বাল্যকাল | বাল্যকালের বিকাশগত বৈশিষ্ট্য | বাল্যকালের চাহিদা | Childhood in Bengali

Q: বাল্যকাল | বাল্যকালের বিকাশগত বৈশিষ্ট্য | বাল্যকালের চাহিদা | Childhood in Bengali
Q: বাল্যকালে শিশুদের মধ্যে কি কি বিকাশগত বৈশিষ্ট্য দেখা যায় তা আলােচনা কর।
Q: বাল্যকালে শিশুদের কি কি চাহিদা দেখা যায় তা বিস্তারিত ভাবে আলােচনা কর। 
Q: বাল্যকালে শিশুর মধ্যে কি কি দৈহিক চাহিদা দেখা যায় তা আলােচনা কর। 
Q: বাল্যকালে শিশুর মনােবৈজ্ঞানিক চাহিদা গুলি কি কি তা উল্লেখ করো।
Q: কোন সময়কালকে প্রস্তুতির স্তর বলা হয়?

উত্তর:

বাল্যকাল (Childhood) 

শৈশবের পরবর্তী কাল হল বাল্যকাল। সাধারণত 6 বছর থেকে 12 বছর বয়স পর্যন্ত সময়কালকে বাল্যকাল বলা হয়। মনােবিজ্ঞানীরা বাল্যকালকে আবার দু ভাগে ভাগ করেছেন – প্রারম্ভিক বাল্যকাল ও প্রান্তীয় বাল্যকাল। 

ক) প্রারম্ভিক বাল্যকাল: 6 থেকে 8 বছর বয়স পর্যন্ত সময়কালকে বলা হয় প্রারম্ভিক বাল্যকাল। প্রারম্ভিক বাল্যকাল হল বাল্যকালের প্রথম এবং শৈশবের পরবর্তী স্তর। তাই মনােবিজ্ঞানীরা বলেন এই সময় শিশুর বিকাশ গত বৈশিষ্ট্য গুলি খুব ভালােভাবে লক্ষ্য করা যায়। এই সময় শিশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঞ্চালনমূলক কাজকর্মের উন্নতি ঘটে। ভাষা ব্যবহারের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। শিশু সহজভাবে পরিবার ও বাইরের জগতের সঙ্গে মিশতে পারে।

বাল্যকাল

খ) প্রান্তীয় বাল্যকাল: 8 থেকে 12 বছর বয়স পর্যন্ত সময়কালকে বলা হয় প্রান্তীয় বাল্যকাল। এই সময় শিশুর দেহের অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্য গুলি পূর্ণতা লাভ করে। শিশু এমন কাজ করে যার মধ্যে সাহসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। সামগ্রিকভাবে বলা যায় এই স্তরের বিকাশ অপেক্ষাকৃত পরিণত।

বাল্যকালের বিকাশগত বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Childhood) : 

1) দৈহিক বিকাশ গত বৈশিষ্ট্য : 

বাল্যকালে শিশুর দৈহিক বিকাশের হার শৈশবের তুলনায় অনেকটা কমে যায়। এই সময় ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের দৈহিক বিকাশ অপেক্ষাকৃত বেশি হয়। শিশুদের দৈহিক আয়তন, উচ্চতা (প্রায় 2½ থেকে 3 ইঞ্চি) ও ওজন (3 থেকে 4 কেজি) বাড়তে থাকে। এই সময় শিশু দেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ, যেমন- হৃদপিণ্ড, ফুসফুস পেশীতন্ত্র ইত্যাদি পরিণত হয়। এই বয়সে শিশুদের দৌড়ানাে, লাফানাে, ছােটাছুটি করার ক্ষমতা যেমন বাড়ে তেমনি তাদের সঞ্চালন মূলক কাজের দক্ষতাও বাড়ে। এই সময় শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ পরিপূর্ণ হয়।

2) মানসিক বিকাশ গত বৈশিষ্ট্য : 

এই স্তরে শিশুর বুদ্ধির বিকাশ খুব দ্রুত হয়। তাদের মধ্যে ভাষা ব্যবহারের ক্ষমতাও বাড়তে থাকে, স্মৃতিশক্তির বিকাশ ঘটে। স্থান কাল পাত্র ইত্যাদি সম্পর্কে তাদের ধারণা গড়ে ওঠে। এই সময় শিশুর মধ্যে আগ্রহ, কৌতূহল ও মনােযােগ প্রবল হয়। শিশুর চিন্তাশক্তি যথেষ্ট পরিণত হয়। শিশুদের মধ্যে প্রক্ষোভ বাড়তে থাকে। বিভিন্ন ধরনের জিনিস সঞ্চয় করতে এরা ভালােবাসে। এই সময় শিশু নাচ, গান, অভিনয়, ছবি আঁকা ইত্যাদির প্রতি আকৃষ্ট হয়। এই বয়সে শিশুদের মধ্যে নীতিবােধ গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বহু দুঃসাহসিক কাজের মনােভাব লক্ষ্য করা যায়।

3) সামাজিক বিকাশ গত বৈশিষ্ট্য: বাল্যকালে শিশুর সামাজিক গণ্ডি ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। শিশু সহজেই পরিবার ও বাইরের জগতের সঙ্গে মিশতে পারে। এই সময় শিশুর মধ্যে দলগত চিন্তা, দলের প্রতি আনুগত্য, সহানুভূতি ও প্রতিযােগিতা মূলক মনােভাব গড়ে ওঠে। শিশুর মধ্যে নেতৃত্ববােধের ক্ষমতাও লক্ষ্য করা যায়। সামাজিক রীতিনীতি, অনুশাসন, শৃঙ্খলা, মেনে নেওয়ার চেষ্টা করে। এই সময় শিশুর মধ্যে সৃজনশীলতা বােধ গড়ে ওঠে। খেলাধুলা ও নানারকম গঠনমূলক কাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা বা জাহির করার প্রয়াস দেখা যায় সেজন্য অনেক মনােবিদ এই বয়সকে Age of mastery and achievement বা প্রস্তুতি স্তর বলে বর্ণনা করেছেন। বাল্যকালে শিশুর সামাজিক জীবনের বিকাশ অন্যান্য বিকাশের মতােই পূর্ণতা পায়।

বাল্যকালের চাহিদা (Needs of Childhood) : 

বাল্যকালে শিশুর চাহিদাগুলিকে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয– দৈহিক চাহিদা, মনােবৈজ্ঞানিক চাহিদা ও সামাজিক চাহিদা। 

1) দৈহিক চাহিদা (Physical Need) :

বাল্যকালে শিশুর দৈহিক বিকাশ শৈশবকালের তুলনায় কম হলেও কতগুলি দৈহিক চাহিদা লক্ষ্য করা যায়। সেগুলি হল – 

a) খাদ্যের চাহিদা (Need for food) : দেহের বিকাশের জন্য এই স্তরে শিশুদের মধ্যে খাদ্যের চাহিদা বেশি থাকলেও শিশুরা খাদ্য ও অখাদ্য বস্তুর মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। তারা প্রযােজনমতােও পছন্দমত খাদ্যবস্তু নির্বাচন করতে পারে। 

b) চলনের চাহিদা (Need for movement) : এই বয়সের শিশুদের মধ্যে পেশী সঞ্চালনের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। দৌড়ানাে, লাফানাে ইত্যাদির কাজের মধ্য দিয়ে শিশুদের মধ্যে পেশী সঞ্চালনমূলক কাজে ক্ষমতা লাভ করে।

c) পুনরাবৃত্তির চাহিদা (Need for repetition) : এই স্তরের প্রথমদিকে শিশুদের মধ্যে পুনরাবৃত্তি চাহিদা খুব কমই থাকলেও শেষের দিকে তাদের এই চাহিদা আবার বৃদ্ধি পায়। মনােবিজ্ঞানীরা বলেন, এই বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যে দৈহিক পুনরাবৃত্তির তুলনায় মানসিক পুনরাবৃত্তি বেশি দেখা যায়। যেমন – বিভিন্ন জ্ঞানমূলক বিষয় পাঠে পুনরাবৃত্তি, শিশুদের বৌদ্ধিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। 

d) সক্রিয়তার চাহিদা (Need for Activity) : এই বয়সে শিশুরা যে সমস্ত কাজ করে সেগুলাে অর্থপূর্ণ হয়। শিশুদের কোন কাজ দিলে তারা সক্রিয়তার সঙ্গে তা সম্পন্ন করে এবং কাজ করতে পেরে তারা খুশি হয়। তবে এককভাবে কোনাে কাজ করার থেকে দলগত ভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে এদের মধ্যে সক্রিয়তা বেশি দেখা যায়।

2) মানসিক চাহিদা (Psychological Need) : 

এই স্তরে শিশুর মানসিক চাহিদা গুলাে অনেকটা বাস্তব জীবনমুখী। শিশুদের মানসিক চাহিদা গুলি হল – 

a) অভিজ্ঞতার চাহিদা (Need for experience) : এই বয়সের শিশুদের মধ্যে বাইরের জগতের সঙ্গে পরিচিতি বাড়তে থাকায় নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করে। বিভিন্ন সামাজিক কাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জনে আগ্রহী হয়। শিক্ষকশিক্ষিকা, বাবা-মা ও গুরুজনদের কাছ থেকে নতুন নতুন বিষয় সম্পর্কে জানতে চায়। তাই এই বয়সে শিশুদের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ জ্ঞানের বিকাশ ঘটে।

b) নিরাপত্তার চাহিদা (Need for security ) : এই সময় শিশুদের মধ্যে প্রবলভাবে নিরাপত্তার চাহিদা দেখা যায়। বাল্যকালে শিশু পরিবার ও পরিবারের বাইরে অন্যান্য ব্যাক্তিদের থেকে দৈহিক ও মানসিক নিরাপত্তা আশা করে। নিরাপদ আশ্রয় এবং সকলের সমর্থন পেতে চায়। 

c) অনুকরণের চাহিদা (Need for imitation) : এই সময় শিশু কিন্তু সম্পূর্ণ সকলকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে না। শিশু যাদের পছন্দ করে বা সম্মানের চোখে দেখে বড় হওয়ার সাথে সাথে তাদের অনুসরণ করার চেষ্টা করে। যেমন পিতা-মাতা, শিক্ষ-শিক্ষিকা, সমাজের কোনাে সম্মানীয় ব্যক্তিকে অনুসরণের মাধ্যমে শিশুরা পরােক্ষভাবে তাদের ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা পরিতৃপ্ত করে। 

d) আয়ত্তে আনার চাহিদা (Need for Possession ) : শৈশবে শিশুর চাহিদা বস্তুকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। কিন্তু বাল্যকালে ব্যক্তির উপর চাহিদা বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ, শিশু সবসময় তার আপনজনকে নিজের অধীনে রাখতে চায়। এই স্তরে শিশুরা যে কোন বস্তুকে সমবয়সীদের সাথে ভাগ করে নেয়। 

e) অনুসন্ধানের চাহিদা (Need for exploration) : এই স্তরে শিশুদের মধ্যে কৌতুহল এর চাহিদা খুব বেশি মাত্রায় থাকে। কৌতুহলের বশে সমাজজীবনের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে ও ব্যক্তিজীবনের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানতে চায় সবকিছুকে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখতে চায়। পরিবেশের না জানা, না দেখা বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে চায়। অনুসন্ধানের এই তাড়নাতেই শিশুরা নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনে করে।

f) আত্মপ্রকাশের চাহিদা (Need for self expressions) : এই বয়সের শিশুদের মধ্যে আত্মপ্রকাশের চাহিদা প্রবল মাত্রায় দেখা যায়। এই স্তরে শিশুদের ভাষা জ্ঞান উন্নত হওয়ায় তারা ভালাে কথা বলার মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে থাকে। ছবি আঁকা, মাটির জিনিস তৈরি ইত্যাদি করা শেখে। তাদের কাজের কেউ প্রশংসা করলে তারা খুব আনন্দ পায়। 

3) সামাজিক চাহিদা (social need) :

সামাজিক বিকাশের কারণে এই সময় শিশুদের মধ্যে উন্নত ধরনের সামাজিক চাহিদা লক্ষ্য করা যায়। সেগুলি হল – 

a) সহযােগিতার চাহিদা (Need for Cooperation) : বাল্যকালে শিশুদের মধ্যে সহযােগিতার চাহিদা দেখা যায়। এই সময় শিশুদের মধ্যে পরস্পর সহযােগিতা করার মনােভাব দেখা যায় তারা একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে চায়। 

b) সমবেদনার চাহিদা (Need for social approval) : এই বয়সে শিশুদের মধ্যে সমবেদনামূলক মনােভাব দেখা যায়। অন্য কেউ সমস্যায় পড়লে তার সমস্যা দূর করার জন্য সমস্ত রকম চেষ্টা করে।

c) প্রতিদ্বন্দিতার চাহিদা (Need for Rivalry) : শৈশবের তুলনায় বাল্যকালে প্রতিদ্বন্দিতার চাহিদা অনেকটাই কমে যায়। তবে নিজের সফলতা আনার জন্য প্রয়োজনবােধে পরস্পরের মধ্যে প্রতিযােগিতায় লিপ্ত হয়। 

d) দল গঠনের চাহিদা (Need for Teamwork) : মনােবিজ্ঞানীরা বলেন এই সময় শিশুদের মধ্যে দল গঠনের চাহিদা বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করা যায়। এই সময় শিশুরা দলগতভাবে থাকতে, দলগতভাবে যেকোনাে কাজ করতে ভালবাসে। 

e) নৈতিক চাহিদা (Moral Need) : এই সময় শিশুর মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক অভিজ্ঞতা থেকে নৈতিক বােধ জাগ্রত হয়। যার কারণে ইচ্ছাকৃতভাবে কোন অপরাধমূলক কাজ করার চেষ্টা করে না এবং অপরকে করতে সাহায্য করে না। বিভিন্ন ধরনের নৈতিক শিক্ষামূলক কাহিনী, গল্প পড়তে ও শুনতে ভালােবাসে। এইসময় কাহিনীতে বর্ণিত কোন ঘটনা তারা বিশ্বাস করে এবং দৈনন্দিন জীবনে সেগুলাে প্রয়োগ করার চেষ্টা করে।

আরো পড়ুন

কৈশোরকাল | কৈশোরকালের বিকাশগত বৈশিষ্ট্য, চাহিদা | Adolescence in Bengali

প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও পাঠক্রম সম্পর্কে কোঠারি কমিশনের সুপারিশ

অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষা বা অপ্রথাগত শিক্ষা | Informal Education In Bengali

প্রাচীন অনুবর্তন কাকে বলে | প্যাভলভের প্রাচীন অনুবর্তন তত্ত্ব | Classical Conditioning

মুদালিয়ার কমিশনের সুপারিশ | Mudaliar Commission (1952-53) in Bengali

বৃদ্ধি ও বিকাশের মধ্যে পার্থক্য | জীবন বিকাশের বিভিন্ন স্তর | Difference between Growth and Development

Leave a Comment

error: Content is protected !!