বাংলা শিশু সাহিত্যের ইতিহাসে দক্ষিণারঞ্জণ মিত্র মজুমদারের অবদান

প্রশ্ন : বাংলা শিশু সাহিত্যের ইতিহাসে দক্ষিণারঞ্জণ মিত্র মজুমদারের অবদান।
অথবা, বাংলা শিশু সাহিত্যের ইতিহাসে দক্ষিণারঞ্জণ মিত্র মজুমদারের স্থান নিরুপণ করো।

উত্তর:

বাংলা শিশু সাহিত্যের ইতিহাসে দক্ষিণারঞ্জণ মিত্র

“তিনি ঠাকুরমার মুখের কথাকে ছাপার অক্ষরে তুলিয়া পাতিয়াছেন। তবু তাহার পাতাগুলি প্রায় তেমনি সবুজ তেমনি তাজাই রহিয়াছে…।”

উদ্ধৃত অংশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যার সম্পর্কে মন্তব্যটি করেছেন তিনি হলেন বাংলা শিশু সাহিত্যের বিখ্যাততম গ্রন্থ ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র স্রষ্টা দক্ষিণারঞ্জন এবং বাংলা শিশু সাহিত্য জগতের অন্যতম স্মরণীয় সাহিত্য ব্যক্তিত্ব ।

দক্ষিণারঞ্জনের আগে লালবিহারী দে, উইলিয়াম কেরি, দীনেশ চন্দ্রসেন প্রমুখ ব্যক্তিত্ব গ্রাম্য মোখিক সাহিত্য উদ্ধারে যথেষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু ফোনোগ্রাফ যন্ত্র দিয়ে হুবহু মানুষের ভাষাকে রেকর্ড করে তাকে যথাসম্ভব মৌখিক রীতিতে বাঙালি পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করে অনন্য কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন দক্ষিণারঞ্জন। রূপকথা, ব্যালাডের কাহিনী ব্রতকথা ও কৌতুককর লোককথা সব সংগ্রহ করে। দক্ষিণারঞ্জন একের পর এক প্রকাশ করেন ‘ঠাকুরদার ঝুলি,’ ‘ঠানদিদির থলে’, ‘দাদা মশায়ের থলে’র মতো গ্রন্থ। অনবদ্য ভাষা গুণের জন্য তিনি নিছক রূপকথা সংগ্রাহক হয়ে থাকেননি বরং গুণমান সম্পন্ন সাহিত্যিকের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন। এক্ষেত্রে পুনরায় স্মরণ করতে পারি রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য – “ইহাতেই তাহার সূক্ষ্ম রসবোধ ও স্বাভাবিক কলানৈপুণ্য প্রকাশ পাইয়াছে।”

গল্প বলার পাশাপাশি ছবি এঁকে গল্পটিকে দৃশ্যময় করে তোলার যে প্রয়াস তিনি ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ গ্রন্থের চারটি পর্বে ‘দুধের সাগর’ (দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প), ‘রূপ তরাসী’ (রাক্ষস প্রাণীদের কাহিনী এবং মজার গল্প) এবং ‘আম সন্দেশ’ (ঘুম পাড়ানি গ্রাম্য ছড়া) করেছেন তাতে তাঁর স্বকীয়তা এবং শিশুদের বোধগম্যতা উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে। একটি উদাহরণ, –

“আমার কথাটি ফুরাল নটে গাছটি মুড়াল।” 

কিংবা

“ঝরছে হাসি, ছুটছে হাসি, ফুটছে হাসি মুখে

লাল টুকটুক মুখগুলি সব হাসছে মধুর সুখে।”

  • এমন বর্ণনা বাংলা সাহিত্যে অল্পই আছে আর এখানেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব।

১৯০৫ সালে বঙ্গ ভঙ্গের হেয়ারে সারাদেশ উত্তাল। রাখী উৎসব, রবীন্দ্রনাথের গান, দেশ নেতাদের উদ্দীপ্ত ভাষণে বাঙালি তখন দিশেহারা অবস্থা থেকে একটু একটু করে স্বদেশ মন্ত্রে জাগ্রত হয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে। সেই কালপর্বে দক্ষিণারঞ্জন শুধু রূপকথার গল্প শুনিয়ে নিজের কর্তব্য শেষ করেননি, বরং শিশু কিশোরদের মনে স্বদেশ প্রেম জাগিয়ে তোলার জন্য লিখেছিলেন নানান গল্প, কবিতা। খোকা খুকুর খেলায় পাই তেমন কথা –

“দেশ দেশ দেশ ….. ভাই আমাদের দেশ।;

সক্কল দেশের আগে সে কোন দেশ?

ভাই, আমার দেশ।।”

কিংবা

দাদুর দেশের ছেলেমেয়েদের ‘বন্দেমাতরম’ গাইতেও শোনা গেছে।

দক্ষিণারঞ্জনের মৌলিক গল্পের মধ্যে আছে চারু-হাবুর গল্প, ‘উৎপল ও রবির গল্প যেখানে নীতিবোধ, উচিত-অনুচিত, নিখাদ বন্ধুত্বের নিদর্শন শিশু জগৎকে মোহিত করে রাখে। ছেলেবেলায় তাঁর নিজের মা পিসিমার কাছে শোনা গল্প বড়ো হয়ে জমিদারি-পরিদর্শনের কাজে গ্রামে গঞ্জে ঘুরে বেড়ানোর উদার মুক্ত প্রকৃতি, রাখালিয়া বাঁশির সুর, সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশার অভিজ্ঞতা ধরা পড়লো তাঁর রচনার রূপবৈচিত্র্যে। ‘প্রদীপ’, ‘প্রকৃতি’, ‘ভারতী’, ‘সারথি’, ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিচয় পত্রিকা প্রভৃতি পত্রিকায় একের পর রচিত শিশু সাহিত্যের জন্ম দিয়েছেন, দক্ষিণারঞ্জন হয়ে উঠেছিলেন শিশু কিশোরদের প্রানের মানুষ। কবি, প্রবন্ধিক, গল্পকার, গীতিকার, চিত্রশিল্পী, বিজ্ঞানসাধক, এবং শিশু সাহিত্যের রূপকার দক্ষিণারঞ্জন বেঁচে থাকবেন চিরকাল।

পরিশেষে বলতে বলতে পারি যে সমস্ত কারণে বাংলা শিশু সাহিত্যে তিনি শ্রেষ্ঠত্বের আসন অধিকার করেছেন সেগুলি হল—

১। দক্ষিণারঞ্জন বাংলার লুপ্তপ্রায় লোকসাহিত্য সংগ্রহের কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে রক্ষা করেছেন।

২। তিনিই প্রথম বাংলার লোক কাহিনীগুলি পুস্তকাকারে প্রকাশিত করে এবং সর্বস্তরের মানুষের কাছে বিপুলভাবে সমাদর লাভ করে।

৩। দক্ষিণারঞ্জণ ছোটদের জন্য বই লিখে বাংলার শিশুসাহিত্য ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন।

৪। দক্ষিণারঞ্জন বৈজ্ঞানিক পরিভাষা সমিতির সভাপতি রূপে বাংলায় বিজ্ঞানের বহু পরিভাষা রচনা করেন। 

৫। বিভিন্ন দেশাত্মবোধক ও নীতি মূলক গল্প রচনার মধ্য দিয়ে শিশুদের মধ্যে নৈতিকতা ও দেশাত্মবোধক সত্তাকে জাগ্রত করেছেন।

৬। দক্ষিণারঞ্জন রূপকাহিনীগুলিকে তিনি এমন মনোরম সুরেলা ভাষায় এবং সুন্দর ছন্দে ব্যক্ত করেছেন যে তার আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য।

আরো পড়ুন

বাংলা কাব্য সাহিত্যে বিহারীলাল চক্রবর্তীর অবদান

বাংলা নাট্য সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো

বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে শ্রীরামপুর মিশনের অবদান আলোচনা করো

বাংলা নাট্য সাহিত্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদান আলোচনা করো

বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবদান

Leave a Comment

error: Content is protected !!