বাংলা শিশু সাহিত্যে সত্যজিৎ রায়ের অবদান

প্রশ্ন: বাংলা শিশু সাহিত্যে সত্যজিৎ রায়ের অবদান
অথবা, বাংলা শিশু সাহিত্যের ইতিহাসে সত্যজিৎ রায়ের কৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো।

উত্তর:

বাংলা শিশু সাহিত্যে সত্যজিৎ রায়ের অবদান

বিশ্ববরণে চলচ্চিত্র প্রতিভা, জ্ঞান বিজ্ঞান চিত্রকলা সংস্কৃত জগতের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র ‘ভারতরত্ন’ সত্যজিৎ রায় শিশু কিশোর এবং বয়স্কদের জন্য যে সাহিত্য সম্ভার গড়ে তুলেছিলেন, তাকে আমরা কর্নিশ জানাই। বাংলা শিশু সাহিত্য যাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সত্যজিৎ রায় বাংলা শিশু সাহিত্যে এক খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব।

সত্যজিৎ রায়
সত্যজিৎ রায়

উপেন্দ্রকিশোর ঘরানার সার্থক উত্তরসূরী ছিলেন সত্যজিৎ রায়। প্রথম দিকে বিদেশী কবিতার অনুকরণে কয়েকটি সহজ, সরল ছড়া সন্দেশের পাতায় লিখেছিলেন তিনি। যেমন- 

“পাগলা গোরু সামলানো যা ঝক্কি

আমার কথা শুনবে কোন লোক কি?”

তবে সত্যজিৎ নামটা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই যার কথা শিশুদের কাছে প্রথম ভেসে ওঠে তিনি বাংলা সাহিত্যের অমর গোয়েন্দা চরিত্র প্রদোষ মিত্র ওরফে ফেলুদা। রহস্য সমাধানের সিদ্ধহস্ত সেই সাহস, সততা, নিয়মানুবর্তিতা এবং মগজাস্ত্রের অধিকারী ফেলুদাকে নিয়ে সত্যজিৎ একে একে লিখে ফেললেন – ‘বাদশাহী আংটি’, ‘গ্যাংটকে গন্ডগোল’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘বাক্স রহস্য’, ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’, ‘রয়েল বেঙ্গল’ রহস্য’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ‘গোরস্থানে সাবধান’ ‘যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে’, এর মতো একাধিক কাহিনী। অবিস্মরণীয় সৃষ্টি এই কাহিনিগুলি মূলত নন বয়স্কদের জন্য প্রকাশিত হলেও দ্রুত তা কিশোর সাহিত্যে স্থান করে নেয়। অনতিদীর্ঘ, ঋজু, নিরলঙ্কিত, ইংরাজি শব্দ মিশ্রিত বাক্যগুলির সঙ্গে চরিত্র ও পরিবেশের নিযুক্ত বর্ণনা গোয়েন্দা কাহিনিগুলিকে সজীব ও প্রাণবন্ত করে তুলেছিল। বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা চরিত্রের অভাবনা থাকলেও ফেলুদা পঞ্চাশ বছর অতিক্রম করে ও বেশ সময়োপযোগী চরিত্র।

সত্যজিৎ রায়ের লেখা কিশোর চরিত্র উপযোগী অন্য কাহিনী প্রোফেসর শঙ্কুকে নিয়ে। ১৯৬১ খ্রিঃ সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত ব্যোমযাত্রীর ডায়েরি বই সিরিজের প্রথম গল্প। এরপর ১৯৮৩ পর্যন্ত একে একে এসেছে শঙ্কু সংক্রান্ত ৬টি গ্রন্থ- ‘প্রোফেসর শঙ্কু’, ‘প্রোফেসর শঙ্কুর কাণ্ডকারখানা’, ‘সার্কাস প্রোফেসর শঙ্কু’, ‘মহাসঙ্কটে শঙ্কু’ ‘স্বয়ং প্রফেসর শঙ্কু’, ‘শঙ্কু একাই একশো’। গ্রন্থগুলিতে তিরিশটির মতো গল্প সংকলিত হয়। প্রোফেসরের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি ভঙ্গি, নির্মল মানসিকতা, নানা বৈজ্ঞানিক যন্ত্র ও ওষুধের উদ্ভাবন, আমাদের চমকিত ও কৌতূহল মন্ডিত করে তোলে। ‘সব মিলিয়ে প্রোফেসর শঙ্কু আজও আমাদের মণিকোঠায় চির ভাস্বর।

যে চলচ্চিত্র জগতের জন্য আজ তার বিশ্বজোড়া খ্যাতি সেই চলচ্চিত্রের অনেক জায়গাতেই ছোটদের জন্য তিনি ভেবেছেন। ‘পথের পাঁচালী’র অপু দুর্গার মতো হীরক রাজার দেশে গুপী গাইন বাঘা বাইনের গানগুলি আজও শিশুদের মনকে দোলা দিয়ে যায়। “মহারাজা, তোমারে সেলাম, ‘আহা, কী আনন্দ আকাশে বাতাসে”” আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে। তেমনি মনে পড়ে-

‘লেখাপড়া করে যেই / গাড়িচাপা পড়ে সেই’। কিংবা ‘দড়ি ধরে মারো টান / রাজা হবে খান খান’।

– জাতীয় চলচ্চিত্রের সংগীত এবং সংলাপগুলি যার চিত্রনাট্য রচিত হয়েছিল সত্যজিতের হাতে।

তেমনি অবাক করা বিস্ময় মোল্লা নাসিরুদ্দিনের

গল্পগুলি। হাস্য পরিহাসগুলো হয়তো নতুন নয়, কিন্ত সত্যজিতের পরিবেশনের গুনে মজার কাহিনিগুলি গোপাল ভাঁড় বা বীরবলের মতো হাসির মোরাক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে ‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’ ‘নাল অতঙ্ক’ নিঃশাসনের শেষরাত্রি’, ভুতো প্রভৃতি সত্যজিতের লেখা ভৌতিক রসের গল্প। সদানন্দের খুদে জগৎ গল্পে সদানন্দ পিঁপড়ের গান শুনতে পেরেছিলেন সত্যজিতের লেখাতেই। উজান সিরিজের ‘সুজান হরবোলা’, ‘গঙ্গারামের কপাল’, ‘রতন, আর লক্ষী কানাইয়ের কথা’ – গল্পগুলি রূপকথা ধর্মি। যদিও এই ধরনের গল্পে আমরা পাই আধুনিক জীবন ভাবনার বহিঃপ্রকাশ।

ফলত, বিচিত্র সাহিত্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সত্যজিৎ বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যের জগৎকে করে তুলেছিলেন প্রাণবন্ত প্রাণোচ্ছল। যার দীপ্ত মহিমা নিয়ে বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হয়ে থাকবেন তিনি।

পরিশেষে বলতে পারি যে সমস্ত কারণে বাংলা শিশু সাহিত্যে তিনি আজও স্মরণীয় তা হল –

১. সত্যজিৎ রায়ের অন্যতম পরিচয় তিনি একজন মহান চলচ্চিত্র নির্মাতা ও অস্কার বিজয়ী পরিচালক।

২. ফেলুদা চরিত্রটির মধ্যে দিয়ে তিনি এক অনবদ্য গোয়েন্দা চরিত্র নির্মাণ করেছেন এবং গোয়েন্দা চরিত্রকে তিনি আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছে দিয়েছেন।

৩. প্রফেসর শঙ্কু চরিত্রটির মধ্যে দিয়ে তিনি পাঠকবর্গের কল্পবিজ্ঞানের চেতনাকে বলিষ্ঠ করেছেন।

৪. অপর এক মহান সৃষ্টি হলেন তারিণীখুড়ো এই চরিত্রটির মাধ্যমে পাঠক বর্গের বিচিত্র ও বহুবিধ অভিজ্ঞতালাভ সম্ভব

৫. সত্যজিৎ রায়ের লেখা বিভিন্ন গল্প ও উপন্যাস চলচ্চিত্র জগৎকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে।

৬. সত্যজিৎ রায়ের সাহিত্যসৃষ্টিগুলির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট হল ভাষার সরলতা।

৭. সত্যজিৎ রায়ের সাহিত্যসৃষ্টি বিচিত্র অভিজ্ঞতার সমাহারের সৃষ্ট ।

৮. তাঁর রচনার সাহিত্যমূল্য অপরিসীম।

আরো পড়ুন

বাংলা কাব্য সাহিত্যে বিহারীলাল চক্রবর্তীর অবদান

বাংলা নাট্য সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো

বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে শ্রীরামপুর মিশনের অবদান আলোচনা করো

বাংলা নাট্য সাহিত্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদান আলোচনা করো

বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবদান

Leave a Comment

error: Content is protected !!