গেস্টাল্ট মতবাদ কি | গেস্টাল্ট মতবাদের মূল সূত্র বা নীতি

গেস্টাল্ট মতবাদ কি ? গেস্টাল্ট মতবাদের মূল সূত্র বা নীতি

উত্তর:

গেস্টাল্ট মতবাদ

গেস্টাল্টবাদীদের মতে শিখন কোন যান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়, সমস্যামূলক পরিস্থিতির সমগ্ররূপকে উপলব্ধি করার পরেই শিখন সম্ভব। তাই এই মতবাদকে সমগ্রতাবাদের তত্বও বলা হয়। যে সমস্ত মনােবিজ্ঞানীরা যান্ত্রিক উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়ার তত্ব স্বীকার করেনা তারাই হলেন সমগ্রতাবাদী বা গেস্টাল্টবাদী। Gestalt শব্দটি একটি জার্মান শব্দ যার অর্থ হল গঠন বা কাঠামাে বা সম্পূর্ণ আকার বা অবয়ব।

কোহলার (Kohler), কফকা (Koffka) , ওয়াদিমার (Wertheimer) হলেন গেস্টাল্ট মতবাদের স্রষ্টা।

গেস্টাল্টবাদী বা সমগ্রতাবাদীদের মতে আমরা যখন কোন কিছুকে প্রত্যক্ষণ করি তখন সেটিকে খণ্ড খণ্ড ভাবে বা বিচ্ছিন্নভাবে প্রত্যক্ষ করি না সমগ্রভাবে প্রত্যক্ষ করি। যেমন – একটি সুন্দর ফুলের মালা, মালাটি বিভিন্ন ফুল দিয়ে গাঁথা হয়েছে আমরা ফুলগুলিকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখি না, কোনটি কোন ফুল না দেখে সামগ্রিকভাবে মালাটিকেই দেখি। অর্থাৎ,গেস্টাল্টবাদীদের মতে শিখন হল- সমগ্র অংশের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন করা এবং তা সম্ভব হয় একমাত্র অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে। অন্তর্দৃষ্টি – কোন সমস্যা মূলক পরিস্থিতিকে সামগ্রিকভাবে প্রত্যক্ষণের ফলে পরিস্থিতির অর্থ বুঝতে পারা হল অন্তর্দৃষ্টি এবং সেই সমস্যার সমাধান করাই হল অন্তর্দৃষ্টি মূলক আচরণ বা শিখন। অন্তর্দৃষ্টি একটি সহজাত ক্ষমতা নয়, এটি হল একটি অভিজ্ঞতালব্ধ ক্ষমতা। অন্তর্দৃষ্টির জন্য অতীত অভিজ্ঞতা এবং ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে চিন্তা উভয়ের প্রয়োজন হয়ে থাকে। গেস্টাল্টবাদীরা অন্তর্দৃষ্টি জাগরনের জন্য দুটি মানসিক প্রক্রিয়ার ওপর গুরুত্ব আরােপ করেছেন।

পৃথকীকরণ: প্রাণী যখন শিখন পরিস্থিতির মধ্যে যেগুলাে অপ্রাসঙ্গিক বা অপ্রয়ােজনীয় সেগুলিকে বাদ দিয়ে কেবল মাত্র প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যগুলি গ্রহণ করে তখন তাকে পৃথকীকরণ বলে। 

সামান্যীকরণ: ওই সাধারণ বৈশিষ্ট্য গুলির ওপর ভিত্তি করে সামান্যধর্মীয় সূত্র তৈরি করাই হল সামান্যীকরণ। গেস্টাল্ট বাদীদের মতে অন্তর্দৃষ্টি কতগুলি ধাপে সংঘটিত হয়। সেগুলি হল – 

1) শিখন পরিস্থিতি বা সমস্যাটিকে সামগ্রিকভাবে প্রত্যক্ষ করা। 
2) পরিস্থিতির অংশগুলির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় করে প্রতিক্রিয়া করা। 
3) সমস্যাটির অন্তর্নিহিত তত্ব এবং বৈশিষ্ট্য গুলির পৃথকীকরণ ও সামান্যীকরণ করা। 
4) হঠাৎ সমস্যাটির সমাধান খুঁজে পাওয়া এবং এই পর্যায়টি হল অন্তর্দৃষ্টি।

গেস্টাল্ট মতবাদের মূল সূত্র বা নীতি

থর্নডাইকের মতে প্রাণীর শিখন হয় প্রচেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে। গেস্টাল্টবাদীদের মতে প্রাণীর শিখন কোন যান্ত্রিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে হয় না। সমস্যামূলক পরিস্থিতির সামগ্রিক রূপ উপলব্ধি করার পরে প্রাণী সমস্যা সমাধান করতে পারে। তাদের মতে এই উপলব্ধি হঠাৎ করেই ঘটে। সুতরাং, গেস্টাল্টবাদিরা শিখন পরিস্থিতির সংগঠন ও তার বিভিন্ন অংশের মধ্যে সম্পর্কের উপলব্ধির ওপর বেশি জোর দিয়েছেন।

গেস্টাল্টবাদিরা সামগ্রিক প্রত্যক্ষণের কয়েকটি নীতির কথা বলেছেন। সেগুলি হল – 

1) বিচ্ছিন্নকরণের নীতি: সংগঠিত বিষয়বস্তু থেকে, প্রথমে আমরা অপ্রাসঙ্গিক বিষয়গুলি বাদ দিয়ে প্রাসঙ্গিক বিষয়কে মূল সংগঠন থেকে আলাদা করে নেই। যেমন – আমরা যখন ORION কালপুরুষ বা সপ্তর্ষিমণ্ডল দেখতে চাই তখন আকাশে অসংখ্য তারা থাকে এই অসংখ্য তারা বাদ দিয়ে আমরা শুধুমাত্র কালপুরুষ বা সপ্তর্ষিমণ্ডলকেই দেখি।

2) সাদৃশ্যের নীতি: সাদৃশ্যমূলক বিষয়বস্তু বা ধারণা গুলিকে আমরা সহজেই সংগঠিত করতে পারি বা মনে করতে পারি। বিচ্ছিন্ন বিষয়বস্তু অপেক্ষায় সাদৃশ্য বিষয়বস্তুকে আমরা সহজে মনে রাখতে পারি। গেস্টাল্টবাদীরা এই নীতির উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমন- কোন শিক্ষার্থী যদি পাটিগণিতের সুদ-আসল, সুদের-হার ইত্যাদি বিষয় গুলি আগে শিখে থাকে আর পরীক্ষায় যদি এই ধরনের কোন একটি অংক আসে তখন সে সহজেই অংকটি করতে পারে। 

3) নৈকট্যের নীতি: যে সমস্ত বিষয়বস্তুর ধারণা স্থানগত এবং সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে কাছাকাছি থাকে সেগুলিকে আমরা সহজেই মনে করতে পারি। যেমন-ভৌতবিজ্ঞানের জারণ-বিজারণ প্রক্রিয়া পড়ানাের সময় জারণ প্রক্রিয়া পড়ানাের পর আবার যদি বেশ কিছুদিন পরে বিজারণ প্রক্রিয়া পড়ানাে হয় তাহলে শিক্ষার্থীরা পূর্বের প্রক্রিয়াটি ভুলে যাবে।

4) ধারাবাহিকতার নীতি: গেস্টাল্টবাদীদের মতে শিখন হয় অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে। কিন্তু অন্তর্দৃষ্টি বিষয়বস্তুর ধারাবাহিকতা বজায় থাকলেই আসে। যে সমস্ত বিষয় বস্তুর মধ্যে ধারাবাহিকতা দেখা যায় সেগুলিকে সহজেই সংগঠিত করা যায় বা মনে করা যায়। যেমন – আলাে পড়াতে গেলে আলাের সরল রেখায় গমন, প্রতিফলন, প্রতিসরণ অভ্যন্তরীণ পূর্ণ প্রতিফলন ধারাবাহিক ভাবে পড়ানাে উচিত তবে শিক্ষার্থীদের আলাে সম্পর্কে সঠিক ধারণা তৈরি হবে। 

5) পরিমিতির নীতি: পূর্বজিত অভিজ্ঞতার সঙ্গে সমস্যামূলক পরিস্থিতির বিভিন্ন অংশের মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপন করতে পারলে শিখন লব্ধ অভিজ্ঞতাটি সুসংবদ্ধ ও সুসংহত করা সহজ হয়। যেমন- বৃত্তের ব্যাস, ব্যাসার্ধ, পরিসীমা জানা থাকলে পরবর্তীকালে বৃত্তের ক্ষেত্রফল সম্পর্কে জানা অনেক সহজ হয়। কারণ পূর্ব অর্জিত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বিষয়টিকে সহজেই শেখা যায়।

উপরিউক্ত সামগ্রিক প্রত্যক্ষনের নীতিগুলি ব্যবহৃত হয়। প্রথম দিকে সমগ্রতাবাদীরা অন্তর্দৃষ্টিকে হঠাৎ ‘প্রত্যক্ষণ’ বলে বর্ণনা করেন। কিন্তু পরে বার্নার্ড, হিলগার্ড মন্তব্য করেন, অন্তর্দৃষ্টি হঠাৎ কোনাে প্রত্যক্ষণ নয়। উদ্দেশ্য মুখি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এর বিকাশ ঘটে। বার্নার্ড এর মতে – “The perception of functional unity often thought to be sudden but actually the result of continuous growth and development” অর্থাৎ অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ধরনের প্রত্যক্ষণকে হঠাৎ বলে মনে হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর কারণ হল বৃদ্ধি ও বিকাশ। প্রাণীর অন্তর্দৃষ্টির কার্যকারিতা নির্ভর করে কতগুলি বৈশিষ্ট্যের উপর। যেমন – 

a) মানসিক ক্ষমতা বা বুদ্ধি। 
b) পূর্ব অভিজ্ঞতা। 
c) শিক্ষনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা। 
d) শিক্ষার্থী সক্রিয় অংশগ্রহণ।

আরো পড়ুন

থর্নডাইকের শিখনের মূলসূত্র গুলি কি কি | Thorndike’s Theory of Learning

মেকলে মিনিট কি | Macaulay Minute in Bengali

লর্ড কার্জনের শিক্ষানীতি | Lord Curzon-Educational Policy in Bengali

স্পিয়ারম্যানের দ্বি-উপাদান তত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো

ব্যক্তিত্বের অভীক্ষা বা পরিমাপ | Measurement of Personality in Bengali

Leave a Comment

error: Content is protected !!