শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো
উত্তর:
শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার গুরুত্ব
আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার প্রধান ও প্রথম উপাদান হল শিশু বা শিক্ষার্থী। যে শিক্ষা ব্যবস্থার সমগ্র আয়োজনই শিশুর জীবন বিকাশের জন্য পরিকল্পিত ও পরিচালিত হয় সেই শিক্ষা ব্যবস্থাকে শিশু কেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা বলা হয়।
শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার গুরুত্ব আলােচনা করলে আমরা দেখতে পাই শিশুই হল এই শিক্ষার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। শিশুর ব্যক্তিত্বের বিকাশ, তার আগ্রহ, চাহিদা প্রভৃতির বিকাশ ঘটানােই হল শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার মূল বৈশিষ্ট্য। প্রাচীনকালে মনে করা হতাে মানব শিশু হল জন্ম পাপী। পূর্ব জন্মের পাপ কাজ করার ফলস্বরূপ এই জন্মে মানব শিশু হিসেবে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছে। তার পিতা-মাতা ও শিক্ষক-শিক্ষিকারা এই জন্ম পাপী শিশুদের মানুষ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতাে, কঠিন শাসন-শৃঙ্খলা ও নিয়মের মধ্য দিয়ে। তাদের সহানুভূতিহীন বিদ্যালয় পরিবেশে বিভিন্ন বিষয় পাঠ করতে হত। তার শিক্ষক ও পিতা-মাতার বিভিন্ন কাজকর্ম অন্ধভাবে অনুসরণ করতাে।
তাই তখন শিক্ষা ছিল শিশুর কাছে নিরস, অন্তঃসারশূন্য ও যান্ত্রিক বিষয়। পরবর্তীকালে মনােবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানের কল্যাণে শিশুই হল শিক্ষার কেন্দ্র বিন্দু। শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা গুলােকে স্বাভাবিকভাবে সমাজের অভিমুখী করে বিকশিত করতে সহায়তা করাই হল শিক্ষার অন্যতম কাজ। শিক্ষকের কাজ হল এখানে বাগানের মালির মতাে। গাছ যেমন বাগানে উপযুক্ত মাটি পেলে একা একাই স্বাভাবিক নিয়মে বেড়ে ওঠে। তেমনি শিশুরাও স্বাভাবিক নিয়মে বেড়ে ওঠবে বড়দের নিয়ম অনুসরণ করবেনা। শিশুদের মানসিক জগত স্বতন্ত্র এক জগত। তাই তাদের দৈহিক, মানসিক সামর্থ অনু্যায়ী শিক্ষা পরিচালিত হবে। আধুনিক শিক্ষা শিক্ষার্থীর চাহিদা ও প্রকৃতি অনুযায়ী পরিকল্পিত। তাই এই শিক্ষাকে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা বলা হয়। এই শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায় এখানে বিভিন্ন চিন্তা ধারার মধ্যে সমন্বয় ঘটেছে। এগুলি হল – i) দার্শনিক ভিত্তি, ii) মনােবৈজ্ঞানিক ভিত্তি, iii) জীববিদ্যা মুলক, iv) সমাজতত্বমূলক।
i) দার্শনিক ভিত্তি :
দার্শনিক চিন্তাধারা থেকে বলা হয়েছে শিশুর ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধনই হল শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। ভাববাদী দার্শনিকরা শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় স্বাধীনতার ধারণাটি পূর্ণ সমর্থন করেন। শিশুর বিকাশের জন্য তাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। তারা মনে করেন অবাধ স্বাধীনতার মধ্য দিয়েই শিশুর ব্যাক্তিস্বত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন সম্ভব। প্রকৃতিবাদীরা মনে করেন শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ একমাত্র শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার মধ্যে দিয়েই হতে পারে। প্রয়োগবাদী দার্শনিকরা শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীর স্বাধীনতা, স্বকীয়তা, যৌথকর্ম, খেলাধুলা, সৃজনশীলতা, সামাজিক অনুষ্ঠান ইত্যাদিকে পূর্ণ সমর্থন করেছেন। প্রয়োগবাদী দার্শনিক জন ডিউই (Dewey) এর মতে শিক্ষা হল বিকাশের প্রক্রিয়া, সামাজিক উৎকর্ষণের উপায় এবং অভিজ্ঞতার পুনসংগঠনের মাধ্যম। তিনি শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন, কিন্তু সমাজের চাহিদাকে উপেক্ষা করেননি। শিশুর মানসিক বৈশিষ্ট্য এবং সামাজিক চাহিদার উভয়ের উপর গুরুত্ব দিয়ে পাঠক্রম রচনার কথা বলেছেন।
ii) মনােবৈজ্ঞানিক ভিত্তি :
উনবিংশ শতাব্দীতে মনস্তত্বের ব্যাপক গবেষণার ফলে শিশুর আচরণ ও প্রকৃতি সম্বন্ধে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন ঘটে। শিশু কোন কাদামাটি নয় যে শিক্ষক তাঁর শিল্পী মন দিয়ে তার অভিরুচি অনুযায়ী শিশুকে গড়ে তুলবেন। এতদিন আমাদের কাছে শিশুর মন ছিল উপেক্ষিত ও অবিবেচিত। প্রাচীনকালে শিশুরা বড়দের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ বলে বিবেচনা করা হত। শিক্ষক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে শিশুদের বড় করে তুলতেন। শিক্ষক ছিলেন বড়দের কাছে পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি এবং ছােটদের কাছে সাক্ষাৎ যমদূত এর মত। কিন্তু মনােবিদ্যার মাধ্যমে পরবর্তীকালে শিশু সম্পর্কে ধারণার পরিবর্তন ঘটে। মনােবিজ্ঞান শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার ব্যক্তিগত বৈষম্যের নীতির পূর্ণ সমর্থক। স্মৃতি, মনােযােগ, বুদ্ধি, প্রক্ষোভ, প্রবৃত্তি সম্পর্কে বহু মূল্যবান তথ্যের দ্বারা মনােবিজ্ঞান শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষাকে সহায়তা করেছে। শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার কাজ হল শিশুর আগ্রহ, চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষার ব্যবস্থা করা। ফ্রয়েবেলের মতে, শিশু জন্ম থেকেই সব গুন নিয়ে জন্মায়। শিক্ষার লক্ষ্য হল তার এই গুণাবলীর সম্যক উন্মেষ সাধন করা।
iii) জীববিদ্যা মুলক :
জীব বিদ্যা শিশুর আচরণকে বিবর্তনের ধারায় ব্যাখ্যা করে। শৈশবকালে একজন শিশুর সমস্ত সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তাঁর জীবনের বিভিন্ন আচরণের মধ্য দিয়ে তা দেখা দিতে থাকে। শিশুর জীবন বিবর্তনের ধারায় যে সমস্ত প্রধান প্রধান অভিজ্ঞতা ও আচরণ দেখা দেয় সেগুলােই হল শিশুর পাঠ্য বিষয়। জীব বিদ্যা শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় নানা প্রকার খেলাধুলা, বালি মাটি নিয়ে বাড়ি তৈরি, ছবি আঁকা, শিল্প কাজ করা ইত্যাদির পূর্ণ সমর্থন করে। এইসব খেলাধুলার মধ্য দিয়ে শিশুরা তাদের পূর্বপুরুষদের আচরণ পুনরাবৃত্তি করে। তাদের সক্রিয়তা বাড়ে এবং কল্পনা শক্তির বিকাশ ঘটে।
iv) সমাজতত্ব মূলক :
সমাজবিদ্যা শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার প্রয়ােজনীয়তা বিশেষভাবে শিকার করে। সমাজের চাহিদার সঙ্গে শিক্ষার্থীর চাহিদার সুষ্ঠু সামঞ্জস্য বিধান করাই হল শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার মূল লক্ষ্য। শিক্ষা হল একটি সামাজিক প্রক্রিয়া। শিক্ষার্থীরা যাতে সামাজিক পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা তার চেষ্টা করে। আর বিদ্যালয় হল সমাজের ক্ষুদ্র সংস্করণ, এই বিদ্যালয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বৃহত্তম সমাজে প্রবেশ করতে পারে।
সুতরাং, সব দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার আবশ্যকতা সকলেই স্বীকার করেন। শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার জনক রুশাে প্রথম শিক্ষাক্ষেত্রে শিশু স্বাধীনতার কথা দাবি করেন। তার মতে শিক্ষার জন্য শিশু নয়, শিশুর জন্য শিক্ষা। তাই শিশুকে শিক্ষা দিতে হলে শিক্ষককে সবার প্রথমে শিশুর মনকে জানতে হবে। তিনি বলেন “child is a book which the teacher has to learn from page to page”।
রুশাে তার এমিল (Emile) গ্রন্থে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য কি হওয়া উচিত তা বর্ণনা করেছেন। পরবর্তীকালে তার ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বহু দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ যেমন, পেস্তালৎসী, ফ্রয়েবেল, জোহান ফ্রেডরিক হার্বাট, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গান্ধীজী, মাদাম মারিয়া মন্তেশ্বরী প্রমূখ শিক্ষাবিদগণ শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার দাবি করেন।
আরো পড়ুন
শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা কী ও তার বৈশিষ্ট্য | Characteristics of Child-Centric Education in Bengali
গিলফোর্ডের SOI মডেল বা বুদ্ধির ত্রিমাত্রিক তত্ত্ব
স্যাডলার কমিশন (Sadler Commission) | স্যাডলার কমিশনের সুপারিশ
প্রকৃতিবাদ কাকে বলে | শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকৃতিবাদী দর্শনের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করো
সনদ আইন (1813) | সনদ আইনের উদ্দেশ্য | সনদ আইনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য