শৈশবের বিকাশগত বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো | শৈশবে শিশুর চাহিদা সম্পর্কে আলোচনা করো

Q: শৈশবের বিকাশগত বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো।
Q: শৈশবে শিশুর চাহিদা সম্পর্কে আলোচনা করো।
Q: শৈশবকালে শিশুদের মধ্যে কি কি বিকাশগত বৈশিষ্ট্য দেখা যায় তা আলােচনা কর। 
Q: শৈশবকালে শিশুদের কি কি চাহিদা দেখা যায় তা বিস্তারিত ভাবে আলােচনা কর।
Q: শৈশবকালে শিশুর মধ্যে কি কি দৈহিক চাহিদা দেখা যায় তা আলােচনা কর। 
Q: শৈশবকালে শিশুর মনােবৈজ্ঞানিক চাহিদা গুলি কি কি তা উল্লেখ কর।

Ans:

শৈশব (Infancy)

শিশুর জীবন বিকাশের প্রথম স্তর হল শৈশবকাল। এই সময় শিশুর আকার-আয়তন অর্থাৎ দৈহিক পরিবর্তন গুলি বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। মানসিক দিক থেকে বাচনিক বিকাশ দেখা যায়, কর্মেন্দ্রিয় সক্রিয়তা বাড়ে, স্মৃতি শক্তির বিকাশ ঘটে, আত্মসচেতনতা বেশিমাত্রায় কাজ করে, শিশুর সামাজিক অভিযােজন ক্ষমতা ও সামাজিক বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। সাধারণত শিশুর জন্মের পর থেকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত সমকালকে শৈশবকাল বলা হয়। শৈশবের বিকাশমূলক বৈশিষ্ট্য গুলি কে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন – দৈহিক বিকাশ গত বৈশিষ্ট্য, মানসিক বিকাশ গত বৈশিষ্ট্য ও সামাজিক বিকাশ গত বৈশিষ্ট্য।

শৈশবের বিকাশগত বৈশিষ্ট্য (Developmental Characteristics of Infancy)

1) দৈহিক বিকাশ গত বৈশিষ্ট্য:

এই সময় শিশুর দৈহিক বিকাশ খুব দ্রুতগতিতে হয় এক মাস বয়সে শিশু মাথা তুলতে পারে। দু’মাস বয়সে মাথা সােজা করতে পারে। পাঁচ মাসে কোন কিছুর ওপর ভর দিয়ে বসতে পারে। ৪ থেকে 9 মাস বয়সে দাঁড়াতে পারে। দশ মাস বয়সে শিশু হামাগুড়ি দেয় 11 মাস বয়সে শিশু কারাে হাত ধরে চলতে পারে ,13 মাস বয়সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে পারে । 15 মাস বয়সে হাঁটতে পারে। দেড় বছর বয়সে দৌড়াতে পারে।

 শিশুর উচ্চতা ও ওজন নির্ভর করে তার বংশগতি, পুষ্টি, অসুস্থতা ইত্যাদির উপর। সাধারণত জন্মের সময় শিশুর দৈহিক উচ্চতা 19 থেকে 20 ইঞ্চি ও ওজন 5 পাউন্ড থেকে 9 পাউন্ড মধ্যে থাকে, চার মাস বয়সী শিশুর উচ্চতা সাধারণত 23 থেকে 24 ইঞ্চি হয় এবং এক বছর বয়সে ২৪ থেকে ৪০ ইঞ্চি হয় প্রথম দু’বছর উচ্চতার খুব দ্রুত হারে হয় মাথার তুলনায় দেহের বিকাশ বেশি পরিমাণে হয় তারপর ধীরে ধীরে শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি অপেক্ষাকৃত ধীরগতিতে হয়।

5 বছর বয়সী শিশুর উচ্চতা 43 ইঞ্চি ও ওজন 43 পাউন্ড হয়। মেয়েদের ওজন ও উচ্চতা ছেলেদের থেকে সামান্য কম হয়। শিশুর মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের যেমন বিকাশ ঘটে তেমনি মেরুদন্ড শক্ত হয়। এই বয়সের মধ্যে শিশুর মস্তিষ্কের প্রায় 90% গঠন হয়। দেহের কর্মেন্দ্রিয় ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিকাশের ফলে সঞ্চালনমূলক কাজকর্ম উন্নতি ঘটে। 

2) মানসিক বিকাশ গত বৈশিষ্ট্য:

শৈশবে মানব শিশুর মনােবৈজ্ঞানিক বিকাশের দিক থেকে বহু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে, সেগুলি হল – 

a) প্রবৃত্তি: শৈশবে মানব শিশুর বহু আচরণই প্রবৃত্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। 

b) ভাষাগত বিকাশ:  জন্মের পর শিশুর একমাত্র ভাষা হলাে কান্না। 6 মাস বয়সে শিশুর কিছু অর্থহীন শব্দ উচ্চারণ করতে শেখাে এক বছর বয়সে শিশুর চার থেকে পাঁচটি শব্দ উচ্চারণ করতে পারে দেড় বছর বয়সে ভাষার বিকাশ দ্রুত হয় এবং দু বছরের শেষে প্রায় 200 শব্দ উচ্চারণ করতে পারে।

c) প্রাক্ষোভিক বিকাশ: শিশুর প্রক্ষোভ প্রথম অবস্থায় অসঙ্গত ও সরল হয়। এই সময় শিশুর মধ্যে সামান্য কারণে প্রক্ষোভ সৃষ্টি হয়। আবার অল্প সময়ের মধ্যে তার পরিবর্তন হয়।

d) আত্মসচেতনতা: শৈশবেই শিশু যেসব অভিজ্ঞতা লাভ করে সেগুলি তার ভবিষ্যৎ জীবনের গতি প্রকৃতি নির্ধারণে সাহায্য করে। অর্থাৎ, শিশুর আত্মসচেতনতার মনােভাব শৈশবেই গড়ে ওঠে। 

e) কৌতুহল: কৌতুহল শৈশবকালের মানসিক বৈশিষ্ট্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। বয়স বাড়ার সাথে সাথে শিশুরা চারপাশে যা কিছু দেখে সেগুলি সম্বন্ধে জানার আগ্রহ তাদের মধ্যে প্রবল মাত্রায় দেখা যায়। এমন কি কৌতুহলের তারানায় সে সব কিছুকে নিজের হাতে পরীক্ষা করে দেখতে চায়। যেমন – কোন খেলনা দিলে তার ভিতরে যে শব্দ হচ্ছে সেই শব্দের সঙ্গে আলাে জ্বলছে এই শব্দ ও আলাের উৎস জানার জন্য খেলাটিকে ভেঙে ফেলে। এইভাবে শিশুরা তার কৌতুহলের বহিঃপ্রকাশ করে।

f) অনুকরণপ্রিয়: শৈশবে শিশুরা অনুকরণ প্রিয় হয়। এই সময় শিশুদের মধ্যে বড়দের অনুকরণ করতে দেখা যায়। যেমন ছােট মেয়ে, তার মাকে অনুকরণ করতে ভালােবাসে। এই সময় দিবাস্বপ্ন, অলীক কল্পনা সমগ্র শিশুর মন জুড়ে অবস্থান করে।

3) সামাজিক বিকাশ গত বৈশিষ্ট্য:

জন্মাবস্থায় শিশুর মধ্যে সামাজিক ও অসামাজিক বােধ থাকে না। কিন্তু ধীরে ধীরে বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার মধ্যে সামাজিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। প্রথমে মাকে কেন্দ্র করে , এবং পরবর্তীকালে পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের সঙ্গে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শিশুর সামাজিক আচরণ ক্রমশ প্রসারিত হয়।  শিশুর মধ্যে সহানুভূতি, সমবেদনা মূলক আচরণ , প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক আচরণ , দলগতভাবে খেলাধুলা করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

শৈশবে শিশুর চাহিদা (Needs of Infancy)

শৈশবের চাহিদাগুলিকে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয় দৈহিক চাহিদা, মনােবৈজ্ঞানিক চাহিদা ও সামাজিক চাহিদা।

1) দৈহিক চাহিদা (physical Need): 

শৈশবে শিশুর দৈহিক বিকাশ খুব দ্রুত হারে হওয়ার জন্য কতগুলি চাহিদা লক্ষ্য করা যায়। সেগুলি হল –

a) খ্যাদ্যের চাহিদা (Need for food): বৃদ্ধির সাথে সাথে শিশুদের মধ্যে খাদ্যের চাহিদা দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে। এই সময় শিশুর আকার,আয়তন, ওজন বৃদ্ধি পেতে থাকে এজন্য দেহে প্রচুর পরিমাণ খাদ্যের প্রয়োজন এবং দেহ সঞ্চালনের জন্য যে শক্তির প্রয়ােজন তা আমরা খাদ্য থেকে পেয়ে থাকি। শিশুর বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যের চাহিদাও প্রবল হতে থাকে। শিশুরা সামনে যা পায় তাই মুখে নিয়ে গিলে ফেলার চেষ্টা করে। খাদ্য ও অখাদ্যা বস্তুর মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা তাদের মধ্যে থাকে না।  তাই কিছু সামনে পায় তাই মুখে দেয়। ভ্যন্তরীণ যন্ত্রাংশগুলাে অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে ফলে শিশুর পুষ্টিকর খাদ্যের একান্ত প্রয়োজন। অনেক সময় প্রয়োজন পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে শিশুর দৈহিক বিকাশ ব্যাহত হয় এবং তাদের মধ্যে রােগ প্রতিরােধ ক্ষমতা কমে যায়।

b) চলনের চাহিদা (Need for Movement): শৈশবে শিশুর দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটায় ফলে শিশু সবসময় তার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে নাড়াচাড়া করে। একে অঙ্গসঞ্চালনগত চাহিদা বলে। যেমন – শিশুর নির্দিষ্ট বয়সে বসতে পারে, তারপর হামাগুড়ি দেয়, দাঁড়াতে পারে হাটতে পারে এবং সবশেষে দৌড়াতে পারে। 

c) পুনরাবৃত্তির চাহিদা (Need for repetition): শৈশবে শিশুদের মধ্যে কোন বিশেষ আচরণ সম্পাদনের ক্ষেত্রে পুনরাবৃত্তির প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় যেমন – শিশু যদি কোন জিনিস ছুড়ে ফেলে দেয় সেটিকে কুড়িয়ে এনে দিলেও আবার সেটিকে পুনরায় ছুড়ে ফেলে দেয়। এই ধরনের কাজ করে শিশুরা খুব আনন্দ পায়। 

d) সক্রিয়তার চাহিদা (Need for Activity): সঞ্চালনমূলক ক্রিয়া সম্পাদনের ক্ষমতা দ্রুত হারে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে শিশুর মধ্যে যে চাহিদার সৃষ্টি হয় তাকে সক্রিতার চাহিদা বলে। সেজন্য শিশু যতক্ষণ জেগে থাকে কোন এক স্থানে স্থির থাকতে পারে না কোন না কোন কাজ করতে থাকে। 

2) মনােবৈজ্ঞানিক চাহিদা (Psychological Need):

a) আয়ত্তে আনার চাহিদা (Need for Possession): শৈশবে শিশুর মধ্যে যে কোন বস্তুকে আয়ত্তে আনার চাহিদা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। সমগ্র বস্তুকে শিশু তার হাত-পা দিয়ে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করে।

b) নিরাপত্তার চাহিদা (Need for security): শৈশবে শিশু দৈহিক ও প্রাস্কোভিক উভয় দিক থেকে নিরাপত্তার অভাব বােধ করে যার ফলে পরিবার ও নিকটবর্তী সকলের কাছ থেকে নিরাপদ আশ্রয় ও ভালােবাসা পেতে চায়।

c) অনুকরণের চাহিদা (Need for imitation): শৈশবে শিশুর মধ্যে অনুকরণের চাহিদা প্রবল পরিমাণে দেখা যায়। শিশুরা অন্যের কোন কাজকে বারবার অনুকরণ এর মধ্য দিয়ে আনন্দ লাভ করে।

d) অনুসন্ধানের চাহিদা (Need for exploration): অনুসন্ধানের চাহিদা শিশুর মধ্যে কৌতুহল প্রবণতা সৃষ্টি করে। যাকে ভিত্তি করে শিশুর অভিজ্ঞতার পরিধি ক্রমশ বাড়তে থাকে। |

e) কল্পনার চাহিদা (Need for imagination): এই সময় শিশুদের মধ্যে কল্পনার চাহিদা প্রবল পরিমাণে দেখা যায়। ফলে শিশুর মধ্যে নতুন গল্প , রুপকথার কাহিনী শােনার আগ্রহ দেখা যায়।

3) সামাজিক চাহিদা (Social Need):

a) সহযােগিতার চাহিদা (Need for Co-operation): শৈশবে শিশুর মধ্যে মিলেমিশে কাজ করার প্রবণতা দেখা যায়। যেমন খেলার সময় বন্ধুদের থেকে সহযােগিতা এবং বিভিন্ন কাজের ক্ষেত্রে পিতা-মাতা বা বয়স্ক দের কাছ থেকে সহযােগিতা আশা করে। যদিও এই সহযােগিতার মনােভাব শিশুদের মধ্যে বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না।

b) প্রতিদ্বন্দিতার চাহিদা (Need for Rivalry):  শৈশবে শিশুর মধ্যে এই চাহিদা দেখা যায়। এর ফলে শিশুর মধ্যে সবসময় মােকাবিলা করা, অন্যকে স্পিহা ও অন্যের জিনিসকে নিজেদের আয়ত্ত আনার চেষ্টা করা। শিশুরা তাদের সহপাঠীদের সঙ্গে খেলাধুলার জিনিস নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। তবে এই প্রতিদ্বন্দিতা দীর্ঘস্থায়ী হয় না এগুলাে সম্পূর্ণ বস্তুকেন্দ্রিক। 

c) সমবেদনার চাহিদা ( Need for social approval): শিশুর মধ্যে সমবেদনা চাহিদা প্রবলভাবে দেখা যায়। শিশুরা কোনাে ব্যথা বা কষ্ট পেলে পরিবারের লােকজন, বাবা-মা থেকে সমবেদনা পাওয়ার আশা করে।

d) সামাজিক স্বীকৃতির চাহিদা (Needs for social approval): শিশুরা তাদের যেকোনাে কাজের জন্য মা-বাবা বা বয়স্কদের সমর্থন আশা করে। তারা চায় তাদের যেকোনাে কাজের জন্য যেন বাবা-মা তাদের পুরস্কৃত করে। যেমন- ছবি আঁকা বা কোন খেলনা বানানাে ইত্যাদি বিভিন্ন খেলায় ব্যস্কদের সমর্থন চায়।

আরো পড়ুন

শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষা-মনোবিজ্ঞানের ভূমিকা | Educational Psychology in Bengali

দূরাগত শিক্ষার (Distance Education) সংজ্ঞা দাও | দূরাগত শিক্ষার বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো

অপারেশন ব্ল্যাকবাের্ড বলতে কী বােঝাে | নবােদয় বিদ্যালয় সম্পর্কে আলােচনা করাে

শিক্ষা কি | শিক্ষার ধরন | শিক্ষার বুৎপত্তিগত অর্থ | শিক্ষা সম্পর্কে শিক্ষাবিদ ও দার্শনিকদের অভিমত

কৈশােরকালের চাহিদা ও বিকাশগত বৈশিষ্ট্য গুলি আলােচনা করো

Leave a Comment

error: Content is protected !!