হান্টার কমিশন (Hunter Commission) |  হান্টার কমিশন কেন গঠিত হয় | হান্টার কমিশনের সুপারিশ

হান্টার কমিশন (Hunter Commission) |  হান্টার কমিশন কেন গঠিত হয় | হান্টার কমিশনের সুপারিশ
অথবা, হান্টার কমিশন কি | হান্টার কমিশন কেন গঠিত হয়েছিল | হান্টার কমিশনের সুপারিশ গুলি লেখ

উত্তর:

হান্টার কমিশন (Hunter Commission)

1882 খ্রিস্টাব্দে 3rd ফেব্রুয়ারি লর্ড রিপন W.w. Hunter সাহেবের সভাপতিত্বে হান্টার কমিশন নামে একটি কমিশন গঠন করেন। এটি ভারতের প্রথম শিক্ষা কমিশন (স্বাধীনতার পূর্ববর্তী)। William. Wilson. Hunter সাহেবের নাম অনুসারে এই কমিশনের নাম হয় হান্টার কমিশন। 20 জন সদস্য নিয়ে এই কমিশন গঠিত হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন যতীন্দ্রমােহন ঠাকুর, আনন্দমােহন বসু, ভূদেব মুখােপাধ্যায়, জাস্টিস কাশীনাথ তেলাং, সৈয়দ মামুদ প্রমুখ। 18৪3 সালে হান্টার কমিশন 222 টি প্রস্তাবনা নিযে একটি 600 পৃষ্ঠার রিপাের্ট পেশ করেছিলেন। এই রিপাের্টে তৎকালীন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা এবং কোম্পানির শিক্ষার অগ্রগতি সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে। 

হান্টার কমিশনের উদ্দেশ্য: 

1854 খ্রিস্টাব্দে উডের ডেসপ্যাচ এর নির্ধারিত শিক্ষানীতি কতটা কার্যকরী হযেছে তা অনুসন্ধান করার জন্য এবং ওই নীতির আর কোন উপযােগিতা আছে কিনা সে বিষয়ে পরামর্শ দানের উদ্দেশ্যে হান্টার কমিশন গঠিত হয়েছিল। কমিশনের প্রধান কাজ ছিল সরকারি, মিশনারি ও ভারতীয় প্রয়াসের গুরুত্ব নির্ণয় করা। প্রাথমিক শিক্ষা, নারী শিক্ষা, মুসলিম শিক্ষা, অনুন্নত সম্প্রদায়ের শিক্ষার প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নতি সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত দান করা। এছাড়াও উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে কমিশন বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছিলেন।

হান্টার কমিশনের সুপারিশ: 

প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে হান্টার কমিশনের সুপারিশ: 

কমিশন প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে বলেছিলেন ভারতীয় শিক্ষা ব্যাবস্থায় প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তার ও উন্নয়নের প্রতি বিশেষ মনােযােগ দেওয়া প্রয়োজন। এজন্য কমিশন প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের জন্য আর্থিক সুব্যবস্থা, পাঠক্রম নির্ধারণ, শিক্ষক-শিক্ষণ প্রভৃতি বিষয়ে মােট 36 টি সুপারিশ করেন। কমিশন প্রাথমিক শিক্ষাকে সাধারণের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ রূপে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে কমিশনের সুপারিশ গুলি হল – 

1) পরিচালন ব্যবস্থা: 

a) কমিশন বলেছিলেন ভারতীয়দের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং দেশীয় পদ্ধতিতে পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলােকে সরকারি স্বীকৃতিদান করতে হবে।

b) সরকারি স্কুল গুলিতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত ধরনের ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করতে হবে।  শিক্ষাক্ষেত্রে কোন ভেদাভেদ থাকবে না অর্থাৎ, নিরপেক্ষ প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

c) অনুন্নত অঞ্চলগুলােতে ও প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

d) বিদ্যালয় সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি কিনা তা দেখার জন্য বিদ্যালয় পরিদর্শক নিয়ােগ করতে হবে। ভারতীয়দের মধ্যে থেকে বিদ্যালয় পরিদর্শক নিয়ােগ করতে হবে। 

2) শিক্ষার মাধ্যম: প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা যাতে তাদের নিজের ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। 

3) পাঠক্রম : পাঠক্রম যথাসম্ভব সহজ সরল ও স্থানীয় প্রয়ােজনীয়তা অনুসারে স্থির করতে হবে। দৈনন্দিন জীবনের সর্বাপেক্ষা প্রয়ােজনীয় যেসব বিষয় সেগুলি শেখানাে হবে। পাঠক্রমের মধ্যে থাকবে সাধারণ জ্ঞান, প্রাথমিক বিজ্ঞান, কৃষিবিদ্যা, জমি-জরিপ, সাধারণ গণিত, হিসেব-নিকাশ, স্বাস্থ্য ও শিল্পকলায় বিজ্ঞানের প্রয়ােগ সংক্রান্ত কিছু ব্যবহারিক বিষয়।

4) শিক্ষক শিক্ষণ: কমিশন শিক্ষক-শিক্ষণ এর ওপর বিশেষ মনােযােগ দিয়েছেন। কমিশনের মতে প্রত্যেক মহকুমা পরিদর্শকের তস্বাবধানে অন্তত একটি করে শিক্ষক-শিখন স্কুল থাকা অবশ্যক। 

5) পরীক্ষা ব্যবস্থা: পরীক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে কমিশন বলেছেন, পরিদর্শকগণ দেশীয় শিক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নিজেরাই পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করবেন। 

6) প্রশাসন: প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন সম্বন্ধে কমিশন নতুন সুপারিশ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা পরিকল্পনা ব্যবস্থা, রক্ষণাবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেওয়া হবে স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসন এর ওপর। 

7) অর্থনৈতিক ব্যবস্থা: বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল অর্থ। কমিশন প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যয় নির্বাহের জন্য আর্থিক ব্যবস্থা সম্পর্কে কতগুলি সুপারিশ করেন সেগুলি হল –

a) শিক্ষা সংক্রান্ত বরাদ্দ অর্থের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যয়ের জন্য অগ্রাধিকার থাকবে। 

b) প্রত্যেকটি জেলা ও মিউনিসিপাল বাের্ডকে প্রাথমিক শিক্ষায় ব্যযের জন্য একটি বিশেষ অর্থ ভান্ডার সংরক্ষণের পরামর্শ দিতে হবে। 

c) সরকারকে প্রাথমিক শিক্ষার ব্যয় ভার গ্রহণ করতে হবে।

d) কিছু সংখ্যক দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য বিনা বেতনে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে।

মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পর্কে হান্টার কমিশনের সুপারিশ: 

a) মাধ্যমিক শিক্ষা পরিচালনায় সরকার সক্রিয় দায়িত্ব গ্রহণ করবে না। 

b) বেসরকারি প্রচেষ্টায় মাধ্যমিক বিদ্যালয় সমূহ গড়ে উঠবে। 

c) স্থায়িত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারলে বেসরকারি প্রচেষ্টায় স্কুলগুলােকে ছেড়ে দেওয়া হবে।

d) পিছিয়ে পড়া শ্রেণি ও অনুন্নত অঞ্চলে শিক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব সরকারের উপর থাকবে। 

e) শিক্ষার মান রক্ষার জন্য সরকার প্রতিটি জেলায় উন্নত মানের আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করবে। 

f) বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল গুলিকে উৎসাহিত করার জন্য বেতনের হার নির্ধারণের স্বাধীনতা দেওয়া হযেছিল।

g) মাধ্যমিক শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যবহারিক শিক্ষার দ্বার মুক্ত করার জন্য কমিশন মাধ্যমিক শিক্ষাকে দ্বিমুখী করার সুপারিশ করেছিলেন। যেমন, ‘A’ কোর্স হল এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ লাভের জন্য এবং ‘B’কোর্স হল বাণিজ্যিক ও কারিগরি শিক্ষা সম্পর্কিত। 

h) মাধ্যমিক শিক্ষা মাধ্যম হিসেবে কোন ভাষাকে স্বীকৃতি দেয়া হবে সে সম্পর্কে হান্টার কমিশনের সুপারিশে স্পষ্টভাবে কিছু উল্লেখ ছিল না। শিক্ষার মাধ্যম রুপে মাতৃভাষা মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর পর্যন্ত অগ্রসর হলেও সম্পূর্ণ মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া প্রস্তাব এখানে ছিল না। তাই স্পষ্ট বােঝা যায় কমিশন ইংরেজি ভাষার পক্ষেই ছিল। 

i) মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নতির জন্য কমিশন যথেষ্ট পরিমাণে স্কুল পরিদর্শন ও উপযুক্ত শিক্ষক শিখন এর আয়োজন করতে বলেন।

উচ্চ শিক্ষা সম্পর্কে হান্টার কমিশনের সুপারিশ: 

a) প্রত্যেকটি কলেজে কিছু সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিনা বেতনে পড়ার সুযােগ দিতে হবে।

b) মেধাবী ছাত্ররা যাতে বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযােগ পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। 

c) বড় বড় কলেজে বিভিন্ন বিষয়ে ঐচ্ছিক পাঠক্রম চালু করতে হবে। 

d) কলেজের শিক্ষক সংখ্যা এবং ব্যয়ের পরিমাণ বাড়াতে হবে।

e) অনুদান প্রথা চালু করতে হবে। 

f) বেসরকারি প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানাতে হবে এবং সরকারি প্রচেষ্টা বন্ধ করা। 

g) দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে 

মুসলিম শিক্ষা:

a) মুসলিমদের শিক্ষার জন্য দেশীয় স্কুলকে উৎসাহ দান 

b) প্রাথমিক থেকে কলেজ পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে তাদের বৃত্তিপ্রদান

c) বিনা বেতনে অধ্যায়নের সুযােগ ইত্যাদির ব্যবস্থা সম্পর্কে কমিশন সুপারিশ করেছিলেন। 

নারী শিক্ষা: 

নারী শিক্ষা সম্পর্কে কমিশন কতকগুলি সুপারিশ করেন। সেগুলি হল – ৪

a) বেসরকারি বালিকা বিদ্যালয় গুলিকে অনুদান দেওয়া।

b) বালিকাদের প্রাথমিক শিক্ষাকে সহজ এবং সরল করতে হবে।

c) প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে।

d) মহিলাদের জন্য আলাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে।

e) অনুন্নত অঞ্চলের মেয়েদের শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে।

f) নারী পরিদর্শিকা নিয়ােগ করতে হবে।

g) নারীদের শিক্ষার জন্য কিছু কিছু নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে।

আরো পড়ুন

বাল্যকাল | বাল্যকালের বিকাশগত বৈশিষ্ট্য | বাল্যকালের চাহিদা | Childhood in Bengali

প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও পাঠক্রম সম্পর্কে কোঠারি কমিশনের সুপারিশ

অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষা বা অপ্রথাগত শিক্ষা | Informal Education In Bengali

প্রাচীন অনুবর্তন কাকে বলে | প্যাভলভের প্রাচীন অনুবর্তন তত্ত্ব | Classical Conditioning

মুদালিয়ার কমিশনের সুপারিশ | Mudaliar Commission (1952-53) in Bengali

Leave a Comment

error: Content is protected !!