অভিসার কাকে বলে | অভিসার পদের ভাব সৌন্দর্য বিচার | অভিসারের শ্রেষ্ঠ পদকর্তার কবি কৃতিত্ব

Q: অভিসার কাকে বলে ?
Q: অভিসার পদের ভাব সৌন্দর্য বিচার করো ?
Q: অভিসারের শ্রেষ্ঠ পদকর্তার কবি কৃতিত্ব আলোচনা কর ।

উত্তর:

অভিসার :

নায়কের উদ্দেশ্যে নায়িকার কিংবা নায়িকার উদ্দেশ্যে নায়কের যে গমন তাকেই বলে অভিসার। বৈষ্ণব সাহিত্যে অভিসার পথ এক অসামান্য প্রান রসের সঞ্জীবিত। ভারতীয় দর্শনে ও সাহিত্যে নায়িকা অভিসার করে নায়কের উদ্দেশ্যে। দুঃখ কষ্ট বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে সে প্রিয়তমের উদ্দেশ্যে অভিসারে গমন করে। রুপ গোস্বামী উজ্জ্বল নীলমণি গ্রন্থে অভিসারের সংজ্ঞা দিয়েছেন এরূপ – 

যাভিসারয়তে কান্তং স্বয়ং ব্যভিসরত্যপি।
সা জ্যোৎস্নী তামসী যানোযোগ্যযেষাভিসারিক।।”

যে নায়িকা কান্তকে অভিসার করান অথবা নিজে অভিসার করেন তাকে অভিসারিকা বলে। এই অভিসার দুই প্রকার হতে পারে- একটা জ্যোৎস্না আর একটা তামসী। বস্তুত নায়ক নায়িকার পারস্পরিক অনুরাগ হেতু মিলনের অভিলাসে একটি সংকেতপূর্ণ স্থানে সমস্ত বাধা-বিপত্তি কে অতিক্রম করে চলাই হল অভিসার।

রূপ গোস্বামী দুই রকম অভিসারের কথা বললেও পরবর্তীকালে বৈষ্ণব আচার্যরা ৮ প্রকারের অভিসারের নাম উল্লেখ করেছেন । যথা জ্যোৎস্না অভিসার, তামসী অভিসার, বর্ষা অভিসার, দিবা অভিসার, কুঞ্ঝটিকা অভিসার, তীর্থযাত্রা অভিসার, উন্মত্তা অভিসার, সঞ্চায়া অভিসার।

→ অভিসারের এক প্রান্তে গৃহ, অন্য প্রান্তে কুঞ্জ, মাঝখানে দীর্ঘ পথ। একদিকে সমাজ সংসার সংসারের মধ্যে কুলবধূ রাধা কাতর অন্যদিকে পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদন করার অসীম আকুতি। অভিসার পদে এই আকুতি বাণীই রূপ লাভ করেছে। পদাবলী সাহিত্যে অভিসারের মত একটি লৌকিক বিষয়কে আশ্চর্য দক্ষতার সঙ্গে কবিগণ অলৌকিকতার পথে নিয়ে গেছেন। অন্যান্য সাহিত্যের মত বৈষ্ণবসাহিত্যে অভিসার লৌকিক নয়, ভগবৎ সাধনার একটি দুঃসাধ্য উপায় মাত্র। ঈশ্বর লাভের উপায়স্বরূপ অভিসার প্রতীকরূপে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রাত্যহিক জীবনের নানা কর্মবন্ধনে জড়িত মানুষ ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে

সচেতন থাকে না। ভগবৎ সাধনার কথা ভাবতেও পারে না। এই সকল বন্ধনকে যতক্ষণ না ত্যাগ করা যায় তুচ্ছ করা যায় ততক্ষণ মন ঈশ্বরাভিমুখী হয় না। রাধার অভিসারের মধ্যে দিয়ে সাধনার সেই সুকঠিন স্তরটিকে অতিক্রম করার কথা বলা হয়েছে।

ঈশ্বর আমাদের অবিরত আকর্ষণ করেন। তাই সেই আকর্ষণে মানুষ ঈশ্বর অভিমুখে যাত্রা করে। তখন সে সমাজ ও সংসারের ভয় লজ্জা শাসন প্রভৃতি কিছুই গ্রাহ্য করে না। শীত, অন্ধকার, দুর্যোগ, অভিশ্রান্ত বর্ষণ, বিষধর সর্পভয় এই সকল বাধাবিঘ্ন জয় করে ভগবৎ সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশে গমন করতে সে এতটুকু দ্বিধা করে না। কারণ তখন তার সকল দেহবুদ্ধির বিলোপ ঘটে। এই সাধনায় জয়ী হলেই সে ভগবৎ সান্নিধ্য লাভ করবে। অলৌকিক অভিসার ভিন্ন মানুষ কখনও এত দুঃখকষ্ট সহ্য করে না। ঈশ্বরকে লাভ করতে হলে প্রবল দুঃখ জয় করতে হয়। দুঃখজয়ের সাধনায় সিদ্ধিলাভ হলেই ঈশ্বর পাওয়া যায়। অভিসার আমাদের এই শিক্ষা দেয়। আর বৈষ্ণবকবিগণ অভিসারের এই ব্যঞ্জনাটুকু নিয়ে সাহিত্য সাধনায় তৎপর হয়েছেন।

অভিসারের শ্রেষ্ঠ পদকর্তার কবি কৃতিত্ব :

গোবিন্দ দাস

গোবিন্দ দাস চৈতন্য উত্তর যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব কবি। গোবিন্দ দাস কে দ্বিতীয় বিদ্যাপতি আখ্যায় ভূষিত করা হয়। ব্রজবুলি এবং বাংলা উভয় ভাষাতেই পদ রচনা করে পাঠকদের মনে তিনি জায়গা করে নিয়েছেন। গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ, পূর্বরাগ, রূপঅনুরাগ, মাথুর প্রভৃতি বিষয়ে পদ রচনা করলেও অভিসার পর্যায়ের পদে, গোবিন্দ দাসের কৃতিত্ব সর্বাপেক্ষা বেশি। গোবিন্দ দাসের প্রাণের আত্মান্তিক প্রকাশ ঘটেছে অভিসারের পদে, তিনি অভিসারিকা রাধার অপূর্ব সুন্দর ভাবমূর্তি রচনা করেছেন। গোবিন্দদাস অভিসারিকা রাধার অপূর্ব ভাবমূর্তি নির্মাণ করেছেন। রাধা কৃষ্ণপদে নিবেদিতা। কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের জন্য তাঁর দেহ মন ব্যাকুল। তাই সমাজ সংসার প্রাণ—সবকিছু তুচ্ছ ক’রে তিনি অভিসার যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। ঝড় বৃষ্টির মধ্যে গভীর অন্ধকারে তাঁকে পথ চলতে হবে। পথে পায়ে কাঁটা ফুটতে পারে, সাপ কামড়াতে পারে, তাই তিনি সতর্কতা অবলম্বন করেছেন—

“কণ্টক গাড়ি কমলসম পদতল
মঞ্জীর চীরহি ঝাঁপি৷”

অন্ধকার রাত্রে পথ চলতে হবে। তাই রাধা করযুগে চক্ষু আবৃত করে পথ চলার অভ্যাস করছেন। সাপুড়ের কাছ থেকে সাপের মুখবন্ধন শিক্ষা করছেন—

“কর কঙ্কণ পণ ফণী মুখবন্ধন
শিখই ভুজগগুরু পাশে।”

অভিসার যাত্রার এই প্রস্তুতির জন্য গুরুজনরা নানা কথা বলেন। কিন্তু রাধার তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। কৃষ্ণকে তিনি হৃদয় উজাড় করে ভালবেসেছেন। কৃষ্ণ তার হৃদয় জুড়ে বিরাজ করছেন। তাই কোনও কথা তাকে স্পর্শ করতে পারে না— 

“গুরুজন বচন বধির সম মানই
আন শুনই কহ আন ।”

রাধার এই অভিসার যাত্রা কত যে বিপদসঙ্কুল, গোবিন্দদাস তা অপূর্ব বর্ণনার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। ঘন ঘন বজ্রপাত হচ্ছে, দশদিকে বিদ্যুতের ঝলক। তাতে জীবন পর্যন্ত বিপন্ন হতে পারে— 

“ইথে যদি সুন্দরী তেজবি গেহ।
প্ৰেমক লাগি উল্লেখবি দেহ।।”

কিন্তু ভগবান যেখানে ভগবানের সঙ্গে মিলিত অর্থাৎ আত্মলীন হতে চান সেখানে। কোনও বাধাই তো দুস্তর নয়। প্রাণভয় তো সেখানে অতি তুচ্ছ ব্যাপার। তাই রাধার কাছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কোনও বাধাই নয়— 

“কুল মরিয়াদ কপাট উদ্ঘাটহুঁ
তাহে কি কাঠকি বাধা ।”

এই পদটির মধ্যে দুঃসাহসিকতা ও কঠিন প্রতিজ্ঞার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। রাধা বলেছেন, যেখানে তিনি সতীত্বের বাধা অতিক্রম করতে পেরেছেন, সেখানে সামান্য কাঠের দরজার বাধা তাকে আটকে রাখতে পারবে না, কোনো পরীক্ষাই রাধাকে এখন বেঁধে রাখতে পারবে না। অভিসারে তাঁকে যেতেই হবে।

গোবিন্দদাসের অভিসার পর্বের পদ খুব সহজেই পাঠকের মন জয় করে নিতে পেরেছে। যেসব কারণে তিনি পাঠকের মনে ‘রাজাধিরাজের স্থান দখল করেছেন সেগুলি হল —

(ক) অভিসারের পরিবেশ বর্ণনায় তাঁর মতো সক্ষম কবি খুব কমই আছেন।

(খ) জ্যোৎস্নাভিসার, তিমিরাভিসার, বর্ষাভিসার, কুয়াশাভিসার, শীতাভিসার, নির্বাভিসার ইত্যাদি সমস্ত রকমের অভিসার বর্ণনায় তিনি সিদ্ধহস্ত।

(গ) অভিসারিকার প্রণয়বৃত্তির উদগ্র বাসনাকে তিনি স্পষ্ট ও স্বচ্ছভাবে রূপায়িত করতে সক্ষম হয়েছেন।

(ঘ) অভিসারের মধ্যে বৈচিত্র্য আনয়নে ও নাটকীয়তা প্রয়োগে তিনি ছিলেন পারদর্শী শিল্পী।

(ঙ) তাঁর অভিসার পদ বাঙালীর আবেগময়তার সঙ্গে যোগসাধন করে চিত্ররূপময় ও সঙ্গীতময়হয়েছে।

(চ) ঝড়, বৃষ্টি, মেঘ, বিদ্যুৎ ইত্যাদি চিত্রকল্পের মধ্যে প্রেমসর্বস্থা নারীর হৃদয়ের স্পন্দনকে ভাষা দিতে সক্ষম হয়েছেন।

(ছ) নায়িকার মনস্তাত্বিক আবেগকে নিখুঁতভাবে বর্ণনা করতে সক্ষম হয়েছেন।

এইভাবে রাধার অভিসার গোবিন্দদাসের পদে অপূর্ব ভাবব্যঞ্জনা লাভ করেছে। গোবিন্দদাস চৈতন্য-পরবর্তী যুগের বৈষ্ণব সাধনার মূল ধারাটিকে আত্মসাৎ করে রাধার অভিসার বর্ণনা করেছেন। সেখানে একদিকে যেমন কাব্য- চমৎকারিত্ব ও সার্বজনীনতা প্রকাশিত, অন্যদিকে তেমনি গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের তত্ত্বটিও রক্ষিত হয়েছে।

আরো পড়ুন

শব্দালঙ্কার কাকে বলে | দৃষ্টান্তসহ শব্দালঙ্কারের শ্রেণীবিভাগগুলির পরিচয় দাও

স্বরবৃত্ত ছন্দ কাকে বলে | উদাহরণ সহ স্বরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা করাে

Leave a Comment

error: Content is protected !!