মাসলোর চাহিদার ক্রমপর্যায় তত্ত্ব | Maslow’s Needs Hierarchy Theory of Motivation in Bengali

মাসলোর চাহিদার ক্রমপর্যায় তত্ত্ব | Maslow’s Needs Hierarchy Theory of Motivation in Bengali

উত্তর:

মাসলোর চাহিদার ক্রমপর্যায় তত্ত্ব

চাহিদার ক্রমপর্যায় তত্ত্বের প্রবক্তা হলেন আব্রাহাম মাসলো (Abraham Maslow)। ব্যক্তির চাহিদা ও তা পূরণ – যা ব্যাক্তির প্রেষণার উপর বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করে। ব্যক্তির উপর দুটি শক্তি ক্রিয়াশীল। একটি ব্যক্তির বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং অপরটি বৃদ্ধিতে বাধা দেয়। প্রথমটি ব্যক্তির মধ্যে আত্মশক্তি, আত্মপ্রত্যয়, নিজস্বতা, ক্ষমতা ইত্যাদিকে শক্তিশালী করে এবং বিরোধী শক্তিকে প্রতিহত করে। দ্বিতীয়টি ব্যক্তির বৃদ্ধিতে বাধা দেয়, তাকে আতঙ্কগ্রস্থ করে তোলে, সুযোগ গ্রহণ করতে ভীত করে তোলে এবং নিজস্বতাকে বাধা দেয়। মাসলো তার তত্ত্বে ব্যাক্তি চাহিদাকে একটি পিরামিডের আকারে প্রকাশ করেছেন। যার পাঁচটি স্তর রয়েছে। এই পিরামিডের সবচেয়ে নিচের স্তরে রয়েছে অস্তিত্ব রক্ষার চাহিদা বা শারীরবৃত্তীয় চাহিদা। যার মধ্যে রয়েছে খাদ্য, জল, আশ্রয়, নিদ্রা ইত্যাদি। দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে নিরাপত্তা চাহিদা, যা দৈহিক বা মানসিক উভয় প্রকার হতে পারে। সুরক্ষা, ভয় থেকে মুক্তি, অস্তিত্ব ইত্যাদি নিরাপত্তা চাহিদার অন্তর্গত।

মাসলোর চাহিদার ক্রমপর্যায় তত্ত্ব
মাসলোর চাহিদার ক্রমপর্যায় তত্ত্ব

তৃতীয় স্তরে রয়েছে ভালোবাসা ও একাত্মতার চাহিদা। চতুর্থ স্তরে রয়েছে আত্ম শ্রদ্ধা বা আত্মসম্মানের চাহিদা এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে আত্মপ্রতিষ্ঠা বা আত্মপ্রকাশের চাহিদা। এই সমস্ত চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ধরনের প্রেষণার সৃষ্টি হয়। মাসলোর মতে, প্রত্যেক মানুষ চায় তার মধ্যে যে সমস্ত ক্ষমতা ও সুপ্ত সম্ভাবনা রয়েছে তার বাস্তবায়ন।

1) শারীরবৃত্তীয় চাহিদা (Physiological Needs) : মানুষের বেঁচে থাকার জন্য কতগুলি চাহিদা পূরণের প্রয়োজন। এই চাহিদা গুলিকে শারীরবৃত্তীয় চাহিদা বলে। এই চাহিদা গুলি হল জল, আলো, বাতাস, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা ইত্যাদি। জন্মের সময় থেকেই শিশুর মধ্যে এই চাহিদাগুলি থাকে। এই চাহিদাগুলো পূরণ না হলে পরবর্তী চাহিদা পূরণের জন্য প্রেষণার সৃষ্টি হবে না।

শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ রচনা করার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে শিক্ষার্থীর মধ্যে শারীরবৃত্তীয় চাহিদাগুলি সঠিকভাবে পূরণের ব্যবস্থা হয়েছে কি না। যদি শারীরবৃত্তীয় চাহিদাগুলি পূরণ না হয় তাহলে শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় প্রেষণার সঞ্চার হবে না। এটি হল প্রাথমিক চাহিদা।

তাই বর্তমানে সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলিতে 14 বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের জন্য মধ্যাহ্ন কালীন আহার, পোশাক, বিনামূল্যে বই, এমনকি রক্তাল্পতা দূরীকরণের জন্য আয়রন ট্যাবলেট বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এইসবের মূল উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক চাহিদা গুলি পূরণ করা। যাতে তাদের মধ্যে পরবর্তী পর্যায়ে চাহিদাগুলি পূরণের জন্য প্রেষণার সৃষ্টি হয়।

2) নিরাপত্তার চাহিদা (Safety Needs) : মাসলোর মতে, শারীরবৃত্তীয় চাহিদার মত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা হল নিরাপত্তার চাহিদা। সুরক্ষা, অস্তিত্ব, ভয় থেকে মুক্তি, উদ্বেগ হীনতা, সংহতি, সুস্পষ্টতার চাহিদা ইত্যাদি নিরাপত্তার চাহিদার অন্তর্গত। বাস্তবে লক্ষ্য করে দেখা গেছে যে কোন ব্যাক্তি বা শিক্ষার্থীর মধ্যে যদি শৃঙ্খলার অভাব থাকে, স্থায়িত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন থাকে, বিভিন্ন ধরনের মানসিক দুশ্চিন্তা থাকে তাহলে সে সর্বক্ষণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে। কোন কাজের প্রতি উৎসাহ পায় না। তার মধ্যে পড়াশোনা বা অন্যান্য কাজের জন্য প্রেষণা জাগানো সম্ভব হয় না। তাই প্রত্যেক ব্যাক্তির নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য।

শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী যদি শিক্ষককে ভয় পায়, শিক্ষক যদি সঠিক উপদেশ না দেয়, শিক্ষকের মধ্যে যদি সহযোগিতা বা সহমর্মিতা মূলক মনোভাবের অভাব থাকে, তবে শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করে। ফলে শিক্ষার্থীরা শিখনে তেমন আগ্রহী হয় না। একইভাবে সহপাঠীরা যদি শিক্ষার্থীর প্রতি অমানবিক আচরণ করে তাহলে শিক্ষার্থীর মধ্যে নিরাপত্তার অভাব দেখা যায়। যা শিক্ষার্থীর প্রেষণা সৃষ্টিতে বাধার সৃষ্টি করে।

শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষক, সহপাঠী ও অভিভাবক সকলের সহযোগিতামূলক আচরণ শিক্ষার্থীর মানসিক শক্তি বাড়িয়ে দেয়। ঠিক তেমনি অসহযোগিতামূলক আচরণ শিক্ষার্থীর শিক্ষাক্ষেত্রে প্রেষণা সৃষ্টিতে বাধার সৃষ্টি করে। এই কারণে একজন শিক্ষার্থীর জন্য শ্রেণীকক্ষের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও সহপাঠীদের সহযোগিতামূলক ও সহমর্মিতা মূলক আচরণ বিশেষ ভাবে কাম্য।

3) ভালোবাসা ও একাত্মতার চাহিদা (Love & Belonging Needs) : মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। ভালোবাসা, একাত্মতাবোধ প্রভৃতি সামাজিক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে যে প্রেষণার সৃষ্টি হয় তাদের সামাজিক প্রেষণা বলে। এই প্রেষণা প্রত্যেক ব্যক্তিকে সামাজিক আদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে আচরণ সম্পাদনে প্রবৃত্ত করে। শিক্ষার্থীর জীবনে সামাজিক চেতনা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের প্রেষণার বিকাশ শুরু হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষিকারা শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই ধরনের চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করবেন।

4) আত্মশ্রদ্ধা বা আত্মসম্মানের চাহিদা (Esteem Needs) : মাসলোর মতে, ‘All people need a stable, firmly based high evaluation of themselves’ অর্থাৎ, প্রত্যেক ব্যক্তি চায় অন্যরা তাকে ব্যক্তি হিসেবে যথাযথ গুরুত্ব দিক। আত্মসচেতনতাকে কেন্দ্র করে ব্যক্তির এই চাহিদা গড়ে ওঠে। এই চাহিদা থেকেই আত্মসম্মানের প্রেষণা গড়ে ওঠে। আত্মশ্রদ্ধার প্রেষণা জাগ্রত হলে ব্যক্তির আত্মমর্যাদার চাহিদা দেখা দেয় এবং আত্মসম্মান রক্ষার জন্য সচেতন হয়। প্রথমদিকে এই চাহিদা বাবা, মা, অভিভাবক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলেও বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেকে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত রাখতে চায়। যার ফলে সে অপরের ভালোবাসা ও মর্যাদা লাভ করে।

বিদ্যালয় স্তরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই প্রেষণা সঠিকভাবে জাগ্রত করতে পারলে শিক্ষার্থীরা পঠন-পাঠনে ও সামাজিক কল্যাণমূলক কাজে অগ্রসর হয়, জীবনে সাফল্য লাভের উচ্চতর চাহিদা পূরণের জন্য সচেষ্ট হয়। শিক্ষকের কর্তব্য হল শিক্ষার্থীর মধ্যে যাতে তাদের যোগ্যতা, আত্মসম্মানবোধ সম্পর্কে সঠিক ধারণা জন্মে সেদিকে নজর দেওয়া। এছাড়াও সহপাঠীরা যাতে একে অপরকে যথাযথ মর্যাদা দেয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা।

5) আত্মপ্রতিষ্ঠার চাহিদা (Self actualization) : ব্যক্তিগত চাহিদার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য চাহিদা হল আত্মপ্রতিষ্ঠার চাহিদা। মাসলোর চাহিদা পিরামিডের সর্বোচ্চ স্তরে স্থান পেয়েছে। এই চাহিদার সঙ্গে যুক্ত প্রেষণাকে আত্মপ্রতিষ্ঠা বা আত্মপ্রকাশের প্রেষণা বলে। প্রত্যেক ব্যক্তি চায় তার মধ্যে যে অন্তর্নিহিত শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা রয়েছে তার পরিপূর্ণ বিকাশ। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে আত্মপ্রকাশের চাহিদা রয়েছে। তবে এই ধরনের চাহিদাকে কেন্দ্র করে প্রেষণা সৃষ্টি করার জন্য ব্যক্তির অন্যান্য চাহিদাগুলিও পরিতৃপ্ত হওয়া দরকার। এই ধরনের প্রেষণার প্রসারতা কৈশোরে সবচেয়ে বেশি হয়।

এই চাহিদা বা তার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রেষণা ব্যক্তিকে আরো বেশি অনুপ্রাণিত করে, ফলে নিজেকে আরও বেশি করে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রেষণা শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাগ্রত করতে পারলে ভালো শিক্ষার্থী আরো ভালো ফল করার চেষ্টা করে।

শিক্ষকের কর্তব্য হল শিক্ষার্থীদের আচরণ অনুধাবন করা এবং তাদের আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য উৎসাহিত করা।

আত্মশ্রদ্ধা বা আত্মসম্মান ও আত্মপ্রকাশ বা আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রেষণা শিক্ষা দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই প্রেষণা দ্বারা সৃষ্ট কাজ ব্যক্তিকে যেমন তার ব্যক্তিগত চাহিদা পূরণে সাহায্য করে, তেমনি তার সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করে।

মাসলোর প্রেষণা সম্পর্কিত চাহিদার ক্রমপর্যায় বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কোন একটি চাহিদার সঠিক পরিতৃপ্ত না ঘটলে শিক্ষার্থীর শিক্ষা ব্যাহত হবে। শিক্ষার্থী তার সঠিক লক্ষ্যে পৌছাতে পারবে না। তাই শিক্ষকের কর্তব্য হল এমন শিক্ষা পরিবেশ গড়ে তোলা যাতে শিক্ষার্থীর পর্যায়ভিত্তিক চাহিদা পূরণ হয় এবং প্রেষণা গুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে।

আরো পড়ুন

এরিকসনের মনোসামাজিক বিকাশের তত্ত্ব | Eriksons psychosocial devlopment theory in Bengali

অধিবিদ্যা কি | এরিস্টটলের অধিবিদ্যা | দার্শনিক আলোচনায় অধিবিদ্যা | Metaphysics in Bengali

স্যাডলার কমিশন (Sadler Commission) | স্যাডলার কমিশনের সুপারিশ

শিক্ষার পরিধি গুলি আলোচনা করো

প্রকৃতিবাদ কাকে বলে | শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকৃতিবাদী দর্শনের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করো

সনদ আইন (1813) | সনদ আইনের উদ্দেশ্য | সনদ আইনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

Leave a Comment

error: Content is protected !!