এরিকসনের মনোসামাজিক বিকাশের তত্ত্ব | Eriksons psychosocial devlopment theory in Bengali

এরিকসনের মনোসামাজিক বিকাশের তত্ত্ব | Eriksons psychosocial devlopment theory in Bengali

উত্তর:

এরিকসনের মনোসামাজিক বিকাশের তত্ত্ব

এরিকসন ছিলেন একজন জার্মান-আমেরিকান বিকাশ মুলক মনোবিজ্ঞানি এবং মনোবিশ্লেষক।

মনোসামাজিক বিকাশের প্রবক্তা এরিকসন ফ্রয়েডের অনুগামিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন।

এরিকসন ফ্রয়েডের মতবাদে প্রভাবিত হলেও তার মনোসামাজিক তত্ত্বে অহমকে (Ego) একটি স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন অহম জন্ম অবস্থা থেকেই থাকে। ইহা Id দ্বারা প্রভাবিত হয় না। তাই Id এবং Ego এর মধ্যে দ্বন্দ্ব গুরত্বপূর্ন নয়। বরং মানসিক দ্বন্দ্ব মূলত অহমের চাহিদা ও সমাজের চাহিদার দ্বন্দ্ব। সুতরাং সমাজ তথা পারিপার্শ্বিক চাহিদার সঙ্গে ব্যক্তির সংগতি স্থাপনের প্রচেষ্টার মধ্যে যে দ্বন্দ্বের উদ্ভব হয় তা পরবর্তী কালে ব্যক্তিত্ব বিকাশের সহায়ক।

এরিকসনের মনোসামাসজিক তত্ত্বটি জীবন বিকাশের স্তরের সাথে সম্পর্ক যুক্ত। জীবন বিকাশের পর্যায়ে মনোসামাজিক বিকাশের স্তর গুলিকে বিশ্লেষন করা হয়। এরিকসন জীবন কালকে চারটি পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন- 

A. প্রারম্ভিক পর্যায় (Early years) :

এই পর্যায়টি তিনটি উপ-পর্যায়ে সমন্বিত, ইহা জন্ম থেকে ৫ বছর পর্যন্ত বিস্তৃত।

1. আস্থা বনাম অনাস্থা :

প্রান্তিক পর্যায়ে প্রথম স্তরের বৈশিষ্ট্য হল আস্থা বনাম অনাস্থা বা বিশ্বাস বনাম অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব৷ নবজাত শিশু যখন কোন বস্তুকে সঠিকভাবে করায়ত্ব করতে সমর্থ হয় তখন সে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে এবং মানসিকভাবে সুরক্ষিত বোধ করে৷ অর্থাৎ মানসিকতা সম্পন্ন নাগরিক হয়ে ওঠে। আর যদি কার্যসম্পর্কে আস্থা অর্জন করতে না পারে তার মধ্যে আত্মবিশ্বাসবোধ হারিয়ে যায়।

2. স্বাধীনতা বনাম লজ্জা :

এই স্তরে শিশু প্রশিক্ষিত হয়। কিন্তু প্রশিক্ষন দিতে গিয়ে শিশুর আত্মসম্মান অনেকটা বাধাপ্রাপ্ত হয়। পিতামাতার অধিক নিয়ন্ত্রন তাদের আত্ম সচেষ্টতা নষ্ট করে। ইহার ফলে তারা লজ্জা ও আত্মদ্বন্দ্বে ভোগে। তাই শিশুদের আত্মবিশ্বাস নষ্ট যাতে না হয় সেদিকে পিতামাতা, শিক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ককে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। এরিকসনের মতে, শিশুকে যেন কোনোভাবে হেয় না করা হয়। তবেই শিশুর মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রন, দক্ষতা, এবং পরিপক্কতার বিকাশ হবে।

এই স্তরের কিছু গুরুত্বপূর্ন দিক রয়েছে তা হল-

(ক) নিয়মানুবর্তিতার প্রয়োজনীয়তা : এই স্তরে যুক্তিসঙ্গত ভাবে পরিচালিত করা এবং নিয়ম মেনে চলার যথার্থ সময়।

(খ) কর্মতৎপরতার প্রয়োজনীয়তা : এই স্তরে শিশুদের যে কোন কাজে নিযুক্ত করা হবে। তবেই তাদের মধ্যে স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রন ক্ষমতার বিকাশ হবে।

(গ) আদর্শ চরিত্রের প্রয়োজনীয়তা : দুই তিন বছর বয়সে শিশু অনুকরন করতে ভালোবাসে। তাই তাদের ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

3. প্রচেষ্টা বনাম অপরাধ বোধ :

এই স্তরে শিশুর চলাফেরার স্বাধীনতা, সঠিক ভাষা প্রয়োগ এবং কল্পনার প্রকাশ ঘটে। এইস্তরে পড়তে শেখে, বিদ্যালয়ের সাথে অভিযোজন এবং নিজের পোষাক পরিচ্ছদ পরিধানে দক্ষ হয়ে ওঠে। এরিকসন মনে করেন শিশুর খেলা বিনোদনমূলক কাজ হলেও এই স্তরটি প্রজ্ঞামূলক জ্ঞানবিকাশে, সামাজিক আদান প্রদান ও প্রাক্ষোভিক বিকাশে সাহায্য করে।

শিক্ষাগত তাৎপর্য :

জীবন বিকাশের প্রারম্ভিক পর্যায়ে এরিকসন যে তিনটি স্তরের কথা উল্লেখ করেছেন তার শিক্ষাগত তাৎপর্য হল-

i. প্রাক্ বিদ্যালয় স্তরে শিশুর জ্ঞানমূলক দিকের বিকাশ হয়। সে জন্য বিকাশ প্রক্রিয়ার সাথে সংগতি রেখে পাঠ্যক্রম প্রনয়ন করতে হবে।

ii. শিক্ষকদের উপযুক্ত শিক্ষাদান ও পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। 

iii. পেশির বিকাশ ও সমন্বয়ের ক্ষেত্রে উপযুক্ত সরঞ্জামের ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন- চিত্রাঙ্কনে লম্বা পেন্সিলের ব্যবহার।

iv. শিশুর স্বতঃস্ফুর্ত শিখন প্রবনতাকে কাজে লাগিয়ে দক্ষতা ও নিরাপত্তাবোধের বিকাশ ঘটাতে হবে।

B. প্রাক- বয়ঃসন্ধি পর্যায় বা মধ্যবর্তী পর্যায় (Middle years) :

4. উদ্দম বনাম হীনমন্নতা :

এই স্তরে শিশুদের বিদ্যালয়ের সহ পাঠ্যক্রমিক বিভিন্ন ধরনের কাজ ও ব্যক্তির সাথে মিথষ্ক্রিয়া ঘটে। এই মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের অভিজ্ঞতার বিকাশ হয়। এরিকসন বলেছেন কাজের মধ্য দিয়ে শিশুরা স্বীকৃতি পায়। জগতের নিয়মরীতির সাথে মানিয়ে চলে এবং উপাদানশীলতার সাথে নিজেকে নিযুক্ত রাখে।

বালকরা বিদ্যালয়ে শিক্ষকের সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারছে কিনা, সহপাঠিদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনে সক্ষম হয়েছে কিনা সে সম্বন্ধে জানা যায়। এই স্তরে সামান্য সাফল্য শিশুকে অভিযোজনে এবং সামাজিক সমর্থনে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে সাহায্য করে। অসফল বালকরা নিজেদের ছোট মনে করে হীনমন্নতায় ভোগে। এই স্তরে শিক্ষক তাদের আত্মসম্মান ও আত্মসচেতনতা বোধ জাগিয়ে তুলবেন।

শিক্ষাগত তাৎপর্য :

এরিকসন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্তরটিকে বলেছেন “আমি যা শিখেছি তাই আমি হয়েছি”। এইস্তরে শিশুরা খেলার মাধ্যমে সহপাঠিদের থেকে এবং অন্যান্য কার্যাবলী থেকে শেখে। এইস্তরের শিক্ষামূলক দিকগুলি হল-

i. এইস্তরে কর্মক্ষমতা ও কর্মদক্ষতার উন্নতি হয়।

ii. সফলতা ও ব্যর্থতা এই দুইয়ের ভারসাম্যের বিকাশ হয়। এরফলে শিশুর আত্মসম্মানের বিকাশ হয়। 

iii. পারদর্শিতার বিকাশ হয়।

তাই শিক্ষকের কাজ হল-

ক) শিশুর উৎসাহ ও প্রতিভাকে সঠিক দিকে পরিচালনা করা।

খ) একটি বিষয়ের উপর শিশুর কর্মদক্ষতা ও কর্মক্ষমতার বোধ তৈরী করতে হবে।

গ) শিক্ষক শিশুর নৈপুন্য অনুযায়ী নতুন ও কঠিন কাজের নির্দেশ দেবে। এইভাবে শিক্ষক সাহায্য করবে।

C. কৈশোর বা বয়ঃসন্ধি পর্যায় (Adolescent years) :

এই স্তরের সময়কাল ১২ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত।

5. আত্মপরিচয় বনাম আত্মপরিচয়ের বিভ্রান্তি :

এরিকসনের পঞ্চম স্তর হল বাল্যকালের সমাপ্তি ও প্রাপ্তবয়স্কের সূচনা। এই সময় শিক্ষার্থীরা আত্ম মূল্যায়নে বন্ধুদের মতামতের উপর গুরুত্ব দেয়। সে নিজেকে যখন প্রশ্নকরে আমি কে ? আমার পরিচয় কী ? সে সঠিক উত্তর পায় না৷ আর তখনই নতুন চ্যালেঞ্জ, জটিল কাজ ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সম্মুখীন হয়।

শারীরিক, যৌনগত, বৌদ্ধিক, বয়ষ্কদের অধিকতর প্রত্যাশা, সহপাঠিদের চাপ প্রভৃতির কারনে এই বয়সের কিশোর-কিশোরীর পরিচিতির সংকট তৈরী হয়। যারা এই সংকট থেকে মুক্ত হতে পারে তারা আত্মপরিচয় অর্জন করে এবং যারা সংকট মুক্ত হতে পারে না তারা পরিচয় বিভ্রান্তির শিকার হয়।

মারসিয়া (Marcia) বয়ঃসন্ধির বিকাশের পরিচিতির জন্য চারটি বিষয়ের যেকোনো একটির উপর প্রতিক্রিয়া করেন। তা তিনি গবেষনা করে পেয়েছেন। এই চারটি প্রতিক্রিয়া হল- আবছা পরিচয় / অস্পষ্ট পরিচয়, পরিচয় নির্বাচন, পরিচয় হীনতা, পরিচয় লাভ।

শিক্ষাগত তাৎপর্য : 

কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক, যৌন ও প্রজ্ঞামূলক পরিবর্তন গুলিকে সমন্বয়ের লক্ষ্যে শিক্ষকদের উদ্যোগী হতে হবে। এইস্তরের ছেলেমেয়েদের মনোসামাজিক পরিনমনের গুরুত্বপূর্ন কর্মসূচী হল-

i. বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের সাথে সৎ আচরন করতে হবে।

ii. তাদের শারীরিক মর্যাদা দিতে হবে।

iii. পঠনপাঠনে, ভবিষ্যত কর্মজীবনে নিপুনতা অর্জনের ব্যবস্থা করতে হবে।

iv. জৈবিক ও মনঃস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে উপযুক্ত বিষয়বস্তু সরবরাহ করতে হবে৷

D. পরবর্তি পর্যায় (Later years) : 

6. অন্তরঙ্গতা বনাম একাকীত্বতা :

১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত এইস্তর সীমাবদ্ধ। এই স্তরে যৌনতার বাইরে গিয়ে অন্তরঙ্গতার বোধ তৈরী হয়। বন্ধুদের সাথে পারস্পরিক মনোসামাজিক সম্পর্ক তৈরী হয়। নিজের বিষয়কে না হারিয়ে অন্যদের প্রতি দায়িত্ববোধের বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। এই অন্তরঙ্গতার মধ্য দিয়ে একাকীত্বতাবোধ দূরীভূত হয়।

7. উৎপাদনমুখীতা বনাম অচলাবস্থা :

৩৫ থেকে ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত বিস্তৃত। এই স্তরের উল্লেখযোগ্য দিক হল অপরের মঙ্গলকামনা করা। অর্থাৎ অপরের প্রতি দায়িত্ববান হওয়া যা পরবর্তী প্রজন্মকে সামাজিক মূল্যবোধের পথে পরিচালিত করে। কিন্তু বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে উৎপাদনশীলতা স্থিমিত হয়ে আসে। তখন অন্যদের প্রতি মঙ্গল কামনায় উৎপাদনমুখীতা প্রকাশ পায়।

8. সততা বনাম হতাশা :

এই স্তর ৬৫ বছরের উর্ধ্বে। দীর্ঘসময় যে ব্যক্তি প্রানী বা বস্তুর প্রতি দায়িত্ববান হয়, জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতাকে যারা মানিয়ে নিতে পারে তারাই সাতটি স্তরের মধ্য দিয়ে সাফল্যের শিখরে পৌছাতে পারে। অর্থাৎ জীবনের ওঠাপড়াকে সন্তুষ্ঠ হয়ে মেনে নিতে পারে তখন সে ন্যায়নিষ্ঠা ও সততাবোধে পৌঁছায়। আর যে ব্যক্তি জীবনের ব্যর্থতাকে মেনে নিতে পারে না সে হতাশায় ভোগে।

সবশেষে বলতে পারি মনোবিদ এরিকসনের মনোসামাজিক বিকাশ উপরিউক্ত আটটি স্তরের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়। এই আটটি স্তরের বিকাশ যাতে স্বাভাবিকত্ত্ব লাভ করে সেদিকে পিতামাতা ও শিক্ষক-শিক্ষিকাকে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।

আরো পড়ুন

স্যাডলার কমিশন (Sadler Commission) | স্যাডলার কমিশনের সুপারিশ

কোহলবার্গের নৈতিক বিকাশের তত্ত্ব | Kohlberg’s Moral Development Theory in Bengali

Leave a Comment

error: Content is protected !!