বাংলা নাট্য সাহিত্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদান আলোচনা করো

বাংলা নাট্য সাহিত্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদান আলোচনা করো ।
অথবা, বাংলা নাট্য সাহিত্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদান ও ভূমিকা আলোচনা করো ।

উত্তর:

ভূমিকা:

গিরিশচন্দ্র ঘােষ রঙ্গমঞ্চের শ্রেষ্ঠ পুরুষ। তৎকালীন সময়ে নাটকের যে জ্যোতির্ময় সৌরমন্ডল ছিল তার প্রধান পুরুষ ছিলেন গিরিশচন্দ্র ঘােষ। নাটক রচনায় তিনি শেক্সপিয়ার, অভিনয়ে গ্যারিক এবং শিল্প শিক্ষায় তিনি আচার্য ভরতের সঙ্গে তুলনীয়। সামগ্রিকভাবে বাংলা রঙ্গলােকের উন্নয়নে এমন নিপুণ ও যােগ্য পুরুষ আর আবির্ভূত হন নি। দর্শকের হৃদয় আলােড়িত করতেন, আন্দোলিত করতেন প্রবলভাবে দর্শকদের সঙ্গে ছিল তার গভীর সংযােগ। তিনি ছিলেন তাদের তিনি ছিলেন তাদের শিল্পবােধ ও মনন প্রকাশের প্রাণ রুপ। তাইতাে উৎপল দত্ত গিরিশচন্দ্র ঘােষ সম্পর্কে বলেছেন—– 

“ ভারতের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার তাে বটেই তার যেকোনাে রচনা বিশ্বনাট্য সাহিত্যের স্থান পাওয়ার যােগ্য”

গিরিশচন্দ্র ঘোষ রচিত নাট্যসমূহ

গিরিশ চন্দ্রের রচিত নাটক গুলির বিষয় ভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ করে আলােচনা করা হলাে—–

ক. পৌরাণিক নাটক: 

১.রাবণ বধ – ১৮৮১ 

২.অভিমন্যু বধ – ১৮৮১ 

৩.রামের বনবাস – ১৮৮২ 

৪. লক্ষণ বর্জন – ১৮৮১ 

৫. সীতাহরণ – ১৮৮২ 

৬. জনা – ১৮৯৪ 

৭. পান্ডব গৌরব –  ১৯০০ 

৮. বিল্বমঙ্গল ইত্যাদি।

বিল্বমঙ্গল (১৮৮৮): এই নাটকের কাহিনী ভক্তি মূলক গ্রন্থ থেকে গৃহীত। নাটকটি প্রেম ও বৈরাগ্য মূলক নাটক রূপে চিহ্নিত। নাটকের মূল চরিত্র কে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হয়েছে। বিল্বমঙ্গল ভক্তি সাধক হলেও তার মানসিক ভাবাবেগের একটি নাটকে প্রকাশিত হওয়ায় অসাধারণ সৃষ্টি হয়েছে।

জনা (১৮৯৪): গিরিশচন্দ্রের অন্যতম পৌরাণিক নাটক জনা। জনা নাটকে মাতৃহৃদ্যয় তথা বীরহৃদয়ের সরূপ প্রকাশিত হয়েছে। প্রবীর ও জনা চরিত্র কে অবলম্বন করে নাটকের বাস্তব আবেগ প্রতীক সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে নীলধ্বজ অগ্নি প্রভৃতির মাধ্যমে অলৌকিক ভক্তিরস নাটকের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে। আসলে জনার অন্তর্দ্বন্দ্ব ও ক্ষাত্র রমণীসুলভ দৃঢ়তা এই নাটকের অন্যতম সম্পদ। 

খ. সামাজিক নাটক

গিরিশচন্দ্র তার সামাজিক নাটকের হাজার ২০০ শতকের বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের চিত্র অঙ্কন করেছেন। তার সামাজিক নাটক গুলি হল— ১. প্রফুল্ল (১৮৮৯), ২. হারানিধি (১৮৯০), ৩. বলিদান (১৯০৫), ৪. শাস্তি কি শান্তি (১৯০৮) ৫.মায়াবসান(১৮৯৭) প্রভৃতি। 

প্রফুল্ল: প্রফুল্ল গিরিশচন্দ্রের শ্রেষ্ঠ সামাজিক নাটক। এই নাটকে কলকাতার এক ভদ্র পরিবারের অর্থনৈতিক সংকট ও পরিণামে তীব্র বেদনা নিয়ে নাটকটির কাহিনী রচিত হয়েছে। নাটকটির মূল চরিত্র যােগেশের হৃদয় যন্ত্রণা ও মর্মভেদী হাহাকার নাটকটি কে উচ্চমানের নাটক রূপে বিবেচিত করেছে। 

বলিদান: বলিদান গিরিশচন্দ্রের উচ্চমানের সামাজিক নাটক বাংলায় পণপ্রথার ভয়াবহ চিত্র অঙ্কন করে। এবং বাংলার কন্যাদের শােচনীয় বেদনার্ত জীবনের নির্মম চিত্র তুলে ধরে এই নাটকে। 

গ. ঐতিহাসিক নাটক:

গিরিশ চন্দ্রের ঐতিহাসিক নাটক গুলি দেশের জাতীয় উন্মাদনার পটভূমিকায় রচিত হয়েছিল। তাঁর রচিত ঐতিহাসিক নাটক গুলি হল—-

১. মীর কাসিম (১৯০৪), ২. অশােক (১৯০৪) ৩. সিরাজউদ্দৌলা (১৯০৬), ৪. ছত্রপতি শিবাজী (১৯০৭), ৫. চন্ড (১৮৯০ 1st)। 

সিরাজদ্দৌলা: স্বদেশী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গিরিশচন্দ্রের ঐতিহাসিক নাটক সিরাজউদ্দৌলা। সমসাময়িক স্বদেশী আন্দোলনে হিন্দু মুসলমানের ঐক্য চেতনার চিত্র নাট্যকার তুলে ধরেছিলেন৷ সিরাজউদ্দৌলার চরিত্রের মাধ্যমে বাংলার গৌরব পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। নাটকটি ঐতিহাসিক হিসাবে শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক নাটক।

ছত্রপতি শিবাজী: নাট্যকার শিবাজীকে শুধু বিরূপ অঙ্কিত করেই সন্তুষ্ট থাকেন নি তাকে মাতা ভবানীর বরপুত্র রূপে গড়ে তুলেছেন। স্বদেশী আন্দোলনের যুগে জাতীয়তাবােধের একটি ধারা যে ধর্ম আশ্রিত পথে প্রবাহিত হয়েছিল তার সাক্ষ্য মেলে এই নাটকে। 

ঘ. জীবন চরিত নাটক:

তাঁর রচিত জীবনচরিত নাটক গুলি হল— 

১. চৈতন্যলীলা(১৮৮৪) ২. নিমাই সন্ন্যাস(১৮৮৫) ৩. বুদ্ধদেব চরিত (১৮৮৫) ৪. বিল্বমঙ্গল (১৪৮৮) ইত্যাদি।

গিরিশচন্দ্র ঘােষ শ্রী রামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে আসার পর অনুভব করেছেন তার চরিত্রের পূর্ণ মহিমা মানুষের মধ্যে। দেবতার আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করে তিনি কৃতার্থ হয়েছেন। নাটক গুলির মধ্যে সেসব মহামানবের জীবন চরিত কথা বর্ণিত হয়েছে। 

৬. প্রহসনধর্মী নাটক: গিরিশ চন্দ্রের অন্যতম প্রহসন ধর্মী নাটক গুলি হল

১. সপ্তমীতে বিসর্জন (১৮৮৫) ২. বেল্লিক বাজার (১৮৮৬) ৩. বড়দিনের বকশিশ (১৮৮৭) ৪. সভ্যতার পান্ডা (১৮৯৪) ৫. য্যয়সা কি ত্যায়সা (১৮৯৬) প্রভৃতি। গিরিশচন্দ্র প্রহসন গুলি মূলত রঙ্গ মঞ্চের দিকে লক্ষ রেখে রচিত। আধুনিক সভ্যতার দোষ-ত্রুটি ,দুঃচরিত্র, সামাজিক ভ্রষ্টতার চিত্রই প্রহসন গুলির মূল উপাদান ছিল।

চ. গীতিনাটক: গিরিশ চন্দ্রের রচিত গীতি নাটক গুলি হল— 

১. আনন্দ রহাে (১৮৭৭) ২. আগমনী (১৮৭৭) ৩. অকালবােধন (১৮৭৭) ৪. দোললীলা (১৮৭৮) ইত্যাদি।

এগুলি গিরিশচন্দ্রের প্রথম যুগে রচনা এখানে নাট্য প্রতিভার বিকাশ ততটা ঘটেনি।

গিরিশচন্দ্র ঘােষের নাটক সাধনার প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলি হল—–

১. উনবিংশ শতাব্দীর নব মানবতাবাদি চিন্তা প্রকাশ তার নাটকে আছে এছাড়া দেশাত্মবােধ, জাতীয় চেতনা, ধর্মের নব মূল্যাযন তার নাটকে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। 

২. তিনি ছিলেন অত্যন্ত সমাজ সচেতন যার কারণে তৎকালীন সমাজের সমস্যা-সংকট তার নাট্য সাহিত্যে চিত্রিত হয়েছে। 

৩. স্বদেশ অনুরাগ ও ঐতিহাসিক চরিত্র অবলম্বন করে মানুষকে জাগানাের চেষ্টা তার নাটকে আমরা পাই। 

৪. মহাজীবনের কথা ত্যাগ-তিতিক্ষা বৈরাগ্য মহাজীবনের আদর্শ তার নাটকে আমরা দেখতে পাই।

৫. তার নাটকে আঙ্গিকের নৈপুন্যতা, নাটকের গ্রন্থ, সুন্দর গানের প্রয়ােগ এবং গৈরিশ ছন্দের সফল প্রয়ােগ যা তার নাটককে অনেক সমৃদ্ধ করেছে।

নাট্যতত্ব ও অভিনয় রীতি নিয়ে তার আলােচনা বাংলায় সৃষ্টির এক নতুন দিগন্ত উন্মােচিত করে দেয়। সমালােচকদের মতে সাধারণরঙ্গল্য প্রতিষ্ঠা, রঙ্গমঞ্চ পরিচালনা এবং অভিনয়শিল্পীর শিক্ষাদানে তার সমকক্ষ বাংলায় কেহ নাই। এবং একজন শ্রেষ্ঠ নাট্যকার। সামগ্রিক বিচারে তাকে বাংলার “শেক্সপিয়ার” বলাটা বােধ হয় অযৌক্তিক নয়।

আরো পড়ুন

নাট্যকার বাদল সরকার | বাংলা নাট্য সাহিত্যে বাদল সরকারের অবদান

বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান আলোচনা করো

বাংলা নাট্য সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো

বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে শ্রীরামপুর মিশনের অবদান আলোচনা করো

বাংলা নাট্য সাহিত্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদান আলোচনা করো

বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবদান

বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করো

বাংলা নাট্য সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো

Class 7 English 3rd Unit Test Question Paper 2022 PDF With Answers

Leave a Comment

error: Content is protected !!