ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর | Brahmanical System of Education in Bengali
উত্তর:
ভারতবর্ষ এক বিচিত্র দেশ। বিবিধের মধ্যে মিলনই ভারতীয় সংস্কৃতির মূলকথা। এই সভ্যতায় যেমন আর্য, অনার্য প্রভৃতি বিচিত্র জাতের বাসভূমি তেমনি বিচিত্র তার শিক্ষা ধারা ও পদ্ধতি। শিক্ষা দীক্ষায়, জ্ঞান বিজ্ঞানে ও গৌরব গাথায় এর সমতুল্য দেশ অতি বিরল। এই ভারতবর্ষেই অতি প্রাচীন কাল থেকে প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক শিক্ষার সূত্রপাত হয়েছিল। বস্তুত পৃথিবীর যে সব দেশে প্রথম সু-পরিকল্পিত ও উন্নত মানের শিক্ষার প্রবর্তন হয় ভারত তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রাচীন ভারতীয় এই শিক্ষা ব্যবস্থা জীবন দর্শন ও সমাজের নানা প্রয়োজনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। ভারতীয় সভ্যতার জনগণের শিক্ষার মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে আর্য ও অনার্য শিক্ষা সংস্কৃতির সমন্বয়ে গড়ে ওঠে ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থা।
ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থা :
ভারতে বর্ণাশ্রম ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় চার বর্ণের মধ্যে ব্রাহ্মণ বা পুরোহিত সম্প্রদায় শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপারে প্রধান দায়িত্ব পালন করতেন। আর্য জাতির প্রথম অবদান হল বেদ। মনে করা হত বেদ ব্রাহ্মণবাদী। বেদকে কেন্দ্র করে নুতন যে শিক্ষা ব্যবস্থা বিকাশ লাভ করতে থাকে যার উপর ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়, তাকেই ব্রহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থা বলা হয়।
শিক্ষার লক্ষ্য : ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থার চরম লক্ষ্য ছিল অর্জিত, পার্থিব জীবন থেকে মহামুক্তি লাভ করা এবং ত্যাগ ও ব্রহ্মচর্যের আদর্শকে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নের পথে অগ্রসর করা। তাছাড়া মোক্ষ লাভ, আত্মপোলব্ধি ,চরিত্র গঠন, ব্যক্তি সত্তার বিকাশ ইত্যাদি শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য ছিল।
বিদ্যার সূচনা : ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থার মূল ভিত্তি ছিল ধর্ম। কারণ ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থা ধর্মকে প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় হিসাবে গ্রহণ ও আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে। ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষারম্ভে শিক্ষার্থীকে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিক রীতিনীতি পালন করতে হত। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে বর্ণের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটানো হতো। এ ভাবেই বিদ্যারম্ভের সূচনা হত। এই অনুষ্ঠান ৫ বছর বয়সে সম্পন্ন হত।
উপনয়ন : বিদ্যা আরম্ভের পর শিক্ষার্থীর উপনয়নের মাধ্যমে শিক্ষাদান শুরু হত। শিক্ষার্থীকে গুরুগৃহে উপনয়নের পরে ব্রহ্মচর্য ও সংযোমী আচরণ পালন করতে হত। ব্রাহ্মণদের ৬ বছর থেকে, ক্ষত্রিয়দের ১১ বছর থেকে এবং বৈশ্যদের ১২ বছর থেকে উপনয়ন হত। তবে শুদ্রদের ক্ষেত্রে উপনয়নের রীতি নীতি প্রচলিত ছিল না।
পাঠ্যক্রম : ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থায় যেহেতু শ্রেণি বিভাজন ছিল। ফলে তাদের পাঠক্রম অভিন্ন ছিল না। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের জন্য স্বাতন্ত্র পাঠ্যক্রমের প্রচলন ছিল। এর মূলে ছিল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের পেশাগত পার্থক্য। যেহেতু ব্রাহ্মণরা পূজার্চনা করত সেহেতু তাদের বেদ, উপনিষদ ও অন্যন্য শাস্ত্র, দর্শন, সাহিত্য, ব্যাকরণ, নক্ষত্র বিদ্যা, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয় পড়ানো হত। ক্ষত্রিয়দের প্রধান কাজ ছিল দেশশাসন করা। ফলে তাদের অস্ত্র বিদ্যা, রাজ্যশাসন, ইতিহাস, পুরাণ নীতিশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র, যুদ্ধবিদ্যা প্রভৃতি বিষয় পড়ানো হতো। বৈশ্যদের প্রধান কাজ ছিল ব্যবসা বাণিজ্য। ফলে ব্যবসা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় যেমন দ্রব্য সংরক্ষণ, ক্রয় বিক্রয়ের নিয়ম, মূল্য নির্ধারণ, বিভিন্ন দেশের ভৌগলিক অবস্থান, বিভিন্ন দেশের মূদ্রা প্রভৃতি বিষয় সম্বন্ধে শিক্ষা দান করা হত। শুদ্ররা ছিল সমাজের সব থেকে নিম্ন শ্রেণি। তাদের পুরাণ পাঠ করতে হতো। এছাড়া তাদের কৃষি সংক্রান্ত বিষয়, পশুপালন ও দৈহিক পরিশ্রম সংক্রান্ত বিষয় সম্বন্ধে শিক্ষা দান করা হত।
শিক্ষালয় : সে সময় এখনকার মতো বিদ্যালয় গৃহ ছিল না। শিক্ষার্থীরা প্রকৃতির উন্মুক্ত পরিবেশে তপোবনের ছায়ায় মুনি ঋষিদের আশ্রমে শিক্ষা গ্রহণ করত। শিক্ষা লয় গুলি ছিল আবাসিক, অবৈতনিক ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক। সমাজ ও রাষ্ট্রের পৃষ্ঠ পোষকতার উপর শিক্ষাব্যবস্থা নির্ভরশীল ছিল। একজন গুরুকে কেন্দ্র করে এক একটি শিক্ষালয় গড়ে উঠত। এ ছাড়া সন্মেলন স্থান, অথবা পন্ডিত মন্ড সমবেত স্থান ও শিক্ষালয়ের ভূমিকা পালন করত।
শিক্ষাদান পদ্ধতি : ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল মৌখিক। গুরুর মুখ থেকে শুনে শুনে তা আয়ত্ত করতে হতো। কখনো কখনো গুরু গম্ভীর বিষয় সম্পর্কে বিতর্ক সভার আয়োজন করত। দলগত ও ব্যক্তিগত আলোচনার মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হত।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক : শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর। বলা যেতে পারে গুরু ও শিষ্যের সম্পর্ক ছিল পিতা পুত্রের মতো। গুরু শিষ্যের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনের জন্য তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক সামীপ্য, সাযুজ্য ও সম্পর্ক স্থাপনের উপর গুরুত্ব দেওয়া হত। শিক্ষার্থীরা গুরুর আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করত। তারা গুরুর সেবা নিয়োজিত হত। গুরুও প্রসন্ন চিত্তে তাদের স্নেহ ভালবাসা দিয়ে শিক্ষা দান করত।
শৃঙ্খলা ও নিয়মনিষ্ঠা : গুরু শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু নিয়মাবলী প্রস্তুত করতো। শিক্ষার্থীদের তা মেনে চলতে বাধ্য থাকতে হত। তার মধ্যে অন্যতম ছিল ভিক্ষা করা, প্রাতঃকালে ঘুম থেকে ওঠা, দিবানিদ্রা পরিহার করা, মদ্য পান জুয়া খেলা, প্রেমালাপ থেকে বিরত রাখা, সত্যের অনুরাগী হওয়া। শিক্ষার্থীরা গুরুর বেধে দেওয়া নিয়ম শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হত। যেমন বেত্রাঘাত, উপবাস ও পরিশেষে গুরু গৃহ থেকে নির্বাসন।
সমাবর্তন : ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন সম্পন্ন হত সমাবর্তন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। এই অনুষ্ঠান ছিল মুলত গুরুগৃহ থেকে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তনের অনুষ্ঠান। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আচার্যের অনুমতি নিয়ে শিক্ষার্থীকে স্নান করিয়ে, নুতন পোষাক পরিয়ে পন্ডিত মন্ডলীর সামনে তাকে স্নাতক বলে ঘোষণা করা হত এবং তাকে ভবিষ্যত জীবনকে সুশৃঙ্খল ভাবে পরিচালিত করার জন্য তাকে মূল্যবান জ্ঞান প্রদান করা হত। শিক্ষার্থী সেই উপদেশ গুলোকে ভবিষ্যত জীবনে মেনে চলার আশ্বাস প্রদান করতো।
মন্তব্য : ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের নৈতিক মানের উন্নয়ন, চরিত্র গঠন, নিয়মানুবর্তিতা, নম্রতা, ভদ্রতা ও মানবিক গুণের বিকাশ ঘটানোর প্রচেষ্টা করা হত যে গুলি এক জন শিক্ষার্থীর জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ ও ভবিষ্যত জীবনকে সর্বাঙ্গীণ সুন্দর করতে সাহায্য করে।
আরো পড়ুন
মধ্যযুগের শিক্ষা ব্যবস্থা বা ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থা | Islamic Education During Medieval Period
বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করো | Buddhist Education System in Bengali
স্যাডলার কমিশন (Sadler Commission) | স্যাডলার কমিশনের সুপারিশ
প্রকৃতিবাদ কাকে বলে | শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকৃতিবাদী দর্শনের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করো
সনদ আইন (1813) | সনদ আইনের উদ্দেশ্য | সনদ আইনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য