শিক্ষায় বৌদ্ধ দর্শনের প্রভাব কি | Significance of Buddhism in Education in Bengali
উত্তর:
শিক্ষায় বৌদ্ধ দর্শনের প্রভাব
1) শিক্ষায় সমান অধিকার : শিক্ষাক্ষেত্রে সকলের সমান অধিকার রযেছে। বুদ্ধদেব প্রাথমিক ভাবে উপলব্ধি করেছিল জাতি, ধর্ম, বর্ণ, আর্থসামাজিক অবস্থার নিরিখে সকলেই সমান। বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থায় সকল ধর্মের শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারত। আধুনিক শিক্ষা ক্ষেত্রেও জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেরই শিক্ষায় সমান অধিকার রয়েছে।
2) শিক্ষার লক্ষ্য : বৌদ্ধ জীবনদর্শনে জগৎ থেকে মুক্তিলাভ বা নির্বাণ লাভই জীবনের চরম লক্ষ্য বলে মনে করা হয়। সংসারের বন্ধন থেকে মুক্তির মাধ্যমে পরিনির্বাণ লাভ করার জন্য বৌদ্ধ শাস্ত্রে অষ্টাঙ্গিক মার্গের কথা বলা হয়েছে। এই নীতির চর্চা করতে পারলে চিত্তের উন্নতি হয় এবং পরম জ্ঞান প্রাপ্ত হয়। পরম জ্ঞান লাভ করলে মানুষের নির্বাণ লাভ ঘটে। এটাই ছিল বৌদ্ধ শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য।
3) প্রবজ্যা : ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থায় উপনয়নের মত প্রবজ্যা ছিল বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার শুরুর অনুষ্ঠান। এখানে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণের জন্য আচার্যের কাছে এসে অনুরােধ জানাতে হত। আট বছর বয়সের আগে কোন শিক্ষার্থী প্রবজ্যায় অংশগ্রহণ করতে পারত না। প্রবজ্যা গ্রহণের প্রথম অবস্থায় শিক্ষার্থীকে শ্রমন বলা হত। সংঘে প্রবেশের কতগুলি শর্ত ছিল – শিক্ষার্থীকে রােগ মুক্ত হতে হবে, তাকে দাসত্ব, ঋণ ও রাজকার্য থেকে মুক্ত হতে হবে। এখানে বিহার বা সংঘ গুলি ছিল শিক্ষাগ্রহণের পীঠস্থান। বৌদ্ধ শিক্ষায় জ্ঞানদান, চরিত্র গঠন ও সর্বাঙ্গিন শিক্ষার দায়িত্ব ছিল আচার্যের। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধন করা। এই কাজে শিক্ষার্থীকে সাহায্য করেন শিক্ষক।
4) উপসম্পদা : শ্রমন কুড়ি বছর বয়সে পূর্ণ ভিক্ষুকে পরিণত হত উপসম্পদা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। একটি বিশেষ দিনে শিক্ষার্থীকে একটি বিশেষ জায়গায় বসিয়ে বিশিষ্ট উপাধ্যায় মন্ডলী ও শিক্ষার্থীরা উপস্থিত হয়ে ওই শিক্ষার্থীকে নানা প্রশ্ন করতেন, প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর পেলে শিক্ষার্থীকে উপসম্পদা প্রদান করা হত। উপসম্পদা অনুষ্ঠানের পর শিক্ষার্থী বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হয়ে মঠেই স্বাস্থ্য আলােচনা করত। পরিবারের সঙ্গে তার কোনাে যােগাযােগ থাকত না। পবিত্র জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠত ওই বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। বর্তমান শিক্ষায় পরীক্ষা ব্যবস্থার অনুরূপ।
5) শিক্ষক শিক্ষার্থী সম্পর্ক : বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক ছিল পিতা পুত্রের ন্যায়। বৌদ্ধ শিক্ষা আবাসিক হওয়ার ফলে শিক্ষার্থীরা সবসময় শিক্ষক বা উপাধ্যায়ের সংস্পর্শ থাকতাে। ফলে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, আত্মপ্রত্যয়, আত্মসংযম দিয়ে গড়া একটি আদর্শ জীবনযাপনের নিদর্শন ছিল বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাতে যা অনুকরণযােগ্য।
6) পাঠক্রম : বৌদ্ধ পাঠক্রম মূলত ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ভাবনায় পুষ্ট ছিল। কারণ জীবনের চরম লক্ষ্য ছিল নির্বাণ লাভ। ত্রিপিটক ও অন্যান্য দর্শন পঠন-পাঠন ছাড়াও পাঠক্রমের মধ্যে ছিল সুতাে কাটা, বয়ন শিল্প, সূচি শিল্প, অঙ্কন বিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র, শল্য চিকিৎসা, মুদ্রা প্রস্তুতিকরণ, এগুলি ছাড়াও আরও উন্নিশটি শিল্প ছিল। প্রাথমিক শিক্ষায় পড়া, লেখা ও গণিত বিষয়ের জ্ঞান অর্জনের উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। উচ্চশিক্ষার স্তরে ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য ছাড়াও ব্যবহারিক জীবনের উপযােগী বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঠক্রম ও সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে এগুলি বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে নেওয়া হযেছে।
7) শিক্ষার মাধ্যম : বৌদ্ধ শিক্ষায় শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে জনসাধারণের ভাষাকে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছিল। এটি বৌদ্ধ শিক্ষার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। প্রথম অবস্থায় পালি ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হত। পরে আঞ্চলিক ভাষা বা মাতৃভাষার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। অর্থাৎ, পরবর্তী পর্যায়ে বৌদ্ধ শিক্ষার মাধ্যম হয় মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা। এরপর থেকেই শিক্ষা ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষার গুরুত্ব বাড়ে। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
8) সমাজসেবা : বুদ্ধদেব মানব জীবনের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক দিককে যেমন গুরুত্ব দিয়েছিলেন তেমনি ব্যবহারিক দিকেরও সমান গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ব্যক্তি যখন নিজের স্বরূপ জানবে, আত্ম মুক্তির পথ খুঁজে পাবে তখন তার লক্ষ্য হবে সমাজসেবা। কারণ সকলের সেবার মধ্য দিযেই আসবে আত্ম মুক্তি। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাতেও সমাজসেবামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়।
9) শিক্ষণ পদ্ধতি : বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল মৌখিক। এখানে মুখে মুখে ধর্ম শিক্ষা দেওয়া হত। শিক্ষার্থীর বৌদ্ধিক উন্নয়নের জন্য ছিল আলােচনা ভিত্তিক পদ্ধতি। শিক্ষার্থী স্বাধীনভাবে তার নিজস্ব চিন্তা ও তত্ত্বের অনুশীলন ও চর্চা করতেন। বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থায় বাস্তব দৃষ্টান্তের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হত। মাঝেমাঝে জ্ঞানীগুণীর সমাবেশে আলােচনাচক্র ও বিতর্ক সভার আয়ােজন করা হত। এছাড়াও শ্রেণিশিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষাদানেরও ব্যবস্থা ছিল। ব্যবহারিক জ্ঞান আহরনের জন্য ভ্রমনমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হত। বৌদ্ধ শিক্ষার ক্ষেত্রে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে খ্যাতি অর্জন করেছিল। এই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীর মানসিক সামর্থ ও প্রবণতা অনুযায়ী শিক্ষা দেওয়া। বর্তমান শিক্ষাক্ষেত্রেও পাঠক্রম রচিত হয় শিক্ষার্থীর মানসিক সামর্থ, চাহিদা ও প্রবণতা অনুযায়ী।
আরো পড়ুন
বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করো | Buddhist Education System in Bengali
প্রয়ােগবাদ (Pragmatism) কি | প্রয়ােগবাদী দর্শনের মূলনীতি | শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োগবাদের প্রভাব
দর্শন কি | দর্শনের সংজ্ঞা দাও | দর্শনের স্বরূপ বা প্রকৃতি আলোচনা করো
যোগ দর্শন (Yoga Philosophy) | Indian Philosophy (ভারতীয় দর্শন)
সাংখ্য দর্শন (Sankhya Philosophy) | Indian Philosophy (ভারতীয় দর্শন)
ন্যায় দর্শন কি | শিক্ষায় ন্যায় দর্শনের প্রভাব কি | What is Nyaya Philosophy in Bengali
ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর | Brahmanical System of Education in Bengali