Q: বাংলা নাট্য সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো।
Q: বাংলা নাট্য সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান ও কৃতিত্ব আলোচনা করো।
Ans:
বাংলা নাট্য সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান
বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার এবং ঐতিহাসিক নাটকের শ্রেষ্ঠ রচয়িতা দ্বিজেন্দ্রলাল রায় আজ ও রঙ্গমঞ্চের এক উজ্জ্বলপুরুষরূপে অনন্য মর্যাদার অধিকারী। বিদেশে অধ্যায়নকালে তিনি পাশ্চাত্য নাট্য ভাবনার সঙ্গে পরিচিত হন। নাটক পাঠ এবং তাদের অভিনয় দর্শন নাটকের সমস্তভাব তার চিত্তকে মুদ্রিত করে দেয়। তার সৃষ্ট নাটক সাহিত্যরুপে যেমন সমৃদ্ধ হয়েছে মঞ্চায়ন ক্ষেত্রেও তাদের ঔৎকর্ষ | প্রতিপাদিত হয়েছে। বিশেষ করে পাশ্চাত্য আঙ্গিক নাট্য সাহিত্যে প্রয়ােগের ক্ষেত্রে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। নাট্য সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান মূলত ঐতিহাসিক নাট্যকার রূপে। তাছাড়া উনিশ শতকের বাংলাদেশ নবচেতনার বিকাশে তার নাটক গুলির ভূমিকা ছিল অসামান্য। তাঁর রচিত নাটক গুলি বিষয় আঙ্গিকে শ্রেণীবিভাগ করে নিম্নে আলােচনা করা হলাে –
ক) ঐতিহাসিক নাটক:
দ্বিজেন্দ্রলালের নাট্যপ্রতিভা সর্বোত্তম প্রকাশ পেয়েছে ঐতিহাসিক নাটক গুলিতে। তীব্র স্বাদেশিক ভাবনা জাতীয়তাবাদের উন্মেষ বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ তার ঐতিহাসিক নাটকের প্রেক্ষাপট নির্মাণ করেছে। তার রচিত ঐতিহাসিক নাটক গুলি হল— তারাবাঈ (১৯০৩), প্রতাপ সিংহ (১৯০৫), দুর্গাদাস (১৯০৫), নুরজাহান (১৯০৪), মেবার পতন (১৯০৮) শাজাহান (১৯০৯) চন্দ্রগুপ্ত (১৯১১), সিংহল বিজয় (১৯১৫) প্রভৃতি।
তারাবাঈ: তারাবাঈ দ্বিজেন্দ্রলাল রাযের সর্বপ্রথম ইতিহাস আশ্রিত নাটক নাটকের মূল বৃত্তান্ত রাজস্থান থেকে গৃহীত। জাতীয় আন্দোলনের পাশাপাশি যে নারী মুক্তির আন্দোলন সেসময় চলছিল সেই দিকের প্রতি দৃষ্টি রেখে নাট্যকার তারাবাঈ চরিত্র কে অঙ্কন করেছেন।
প্রতাপ সিংহ: নাট্যকার প্রতাপ সিংহ কে জাতীয় বীর রূপে গ্রহণ করেছেন। স্বদেশ আন্দোলনের পটভূমিকায় নাট্যকার বীরশ্রেষ্ঠ প্রতাপ সিংহের শৌর্য-বীর্য দেশপ্রেম ও অতুলনীয় আত্মত্যাগের মহিমা চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রতাপের সংগ্রামশীলতা ও দুঃখ্য বরণের কাহিনী সে যুগের রাজনৈতিক আবহাওয়ার মধ্যে নতুন প্রেরণা সঞ্চার করেছিল।
দুর্গাদাস: টডের রাজস্থান কাহিনীকে অবলম্বন করে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় দুর্গাদাস নাটকটি রচনা করেন। বঙ্গভঙ্গের পটভূমিকায় স্বদেশপ্রেমের বীরত্বের রূপকে অতিমাত্রায় দেখবার পক্ষপাতী ছিলেন নাট্যকার — যা তখনকার নেতাদের মধ্যে অভাব ছিল। আর সেই কারণেই চরিত্রটির মধ্যে উচ্ছ্বসিত স্বদেশ প্রেম ও অপূর্ব কীর্তির উপস্থাপনা করেছেন।
নূরজাহান: নুরজাহান নাট্যকারের স্বতন্ত্র ও সার্থক সৃষ্টি। নাট্যকার তৎকালীন জীবনের পটভূমিকায় দুই বিপরীত চিত্তবৃত্তি দেখাতে চেয়েছেন, একদিকে ঘরােয়া তৃপ্তিতে পরিপূর্ণ নারীর মানবীয় সত্তা। অন্যদিকে দয়ামায়াহীন পৈশাচিক সত্তা। এই দুই বিপরীত চিত্র দিয়ে কিভাবে নুরজাহান চরিত্রের দানবীয় সত্তার কাছে মানবীয় সত্তার পরাজয় ঘটলাে। এটাই চরিত্রটির মধ্যে নাট্যকার রূপায়িত করেছেন।
মেবার পতন: নাটকটিতে জাতীয় ভাবধারার প্রতিফলন থাকলেও জাতীয় প্রেমী সমাপ্ত নয় তা বিশ্ব প্রেমে পরিব্যপ্ত। দ্বিজেন্দ্রলালের যুক্তিবাদী মন জাতীয়তা অপেক্ষা মনুষ্যত্বকেই বড় বলে মনে করেছেন। নাটকটির মধ্য দিয়ে নাট্যকার মনুষ্যত্বের সন্ধানীই করেছেন।
শাজাহান: মােগল যুগের এক কুটিল ভয়ংকার ষড়যন্ত্র ভাত্রি বিদ্রোহের প্রবল সংঘাতময় জীবনের। কথা শাহজাহান নাটকের মধ্য দিয়ে নাট্যকার প্রকাশ করেছেন। যেখানে শাহজাহানের অসহায়তা ও অক্ষমতা এবং ওরঙ্গজেব এর ভয়ঙ্কর নির্মম অত্যাচারের চিত্র চিত্রিত করেছেন নাট্যকার। ওরঙ্গজেব সবকিছু পেয়েও নিজের মনুষ্যত্বের কাছে পরাজিত হয়েছেন যার কারণে শেষ পর্যন্ত নিজেকে অপরাধী মনে করে পিতার পদপ্রান্তে নিক্ষেপ করেছে। অন্যদিকে নায়ক শাজাহান অপরাধী পুত্রকে ক্ষমা করে তার বাৎসল্য স্নেহের রূপটিকে স্পষ্টরূপে উপলব্ধি করেছেন।
চন্দ্রগুপ্ত: চন্দ্রগুপ্ত তার বৈমাত্রেয় ভাই নন্দকে সিংহাসনচ্যুত করে চাণক্যের সাহায্যে বিশাল মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন তার ঘটনা এই নাটকে বর্ণিত হয়েছে।
সিংহল বিজয়: দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় সিংহল বিজয়। বিজয় সিংহের সিংহল বিজয় কাহিনী অবলম্বনে নাটকটি রচিত। এই নাটকে নাট্যকারের দেশপ্রেম প্রকাশ ঘটেছে।
খ) পৌরাণিক নাটক:
দ্বিজেন্দ্রলাল রাযের পৌরাণিক নাটকে ভক্তিরস, অলৌকিকতা, দেবতাদের অপ্রতিরােধ্য তা বর্জন করে। এক প্রকার চরিত্রগুলি আধুনিক জীবন যন্ত্রণা ও মানবিকতা পূর্ণ রূপ দিয়েছেন। তার পৌরাণিকনাটক গুলি হল—- পাষানী (১৯০০) ,সীতা (১৯০৮), ভীষ্ম (১৯১৪)।
পাষাণী: দ্বিজেন্দ্রলালের প্রথম পৌরানিক নাটক পাষানী। নাটকটিতে একটি স্বতন্ত্র নারীর অন্তর্দ্বন্দ্ব ও প্রেম সমস্যাকে দ্বিজেন্দ্রলাল ফুটিয়ে তুলেছেন। নাট্যকার অহল্যার পাপকে তার আচার-আচরণ কে
সহানুভূতির আলােকে ব্যাখ্যা করেছেন। সমাজ শাসনের ঊর্ধ্বে নারীর সংস্কারমুক্ত হৃদয় আবেগকে তিনি এই নাটকে রূপ দিতে চেয়েছেন। এমনকি বারান্সনাকেও সমাজ সহানুভূতির সঙ্গে গ্রহণ করলে তার মধ্যেও আদর্শ পত্নীর সন্ধান পাওয়া যায়। এই ধরনের সামাজিক আদর্শ পাষানী নাটকে নাট্যকার ব্যক্ত করতে চেয়েছেন।
সীতা: সীতা নাটকের রামায়ণের উত্তরাখন্ড ও ভবভূতীর উত্তর রামচরিত এর কাহিনী অবলম্বন করলেও নিজস্ব যুক্তি-বুদ্ধি মন ও সমাজ দৃষ্টির নিরিখে রামচরিত অঙ্কনে চিরাচরিত আদর্শ পরিত্যাগ করে ব্যক্তিসত্তা ও সমাজ সত্তাতার দ্বন্দ্ব দেখেছেন এই নাটকের মধ্য দিয়ে।
গ) প্রহসনধর্মী নাটক:
দ্বিজেন্দ্রলাল তার প্রহসন গুলিতে সমকালীন সমাজের নানা দোষ-ক্রটি কে কষাঘাতে জর্জরিত করেছেন। তাই তার প্রহসনে প্রাচীন কুসংস্কারকে যেমন ব্যঙ্গ করেছেন তেমনি ব্যঙ্গ করেছেন উগ্র সংস্কারপন্থীদের ও সংস্কারের নামে ভন্ডামি কে। তার রচিত প্রহসন গুলি হল—– কল্কি অবতার (১৮৯৫), বিরহ (১৮৯৭), ত্র্যহস্পর্শ (১৯০০), প্রায়শ্চিত্ত (১৯০২) পুনর্জন্ম (১৯১১),আনন্দ বিদায় (১৯১২) প্রভৃতি।
পুনর্জন্ম: এক কৃপণ হীনমনা কুৎসিত জিবীর প্রকৃত শিক্ষা লাভের কথা কৌতুক ব্যাঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে পুনর্জন্ম নাটকে।
ত্র্যহস্পর্শ: এই প্রহসনে বৃদ্ধ বয়সে বিজয় গােপালের বিবাহ ইচ্ছা কে কেন্দ্র করে নাটকের ঘটনাবলী সংঘটিত হয়েছে। প্রহসনটি শিল্পসৃষ্টির দিক থেকে সার্থক না হলেও সমাজের বিভিন্ন সরূপের পরিচায়ক হয়ে উঠেছে।
প্রায়শ্চিত্ত: প্রহসনটিতে বিলেতফেরত সমাজের কৃত্রিমতা ও আচার-আচরণের অতিশয্য, নবহিন্দুদের স্ত্রীশিক্ষা দেওয়ার উৎকট প্রচেষ্টা ও শিক্ষিত মহিলাদের শিক্ষার নামে কুশিক্ষা কে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। এছাড়া সেই সময়ের নারী জাতির অসহায়তার চিত্র এই প্রহসনের তুলে ধরা হয়েছে।
ঘ) সামাজিক নাটক:
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দ্বিজেন্দ্রলাল দুটি সামাজিক নাটক রচনা করেছেন। নাটক দুটি হল —- পরপারে (১৯১২), বঙ্গনারী (১৯১৬)।
পরপারে: এই নাটকে বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের মূঢ়তা ও ভন্ডামীর চিত্র চিত্রিত হয়েছে। মহিম মাতৃভক্ত হয়ে স্ত্রীর প্ররােচনায় মাকে পরিত্যাগ করে। এরপর সে বীরাঙ্গনা ও মদে আসক্ত হয় ঘটনাচক্রে বারবণিতা শান্তাকে গুলিবিদ্ধ করে স্ত্রী সহযােগিতায় মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে অবশেষে শান্তার কাছে পরপার সম্পরকিত দিক্ষা গ্রহণ করে এই ছিল নাটকের কাহিনী।
বঙ্গনারী: নাটকে পণপ্রথা ও বাল্য বিবাহের কুফল বর্ণিত হয়েছে। এ নাটকে গিরিশচন্দ্র এর প্রভাব যথেষ্ট রয়েছে।
দ্বিজেন্দ্রলালের নাটকের বৈশিষ্ট্য গুলি আমরা স্মরণ করতে পারি—-
অ. দ্বিজেন্দ্রলাল প্রকৃত অর্থে যুগ প্রবর্তক বলা যায় আধুনিকতার প্রথম স্রষ্টা।
আ. তিনি জাতির হৃদস্পন্দন ধরেছেন এবং তা যথাযথ প্রকাশ করেছেন।
ই. তার নাটকের তীব্র দ্বন্দ্ব-সংঘাত সংকুল কাহিনী ও বিন্যাস পাঠক ও দর্শকদের চিত্তকে টানটান উত্তেজিত করে রাখে।
ঈ. তার চরিত্র গুলি গভীর ভাবময় ও অন্তর্দ্বন্দ্বে তীব্র জর্জরিত– মানব চরিত্রের গহীন বহিঃপ্রকাশ তার নাটকে আছে সার্থকভাবে।
উ. দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাটকে সংগীতের প্রয়োগ একটা ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।
ঊ. তার নাটকের ভাষা অপরূপ সমৃদ্ধ ,তা তীক্ষ্ণ আবেগ ও ভাব উচ্ছাসিত যা মুহূর্তের মধ্যেই পাঠক ও দর্শকদের চিত্তকে মনমুগ্ধ করে তােলে।
—- পরিশেষে বলতে পারি তার নাটকের চরিত্র-চিত্ৰন রীতি, মানসিক দ্বন্দ্ব প্রভৃতিতে সেক্সপিয়ের নীতি অনুসৃত হয়েছে। এছাড়া উত্তপ্ত বাগধারা, ভাষারীতির উত্থান-পতন, অপূর্ব কাব্যধর্মী সংলাপ এসব তিনি অনুসরণ করেছিলেন নাট্যকার শীলার কাছ থেকে। যার কারণে অভিনয়ের অতিরিক্ত পাঠযােগ্য সাহিত্যগুনগুলােও খুব উচ্চস্তরের হয়েছে । গিরিশচন্দ্র কে ছেড়ে দিলে তাকেই ঐতিহাসিক নাটক রচনার পথিকৃৎ আমরা বলতে পারি। বা নাট্য সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে আমরা বিবেচিত করতে পারি।
আরো পড়ুন
নাট্যকার বাদল সরকার | বাংলা নাট্য সাহিত্যে বাদল সরকারের অবদান
বাংলা প্ৰবন্ধ সাহিত্যে প্ৰমথ চৌধুরীর অবদান লেখো
বাংলা নাট্য সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো
বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে শ্রীরামপুর মিশনের অবদান আলোচনা করো
বাংলা নাট্য সাহিত্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদান আলোচনা করো
বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবদান
বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করো
বাংলা নাট্য সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো
রাধাকৃষ্ণন কমিশন বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন | Radhakrishnan commission (1948-49) in Bengali