্ৰমথ চৌধুরীর অবদান লেখো
Q: বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে প্রমথ চৌধুরীর অবদান আলোচনা করো
Q: বাংলা সাহিত্যে প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরীর অবদান

উত্তর:

বাংলা প্ৰবন্ধ সাহিত্যে প্ৰমথ চৌধুরীর অবদান

বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের পর প্রবন্ধ সাহিত্যকে নতুন করে মেজাজ ও ভঙ্গির প্রাধান্য দিয়ে গড়ে তোলার প্রয়াস যিনি একমাত্র করেছিলেন তিনি হলেন ‘সবুজ পত্র’র সম্পাদক প্রমথ চৌধুরী। তিনি প্রবন্ধের মধ্যে মজলিশি আলাপের সুর, খেয়াল-খেলার লীলায়িত ছন্দ, ভারমুক্ত স্বচ্ছন্দ মনন সঞ্চরণের প্রবর্তন করেন। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধে মাঝেমাঝে হালকা চাল থাকলেও প্রমথ চৌধুরীর আলোচনা গাম্ভীর্যপ্রধান ও গভীর সুরে অনুরণিত। এছাড়া তার তীক্ষ্ণযুক্তি, লঘু কল্পনা ও স্বচ্ছন্দচারী খেয়াল প্রভৃতির মাধ্যমে যে পরিমণ্ডল রচনা করেছেন তা একান্ত প্রমথ চৌধুরীর মতোই।

তাঁর রচিত প্রবন্ধ গ্রন্থগুলি হল : ‘তেল-নুন-লকরি’ (১৯০৬), ‘বীরবলের হালখাতা’ (১৯১৭), ‘নানাকথা’ (১৯১৯), ‘দুইয়ারকি’ (১৯২০), ‘আমাদের শিক্ষা’ (১৯২০), ‘বীরবলের টিপ্পনী’ (১৯২১),  ‘রায়তের কথা’ (১৯২৬), ‘নানাচর্চা’ (১৯৩২), ‘প্রাচীন হিন্দুস্থান’ (১৯৪০), ‘আত্মকথা’ (১৯৪৬)।

প্রমথ চৌধুরী স্বভাবে ছিলেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী, মননাশ্রয়ী, প্রাণবাদী। তাঁর পরিচ্ছন্ন চিন্তা, মননশীলতা, ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়োজিত ছিল বিংশ শতাব্দীর শিক্ষিত বাঙালি মানসের সর্বাঙ্গীণ মুক্তিযজ্ঞে। ‘বীরবল’ ছদ্মনামে ‘সবুজ পত্র’-র “সম্পাদক রূপে তিনি সেই কাজ সম্পন্ন করেছেন। নিম্নে তার রচিত প্রবন্ধ সম্পরকে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল-

১) বীরবলের হালখাতা : বাংলা গদ্যের সচেতন পরীক্ষার ফসল হল প্রমথ চৌধুরীর ‘বীরবলী গদ্য’। ‘বীরবলের হালখাতা’ (১৯১৭) প্রবন্ধগ্রন্থের ‘কথার কথা’ প্রবন্ধে তিনি জানিয়েছেন, ‘ভাষা মানুষের মুখ হতে কলমের মুখে আসে’। চলিত গদ্যকে সাহিত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত আসন দান করতে তিনি ‘সবুজপত্র’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। দেশি ও বিদেশি শব্দের মিশ্রণে রাগ বৈদশ্যের প্রয়োগে তিনি বাংলা গদ্যের রূপ নির্মাণে নানা পরীক্ষা চালান। তাঁর বাংলা গদ্যের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো হল—কথাভঙ্গি, ব্যঙ্গ ও পরিহাস প্রবণতা এবং বাকবৈদ্য সমৃদ্ধ ভাষা 

২) বয়কট ও স্বদেশীয়তা : সমস্ত প্রবন্ধে তিনি রুচিসম্মতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেন। স্বদেশের সমস্যা নিয়েও তিনি ছিলেন বিশেষ চিন্তিত। ১৩১২ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যায় ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বয়কট ও স্বদেশীয়তা’ প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী জানিয়েছেন, ‘আমাদের কোটি কোটি ইতর সাধারণের পক্ষে দেশের কথা প্রধানত পেটের কথা।

“যারা পেটের জ্বালায় জ্বলছে, তাদের উপরক্ত কথার জ্বালা জ্বালাবার কোনো দরকার নেই।” তিনি সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্র নিয়ে যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা করেছেন। যুক্তিহীন অনুকরণ প্রবণতাকে তিনি কখনও গ্রহণ করতে পারেননি। বাহ্য স্বাধীনতা নয়, মনের দিক থেকে স্বাধীন হয়ে ওঠাকেই তিনি আসল স্বাধীনতা বলেছেন।

৩) তেল-নুন-লকড়ি : ১৩১২ বঙ্গাব্দে রচিত ‘তেল-নুন-লকড়ি’ প্রবন্ধে বলেছেন, দৈনিক জীবনে আমরা সকলেই অভ্যস্ত, আচার ব্যবহারের অধীন। ভুল করেছি—এই জ্ঞান জন্মানো মাত্র সেই ভুল তত্ক্ষণাৎ সংশোধন করা যায় না। কিন্তু মনের স্বাধীনতা একবার লাভ করতে পারলে ব্যবহারেরও অনুরূপ পরিবর্তন শুধু সময় সাপেক্ষ।

৪) বইপড়া : ‘বইপড়া’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘বইপাড়ার শখটা মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ শখ হলেও আমি কাউকে শখ হিসেবে বই পড়তে পরামর্শ দিতে চাইনে। প্রথমত সে পরামর্শ কেউ গ্রাহ্য করবেন না। কেননা আমরা জাতি হিসেবে শৌখিন নই; দ্বিতীয়ত অনেকে তা কুপরামর্শ মনে করবেন, কেননা আমাদের এখন ঠিক শখ করবার সময় নয়। আমাদের এই রোগশোক দুঃখ দারিদ্র্যের দেশে জীবনধারণ করাই যখন হয়েছে প্রধান সমস্যা, তখন সে জীবনকে সুন্দর করা মহৎ করার প্রস্তাব অনেকের কাছেই নিরর্থক এবং সম্ভবত নির্মম ও ঠেকবে। 

৫) আমাদের ভাষা সংকট : আলোচ্য প্রবন্ধে বাংলা ভাষায় ইংরেজি ভাষার অনুপ্রবেশকে দ্বিধাহীনভাবে স্বাগত জানিয়েছেন। ইংরেজি শিক্ষিত মানুষের কথোপকথনের দিকে নজর দিলে দেখা যায়, তাদের কথ্য ভাষায় অধিকমাত্রায় ইংরেজি শব্দের বাহুল্য। ইংরেজরা আসার আগে আমাদের দেশে অজস্র বিদেশি জাতি প্রবেশ করেছে। তারফলে অজস্র বিদেশি শব্দ আমাদের ভাষায় প্রবেশ করেছে। ভারতচন্দ্রের সময়কালে আঠারো শতকে আমাদের বাংলায় পর্তুগীজ, ফরাসি, ওলন্দাজ, দিনেমার, ইংরেজ প্রভৃতি বিদেশি জাতি প্রবেশ করেছে। সেইসব ভাষার শব্দও বাংলায় প্রবেশ করেছে। স্বাভাবিক ভাবেই অনেক বিদেশি শব্দ বাংলা ভাষা থেকে যেমন বেরিয়ে গেছে তেমন স্বাভাবিক ভাবেই নতুন-নতুন অনেক বিদেশি শব্দ অনুপ্রবেশ করেছে। জোর করে কোনো বিদেশি শব্দকে আজ আর বাংলা ভাষা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।

৬) সাহিত্যের উদ্দেশ্য : ‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য প্রবন্ধ্যে প্রমথ চৌধুরী ‘সাহিত্যের খেলা’ প্রবন্ধে লিখেছে ‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য সকলকে আনন্দ দেওয়া, কারও মনোরঞ্জন করা নয়। এ দুয়ের ভিতর যে, আকাশ পাতাল প্রভেদ আছে, সেইটি ভুলে গেলেই লেখকরা নিজে খেলা না করে পরের জন্যে খেলনা তৈরি করতে বসেন। সমাজের মনোরঞ্জন করতে গেলে সাহিত্য যে স্বধর্মচ্যুত হয়ে পড়ে। প্রমথ চৌধুরী যেমন সাহিত্যের আধুনিক চলিত ভাষার প্রবর্তক ছিলেন, তেমনই আবার ছিলেন সার্থক সনেটকার। ছোটোগল্পও তিনি রচনা করেছেন, সর্বক্ষেত্রেই তাঁর উইট এবং পরিহাস প্রবণতা বুদ্ধিদীপ্ত। সাধারণ আটপৌরে শব্দ ব্যবহারেও ঝোঁক ছিল তাঁর প্রবল।

প্রমথ চৌধুরীর গদ্য ও প্রবন্ধশৈলীর বৈশিষ্ট্যগুলো হল –

১। সাহিত্যের ভাষাকে তিনি মুখের ভাষার অনেক কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘যতদূর পারা যায়, যে ভাষায় কথা কই সেই ভাষায় লিখতে পারলেই লেখা প্রাণ পায়। সাহিত্যের তথাকথিত সাধুভাষা প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, ‘তথাকথিত সাধুভাষা সম্বন্ধে আমার প্রধান আপত্তি এই যে, ওরূপ কৃত্রিম ভাষায় আর্টের কোনো স্থান নেই।’

২। প্রমথ চৌধুরী সাহিত্যে চলিত ভাষার পক্ষপাতী হলেও তাঁর গদ্যরীতিকে ‘মৌখিক গদ্যরীতি’ বলা চলে না। অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘শুধু ক্রিয়াপদ এবং সর্বনাম ছাড়া প্রমথ চৌধুরী আর কোনো দিক দিয়ে মুখের ভাষার বিশেষ অনুকরণ করেননি, বরং অনাবশ্যক মারপ্যাঁচ, বাচনভঙ্গির অকারণ তির্যকতা, ও অলঙ্কারের চাকচিক্য তাঁর চলিত ভাষাকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাধু ভাষার চেয়েও দুরূহ করে তুলেছে।

৩। ভাষা এবং সাহিত্য দু’রকমের রচনাই তিনি লিখেছেন। ভাষা বিষয়ক রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—’বঙ্গভাষা বনাম বাবু বাংলা ওরফে, সাধুভাষা’, ‘কথার কথা’, ‘আমাদের ভাষাসঙ্কট’, ‘সাধুভাষা বনাম চলিত ভাষা’, ‘বাংলা ব্যাকরণ’ ইত্যাদি। সাহিত্যবিষয়ক রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—’সাহিত্যে চাবুক’, ‘সাহিত্যে খেলা’, ‘কাব্যে অশ্লীলতা’ ইত্যাদি। ভাষা প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, ‘ভাষামার্গে আমি ভারতচন্দ্রের পদানুসরণ করেছি। সাহিত্য কেন্দ্রিক রচনাগুলিতে তাঁর পর্যবেক্ষণ সুলভ দৃষ্টি এবং পরিহাস প্রবণতা যুক্ত হয়েছে।

৪। কথকতা সুলভ ভঙ্গি, চলিত ভাষা প্রয়োগ, বাগবৈদগ্ধতা, ব্যাঙ্গ ও পরিহাস প্রবণতা তাঁর গদ্যসাহিত্যের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। 

৫। প্রমথ চৌধুরীর গদ্যকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘ইস্পাতের ছুরি’। তিনি আঙ্গিকের কাঠিন্যতা থেকে প্রবন্ধ সাহিত্যকে মুক্তি দিয়েছেন। প্রবন্ধে তিনি বিষয় নিয়ে খেলা করেছেন এবং খেলার আনন্দ উপভোগ করেছেন।

৬। মুখের কথাকে তিনি শিল্পকলায় রূপান্তরিত করেছেন।

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে প্রাবন্ধিক হিসাবে প্রমথ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যে শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব রেখে গেছেন। যদিও অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “যথার্থ মুখের ভাষাকে সাহিত্যকর্মে ব্যবহারের গৌরব হুতোম ও বিবেকানন্দের প্রাপ্য, প্রমথ চৌধুরীর নয়।”—তবুও তাঁর ভাষারীতির স্বাতন্ত্র্য আছে, সেই স্বাতন্ত্র্য কৃত্রিম হলেও তাকে সাহিত্যে যথাযথ স্থান করে দেওয়ায়, বাগ্‌বৈদগ্ধ্যপূর্ণ ভাষার ব্যবহারে, বাঙালি মনন ও সংস্কৃতি’কে কুসংস্কার ও অজ্ঞতা থেকে মুক্তিদান করে; প্রমথ চৌধুরী চলিত রীতির বাংলা গদ্যের যে নতুন সন্ধান দিয়েছেন এবং প্রবন্ধে আঙ্গিকের যে পরিবর্তন এনেছেন সেজন্য প্রাবন্ধিক হিসাবে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

আরো পড়ুন

শাক্ত পদাবলী সাহিত্যে রাম প্রসাদ সেনের কবি প্রতিভা আলোচনা কর

বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে শ্রীরামপুর মিশনের অবদান আলোচনা করো

বাংলা নাট্য সাহিত্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদান আলোচনা করো

বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবদান

বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করো

বাংলা নাট্য সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো

Leave a Comment

error: Content is protected !!