Q: বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান আলোচনা করো
Q: বাংলা উপন্যাসের ধারায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান
উত্তর:
ভূমিকা:
“বঙ্গ সরস্বতীর খাস তালুকের মন্ডল প্রজা”
– তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যাযের উদ্দেশ্যে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের উক্তিটি যথার্থ। কেননা শরৎচন্দ্র পরবর্তী বাংলা কথা সাহিত্যে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। বিংশ শতাব্দীর মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব ও জটিলতা তারাশঙ্করের রচনায় ধরা পড়েছে, কিন্তু এই অস্থির উন্মথিত যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবনকে অতিক্রম করে পূর্ণতার বোধ সঞ্চারিত তার রচনায়। গোটা দেশের মানুষ তাঁর সাহিত্যের উপজীব্য; বিশেষভাবে রাঢ় ও বীরভূম অঞ্চলের মানুষ ডোম, বাগদী বাউরী, কাহার, আউল, বাউল, বীরবংশী, সাঁওতাল, বেদে প্রমুখ মানুষদের বিচিত্র জীবনাদর্শ, অদ্ভুত রীতিনীতি সংস্কার, বিভিন্ন ধর্মমত ইত্যাদির নিখুঁত নিবিড় চিত্রণ তাঁর উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে। যার কারণে রাঢ় বাংলা চলমান জীবনের বিশ্বস্ত রূপকার তারাশঙ্কর ভাই কালান্তরের কথাকার।
তারারাশঙ্কর মহাজীবনের রূপকার মূলত বাংলার গ্রামজীবনের পটভূমিকায় স্থাপিত অগণিত মানুষের কলধ্বনিতে মুখরিত, প্রাণপ্রবাহে হিল্লোলিত এবং অনেকটাই আদিম অসংস্কৃত দুর্বার জীবনধারার যথাযথ প্রকাশ ঘটেছে তাঁর রচনায়।
তাঁর রচিত উপন্যাস গুলি হল-
তারাশঙ্করের উপন্যাসকে মোটামুটিভাবে তিনটি পর্বে বিন্যস্ত করা যায়। প্রথম পর্ব — চৈতালী ঘূর্ণি (১৯৩০), ‘পাষাণপুরী’ (১৯৩৩), ‘রাইকমল’ (১৯৩৩), ‘আগুন’ (১৯৩৭); দ্বিতীয় পর্ব — ‘ধাত্রীদেবতা’ (১৯৩৯), ‘কালিন্দী’ (১৯৪০), ‘কবি’ (১৯৪২), ‘গণদেবতা’ (১৯৪২), ‘পঞ্চগ্রাম’ (১৯৪৪), ‘সন্দীপন পাঠশালা’ (১৯৪৬), ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ (১৯৪৭), ‘নাগিনী কন্যার কাহিনী (১৯৫২); তৃতীয় পর্ব — ‘আরোগ্য নিকেতন’ (১৯৫৩), ‘বিচারক’ (১৯৫৬), ‘রাধা’ (১৯৫৭), ‘সপ্তপদী’ (১৯৫৭), ‘ডাকহরকরা’ (১৯৫৮), ‘যোগভ্রষ্ট’ (১৯৬০), ‘মঞ্জরী অপেরা’ (১৯৬৩), ‘শতাব্দীর মৃত্যু’ (১৯৭২) ইত্যাদি।
নিম্নে কয়েকটি উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো-
১. কালিন্দী : উপন্যাসে জমিদারদের সমস্যার জটিলতা বর্ণিত হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে সামন্ততন্ত্র পুঁজিবাদের সংঘাতে জমিদারদের বিপর্যয় ও শিল্পপতিদের উত্থানের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। কাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যেন কালিন্দীর চরের, যেখানে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা কামনা-বাসনার তীব্রতা প্রবল হয়ে উঠেছে ও কাহিনীর মূল বিরোধের কেন্দ্র নির্মাণ করেছে। সাঁওতালদের জীবনচিত্র অঙ্কনে লেখক বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছেন। কাহিনীর নায়ক জমিদারপুত্র অহীন সাম্যবাদী আদর্শের অনুরাগী হয়ে ওঠে ও ধর্মঘট করার জন্য তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা দ্বন্দ্ব-সংঘাত যন্ত্রণা-দাহকে অতিক্রম করে আশাবাদ প্রবল হয়ে ওঠে কাহিনীর শেষাংশে।
২. ধাত্রীদেবতা : বীরভূমের পটভূমিকায় এক বিলীয়মান জমিদারতন্ত্রের চিত্রকথা যা মূলত শিবনাথের বাল্যকাল থেকে পরিণত যৌবনে উপনীত হওয়ার বিচিত্র জীবনভাবনার ওপর আধারিত। তার পিসীমার জমিদারসুলভ অহংকার ও মর্যাদাবোধকে অতিক্রম করে মায়ের প্রেরণায় জাতীয়তাবাদী চেতনায় ও দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে শিবনাথ কারাবরণ করে। লালমাটির ভূপ্রকৃতি জীবনযাত্রা চরিত্রায়ন উপন্যাসে যথাযথ রূপ পেয়েছে।
৩.কবি : এটিও আঞ্চলিক উপন্যাসের পর্যায়ভূত। নিতাই একজন কবিয়াল -নীচুজাতের ছেলে চোরের বংশ বলে ভদ্রজনের কাছে অবহেলিত। গান রচনা করবার ও গাইবার আশ্চর্যক্ষমতা তাকে খ্যাতিমান করে তোলে। সে ভালবাসা পেয়েছে ঠাকুরঝির, শ্বশুরবাড়ীতে নিত্য লাঞ্ছিত যে বধূটির মনের সুন্দরের পিপাসা মেটায় নিতাইয়ের গান। নিতাই ঝুমুর দলে গিয়ে সেখানকার মেয়ে বসন্তর আকর্ষণে ধরা দেয় যে নৃত্যগীত, পটিয়সী। বসন্ত দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে শোচনীয় মৃত্যু বরণ করে। ঠাকুরঝিও মনোবেদনায় উন্মাদিনী হয়ে মারা যায়। শূন্যচিত্ত নিতাই রিক্তবেদনায় হাহাকার করে ওঠে। উপন্যাসে বাংলার ঝুমুর কবিগান ইত্যাদি লোকসঙ্গীতের আন্তরিক আবেদন ধরা পড়েছে।
৪.’গণদেবতা’য় আধুনিক ভাবনার পটভূমিতে গ্রামসমাজের রীতিনীতি সংস্কার প্রবণতা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কথা বলা হয়েছে। গ্রামীণ মানুষের আছে অদম্য প্রাণশক্তি কিন্তু ক্ষুদ্র বিদ্বেষ আর ঈর্ষা তাকে কালিমালিপ্ত করে দেয়; যদিও উপন্যাসের নায়ক দেবু তার সততা নিষ্ঠা আর আদর্শবাদ নিয়ে সমাজকে নতুন করে গড়ে তুলতে চায়।
৫.’গণদেবতা’র উত্তরখণ্ড ‘পঞ্চগ্রাম’ জীবনধারার অনুবর্তন। তবে কালের বিবর্তনে পালটে যায় অনেক কিছু। ন্যায়রত্নের পৌত্র বিশ্বনাথের সঙ্গে পিতামহর আদর্শের তীব্র বিরোধ বাধে, দেবুও আগের আদর্শবাদ থেকে নেমে আসে মাটির ধূলিতে—জীবনের দ্বন্দ্ব সংগ্রামের সঙ্গে সে এক হয়ে যায়। নিষ্ঠা, ঐক্যবদ্ধতা ও প্রতিবাদী চেতনায় লেখক মুসলমান সমাজের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। শেষ পর্যন্ত দেবুর কণ্ঠে আশাবাদের প্রকাশ ভবিষ্যতের উচ্ছ্বল অপরূপ ছবি অঙ্কিত করে। সংঘাতময় নৈরাশ্যক জীবনভাবনা, মহত্তম চেতনার বিভুষিত হয়ে ওঠে।
৬. “হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় হিন্দুসমাজের এক ব্রাত্য গোষ্ঠী কাহার সম্প্রদায়ের প্রাণধর্ম জীবনধারা ও সমাজভাবনা নিখুঁত নৈপুণ্যে ধরা পড়েছে। লোকবিশ্বাসজাত অতিপ্রাকৃতের অবতারণা এক ভয়াল পরিমণ্ডল রচনা করে যাতে বক্তব্য অন্য মাত্রা পায়। এই গোষ্ঠী-জীবনের নৃতাত্বিক চিত্রণের সঙ্গে মানুষের জটিল অন্তর্জীবনে প্রবেশ করে লেখক উদ্দাম কামনা-বাসনা, তীব্র হিংসা-বিদ্বেষ, প্রবল লোভ-লালসা এবং যথার্থ প্রেম-ভালবাসায় জটিল তরঙ্গক্ষুব্ধ মনোলোকের বিচিত্র প্রকাশে সার্থকতা দেখিয়েছেন। উপন্যাসের নায়ক প্রাচীনতার প্রতীক বনোয়ারীলাল প্রচলিত মূল্যবোধ ও সংস্কারের প্রতিত্ব নবযুগের প্রতিনিধি উদ্ধতযৌবন কর্মোদ্যমী করালীর প্রবল সংঘাত হয় পরিণামে নবীনেরই জয় ঘোষিত হয়।
৭. ‘নাগিনী কন্যার কাহিনী বাংলার অন্ত্যজ বেদে সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা রীতি-সংস্কার ইত্যাদি নিয়ে রচিত। সাপের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক – বিরোধিতা শঙ্কা আকর্ষণ নিয়তিচেতনার জটিল প্রাণময় রূপ পেয়েছে। উপন্যাসের তিন অংশ — প্রথম পর্ব মিথ বা দেবকথা, দ্বিতীয়টি শিরবেদে মহাদেব ও নাগিনী কন্যা শবলার কাহিনী, তৃতীয়টি শিরবেদে গঙ্গারাম ও নতুন নাগিনীকন্যা পিলার কাহিনী।
৮. তারাশঙ্করের প্রথম উপন্যাস চৈতালী ঘূর্ণিতে অসহায় দুর্গত মানুষদের জন্য লেখকের আন্তরিকতা প্রকাশিত।
৯. ‘পাষাণপুরী’ জেলখানার মধ্যকার জীবনের ছবি যেখানে কয়েদীদের বিভিন্ন স্তর ও শ্রেণীর মানুষের কথা নিপুণ রূপ পেয়েছে।
১০. ‘রাইকমল’ বৈষ্ণব ভাবনার পটভূমিতে প্রেমপ্রীতি ও সমস্যা সংকটময় জীবনের রূপায়ণ—যাতে বিশেষ রূপ পেয়েছে নায়িকা রাইকমলের আত্মউপলব্ধি ও জাগরণের কথা যা এক মহৎভাবনায় উদ্বর্তিত হয়েছে।
১১. “আরোগ্য নিকেতন’ চিরন্তন মৃত্যুভাবনার ওপর আধারিত যেখানে জীবনমৃত্যুর ছন্দোবদ্ধ দর্শনভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। প্রবীণ কবিরাজ জীবনমশায় যোগীর মতো সাধকের মতো জীবনমৃত্যুকে উপলব্ধি করেন, যে মৃত্যু অনিবার্য যা জীবনবৃত্ত পূর্ণ করে দেয়। আবার আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা বিজ্ঞানের দ্বারা এই মৃত্যুর অনিবার্য আগমনের পথ রুদ্ধ করে দাঁড়ায়। এই দুই আদর্শের সংঘাতে জীবনভাবনা অন্য মাত্রা পায়। কল্পনার বৈচিত্র্য ও ভাবনার গভীরতায় ‘আরোগ্য নিকেতন’ অনন্য অসামান্য সৃষ্টি।
উপন্যাস সাহিত্যে তারাশঙ্করের গুরুত্ব :
বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে তারাশঙ্করের গুরুত্ব অপরিসীম।
১। তারাশঙ্করের আঞ্চলিক জীবন ভাবনার উপন্যাসগুলি বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে বৈচিত্র্য এনেছে। মূলত স্বাধীনতা প্রাপ্তির অব্যবহিত পরেই লিখলেন রাঢ় অঞ্চল নিয়ে উপন্যাস। এসবের মূলে যেমন আছে প্রবল নগর বিমুখতা, তেমনি আছে নিজস্ব চেনা-পরিচিত অঞ্চলে মানসমুক্তির মহারূপ। নিশ্চয়ই আঞ্চলিক জীবন-পরিবেশ এই উপন্যাসগুলি বাংলা কথাসাহিত্যে বৈচিত্র্য এনেছে অভাবনীয়।
২। তারাশঙ্কর তাঁর উপন্যাস সাহিত্যে গ্রাম-বাংলাকে শিল্প-সম্মতভাবে উপস্থাপিত করেছেন। তা তারাশঙ্কর তাঁর উপন্যাসে আদিম জীবন প্রবৃত্তিকে, রাঢ়ের প্রবৃত্তিতে, রাঢ়ের প্রকৃতিতে, গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনশীলতাকে, জমিদারতন্ত্র ও বণিকতন্ত্রের সংঘাতকে যথাযথভাবে উপস্থাপিত করেছেন।
৪। তারাশঙ্করের একাধিক উপন্যাসে প্রাচীন ভাবনার সঙ্গে নবীন বিশ্বাসের সংঘাত লক্ষ্য করা যায়। যেমন- ‘ভুবনপুরের হাট’, হাসুঁলি বাকের উপকথা, বেদেনী ইত্যাদি। তারাশঙ্করের বেশির ভাগ উপন্যাসেই প্রাচীনের সঙ্গে নবীনের এই দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করা যায়। তিনি ছিলেন কাল সচেতন শিল্পী।
৫। তারাশঙ্করের উপন্যাসে প্রাচীন ও নবীনের দ্বন্দ্ব থাকলেও ভাবাদর্শকে তিনি কখনও অস্বীকার করেননি। ‘যোগভ্রষ্ট’ (১৯৬০) উপন্যাসে সে প্রমাণ আছে। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘জীবন হইতে ধর্মের একান্ত নির্বাসনের যুগেও ধর্মকেন্দ্রিক উপন্যাস রচনা করিয়া তারাশঙ্কর দেশের ঐতিহ্যের সহিত তাঁহার অবিচ্ছিন্ন মানসযোগের পরিচয় সহিত তাঁহার অবিচ্ছিন্ন মানসযোগের পরিচয় দিয়েছেন।’
আরো পড়ুন
বাংলা নাট্য সাহিত্যে বিজন ভট্টাচার্যের অবদান
বাংলা নাট্য সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো
বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে শ্রীরামপুর মিশনের অবদান আলোচনা করো
বাংলা নাট্য সাহিত্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদান আলোচনা করো
বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবদান
বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করো
বাংলা নাট্য সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো