প্রথামুক্ত বা নিয়ম-বহির্ভূত শিক্ষা কি | Non-formal Education In Bengali

প্রথামুক্ত বা নিয়ম-বহির্ভূত শিক্ষা কি | Non-formal Education In Bengali

উত্তর:

প্রথামুক্ত বা নিয়ম-বহির্ভূত শিক্ষা

প্রথামুক্ত শিক্ষা হল এমন এক ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি যা নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মত বিস্তৃত কিন্তু কোন বাঁধাধরা নিয়মে আবদ্ধ নয়, অথচ অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মত সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রনহীন নয়। এটি উদ্দেশ্যভিত্তিক, সুসংগঠিত কার্যক্রম নির্ভর শিক্ষা পদ্ধতি। আবার নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মতাে এই শিক্ষার পাঠক্রম, শিক্ষাদান পদ্ধতি, ভর্তির যােগ্যতা, মূল্যায়ন প্রক্রিয়া কঠোর ও নির্দিষ্ট নয়। অর্থাৎ, যে শিক্ষা প্রক্রিয়া সমস্ত রকম নিয়ন্ত্রণের বন্ধন কে অতিক্রম করে, অথচ অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষার পর্যায়ভুক্ত না হয়েও শিক্ষা প্রক্রিয়াকে পরিচালনা করে তাকেই নিয়ম বহির্ভূত বা প্রথামুক্ত শিক্ষা বলে।

নিয়ম-বহির্ভূত বা প্রথামুক্ত শিক্ষার সংজ্ঞা : 

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ কুম্বস (coombs) বলেছেন, প্রথামুক্ত শিক্ষা হল একটি সংগঠিত শিক্ষামূলক ক্রিয়া যা প্রথাগত বা বিধিবদ্ধ শিক্ষার বাইরে ঘটে – যা প্রকৃতভাবে অথবা কোনাে বিশেষ উদ্দেশাবলীর এবং শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে তার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসাবে অনুষ্ঠিত হয়। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জে. পি. নায়েক (J. P. Naik) বলেছেন, প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে যে শিক্ষা প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ সুবিন্যস্ত ভাবে পরিচালনা করা হয়, তাই হল প্রথামুক্ত বা নিয়ম বহির্ভূত শিক্ষা।

নিয়ম বহির্ভূত শিক্ষার বৈশিষ্ট্য :

সমাজে চাহিদা পূরনের উদ্দেশ্যে প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি নিয়ম-বহির্ভূত শিক্ষার প্রযােজনীয়তা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই শিক্ষার বৈশিষ্ট্য গুলি হল – 

1) চাহিদা নির্ভর – নিয়ম-বহির্ভূত শিক্ষা শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট চাহিদা পূরনের উদ্দেশ্যে গ্রহণ করে। এই শিক্ষার পাঠক্রম শিক্ষার্থীর চাহিদা পূরণের ওপর নির্ভর করেই বিবেচিত হয়। 

2) স্কুল-ছুট শিক্ষার্থী – যে সমস্ত শিক্ষার্থীরা প্রথাগত শিক্ষালাভের সুযােগ পায়না বা পড়াশােনা শুরু করলেও বিভিন্ন কারণে মাঝপথে পড়াশুনা ছেড়ে দেয়, অথবা সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বা অর্থনৈতিক কারণে যারা শিক্ষা লাভের সুযােগ পায়না, তাদের শিক্ষার সুযোগ প্রদান করে এই নিয়ম বহির্ভূত শিক্ষা। এর ফলে শিক্ষার্থীরা আবার পড়াশােনার সুযোগ পেয়ে শিক্ষার মূল স্রোতে ফিরে আসার সুযােগ পায়।

3) নির্দিষ্ট বয়স সীমা নেই – নিয়ম বহির্ভূত শিক্ষায় প্রবেশের জন্য শিক্ষার্থীর নির্দিষ্ট কোনাে বয়স নেই। এখানে শিক্ষার্থী যে কোনাে সময়, যে কোনাে বয়সে তার প্রয়ােজন মত এই শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। 

4) নমনীয়তা – এই শিক্ষা যেহেতু শিক্ষার্থীর চাহিদা অনুযায়ী পরিচালিত হয় সেহেতু শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষক, বিদ্যালয়, সবকিছু নমনীয় হয়ে থাকে। নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মত নিয়ম কানুনে আবদ্ধ নয়। 

5) নির্দিষ্ট সময়সীমার অনুপস্থিতি – এই শিক্ষায় নির্দিষ্ট কোন সময়সীমা থাকেনা। এখানে শিক্ষার্থীরা কাজের ফাঁকে তাদের সময় অনুযায়ী দিনে বা রাতে যে কোন সময়ে শিক্ষালাভের জন্য আসে। এই শিক্ষায় প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে হয় না।

6) নির্দিষ্ট শিক্ষালয়ের মধ্যে আবদ্ধ নয় – প্রথা বহির্ভূত শিক্ষার পঠন-পাঠন বিদ্যালয়ের চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ নয়। সাধারণত study materials শিক্ষার্থীদের বাড়িতে ডাকযােগে পাঠিয়ে দেওযা হয়, তারা তাদের সুবিধা মতাে পড়াশুনা করে।

7) শিক্ষার ব্যয় ভার – এই শিক্ষার ব্যয় ভার প্রথাগত শিক্ষার তুলনায় অনেক কম। এখানে শিক্ষার খরচ এমনভাবে স্থির করা হয় যাতে সমাজের সমস্ত ধরনের শিক্ষার্থীরা এই শিক্ষালাভের সুযোগ পায়। 

8) সাহায্যকারী শিক্ষা ব্যবস্থা – প্রথাগত শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল যেকোন কারনে কোন শিক্ষার্থী প্রথাগত শিক্ষাগ্রহণে ব্যর্থ হলে সেই শিক্ষার্থী প্রথা বহির্ভূত শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ সম্পন্ন করতে পারে। 

9) পাঠক্রম নির্বাচনে স্বাধীনতা – প্রথা বহির্ভূত শিক্ষায় সমস্ত শিক্ষার্থীদের জন্য একই ধরনের পাঠক্রম অনুসরণ করা হয় না। শিক্ষাপদ্ধতি, পরীক্ষা ব্যবস্থা একই রকম হয় না এখানে বিভিন্ন ধরনের পাঠক্রম থাকে। শিক্ষার্থীরা তাদের নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী পাঠক্রম নির্বাচন করতে পারে। 

10) জীবনব্যাপী শিক্ষা প্রক্রিয়া – এই শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট কোন বয়স থাকে না। শিক্ষার্থী যেকোনাে বয়সে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। শিক্ষার্থী সারাজীবন ধরে পড়াশােনা করতে পারে এবং নতুন নতুন তথ্য ও জ্ঞান অর্জন করে তাদের ডিগ্রী লাভ করতে পারে।

11) শিক্ষকের ভূমিকা – প্রথাগত শিক্ষার মতাে এই শিক্ষায় শিক্ষক নির্দিষ্ট শ্রেণীকক্ষে শিক্ষাদান করেন না। এ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ শিক্ষকমন্ডলী বিভিন্ন বিষয়ে পাঠ্যপুস্তক, মডেল প্রস্তুত করেন। বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত ব্যক্তি, অবসরপ্রাপ্ত ব্যাক্তি, বেকার শিক্ষিত ব্যক্তি এখানে শিক্ষকতা করতে পারেন। শিক্ষার্থী তার প্রয়োজনমতাে বিষয় পাঠ করে শিখে নিতে পারে। 

12) মূল্যায়ন প্রক্রিয়া – এই শিক্ষা ব্যবস্থার মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মতন নয়। শিক্ষার্থীরা যেকটি বিষয়ে পরীক্ষা দিতে ইচ্ছুক কেবলমাত্র সেই কয়টি বিষয়ে পরীক্ষা দিতে পারে। ধীরে ধীরে সব পরীক্ষায় পাস করলে সব নম্বর নিয়ে তাকে সেই কোর্সে ডিগ্রি প্রদান করা হয়। 

প্রথা বহির্ভূত শিক্ষার সীমাবদ্ধতা :

1) সমস্ত ধরনের চাহিদা পূরণে অক্ষম – এই শিক্ষা শিক্ষার্থীর সবধরনের সামাজিক, মানসিক, নৈতিক চাহিদা পূরণ করতে পারে না। প্রতিদিন না আসার কারণে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। শুধুমাত্র বই পড়েই সব চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়।

2) সামাজিক বিকাশ ব্যাহত হয় – এই শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোন সামাজিক মূল্যবােধ গড়ে ওঠে না। এখানে যেহেতু শিক্ষার্থীরা দলবদ্ধভাবে শিক্ষা লাভের সুযােগ পায় না তাই শিক্ষার্থীদের সামাজিক বিকাশ ব্যাহত হয়। 

3) সহযােগিতার অভাব – প্রথা-বহির্ভূত শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা দলগতভাবে নিয়মিত শ্রেণিকক্ষে অংশগ্রহণের সুযােগ পায় না। ফলে তাদের মধ্যে পারস্পরিক সহযােগিতা ও সহমর্মিতা বােধ গড়ে ওঠে না। 

4) অনির্দিষ্ট পাঠক্রম ও শিক্ষা প্রক্রিয়া – এই শিক্ষায় কোন সুনির্দিষ্ট পাঠক্রম এবং শিক্ষণ পদ্ধতি থাকেনা। তাই এই শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীর যথাযথ বিকাশের পক্ষে সহায়ক নয়। 

5) পেশা কেন্দ্রিক শিক্ষা – এই শিক্ষা শিক্ষার্থীদের কেবল জীবিকা অর্জনের উপযােগী করে গড়ে তােলা হয়। তাই এই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের কাছে পেশা কেন্দ্রিক ও উৎপাদন নির্ভর হয়ে পড়ে। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের যথাযথ বিকাশের সম্ভব নয়।

6) শংসাপত্রের গ্রহণযােগ্যতা কম – প্রথাগত শিক্ষা দ্বারা অর্জিত শংসাপত্রের গুরুত্ব অধিকাংশ সময়ই প্রথা বহির্ভূত শিক্ষার দ্বারা অর্জিত শংসাপত্র তুলনায় অনেক বেশি। প্রথা বহির্ভূত শিক্ষার দ্বারা অর্জিত শংসাপত্রের গুরুত্ব অনেক ক্ষেত্রেই সেই অর্থে দেওয়া হয় না।

নিয়ম বহির্ভূত শিক্ষার মাধ্যম : 

নিয়ম-বহির্ভূত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলির গুরুত্ব সবথেকে বেশি সেগুলি হল – 1) দূরাগত শিক্ষা (Distance Education) 2) মুক্ত শিক্ষা (Open Education) 3) বয়স্ক শিক্ষা (Adult Education)

আরো পড়ুন

সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা ও ব্যাপক অর্থে শিক্ষা | Concept of education in Bengali

শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশ | Growth and Development of a Child in Bengali

মনোবিজ্ঞান কি | শিক্ষা ও মনোবিজ্ঞানের সম্পর্ক কি | Psychology in Bengali

উডের ডেসপ্যাচ (1854) | 1854 সালে উডের ডেসপ্যাচ এর সুপারিশ | Wood’s Despatch in Bengali

কৈশোরকাল | কৈশোরকালের বিকাশগত বৈশিষ্ট্য, চাহিদা | Adolescence in Bengali

Leave a Comment

error: Content is protected !!