সমাজ ও শিক্ষা সংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান আলোচনা করো

সমাজ ও শিক্ষা সংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান আলোচনা করো

উত্তর:

সমাজ ও শিক্ষা সংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান

আধুনিক ভারতে যেসব সংস্কারক জন্মগ্রহণ করেছেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগণ্য ছিলেন রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩ খ্রি.)। রামমোহন ভারতীয় সমাজের অন্ধকার ও কুসংস্কার দূর করে জাতিকে আলোর পথ দেখান। তাঁকে ‘ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ’, ‘আধুনিক ভারতের জনক’, ‘আধুনিক ভারতের ইরাসমাস’ প্রভৃতি অভিধায় ভূষিত করা হয়। তিনি ছিলেন ‘ভারতীয় নবজাগরণের অগ্রদূত’। মোগল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর তাঁকে ‘রাজা’ উপাধি দেন।

সমাজসংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান :

(a) জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা : রামমোহন হিন্দু সমাজে জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা প্রথার তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি ‘বজ্রসূচি’ গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ করে প্রচার করেন যে, জাতিভেদ প্রথা শাস্ত্রসম্মত নয়। তিনি অসবর্ণ বিবাহের সমর্থনে বিভিন্ন পুস্তিকা রচনা করেন।

(b) সতীদাহপ্রথা নিবারণ : তৎকালীন হিন্দু সমাজে উচ্চবর্ণের মধ্যে মৃত স্বামীর চিতায় তার জীবিত স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারা হত। এই অমানবিক কুপ্রথা ‘সতীদাহ প্রথা’ নামে পরিচিত। এই কুপ্রথার বিরোধিতা করে রামমোহন জনমত গড়ার উদ্দেশ্যে প্রচারকার্য চালান। তিনি বড়োলাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের কাছে ৩০০জন বিশিষ্ট নাগরিকের স্বাক্ষর সংবলিত একটি আবেদনপত্র জমা দিয়ে এই প্রথা বন্ধের দাবি জানান। তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়ে বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে (৪ ডিসেম্বর) ১৭নং রেগুলেশন (Regulation – XVII) জারি করে সতীদাহপ্রথাকে বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করেন।

(c) নারীকল্যাণ : রামমোহন নারীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন উদ্যোগ নেন। i) তিনি বিভিন্ন শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন যে, পিতা বা স্বামীর সম্পত্তিতে নারীর অধিকার আছে। ii) তিনি স্ত্রীশিক্ষার প্রসারে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। iii) কৌলীন্যপ্রথার অভিশাপ থেকে নারীসমাজকে রক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি প্রয়াস চালান। iv) নারীর বিবাহ বিষয়ক সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে তিনি প্রয়াস চালান।

(d) অন্যান্য সামাজিক সংস্কার : রামমোহন বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, কন্যাপণ, কৌলীন্যপ্রথা, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন প্রভৃতি কুপ্রথাগুলির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। রামমোহন নারীপুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা, বিধবাবিবাহের প্রচলন প্রভৃতি বিষয়ে যথেষ্ট তৎপর হন।

উপসংহার : রামমোহন রায়ের চরিত্রে কিছু সীমাবদ্ধতাও লক্ষ করা যায়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে, তিনি জাতিভেদপ্রথা বা বহুবিবাহের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে রুখে দাঁড়াননি। ব্রিটিশ সংস্কৃতির প্রতি অত্যন্ত অনুরাগের বশে তিনি দেশীয় শিক্ষার প্রতি অবহেলা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এসব সমালোচনা সত্ত্বেও আধুনিক ভারত গঠনে তাঁর অবদান অসীম।

শিক্ষাসংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান :

(a) শিক্ষাবিষয়ক চিন্তাধারা : রামমোহনের শিক্ষা বিষয়ক চিন্তায় ভারতের অতীত ঐতিহ্য ও গৌরবের সঙ্গে আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানের মিলন ঘটানোর প্রয়াস ছিল। তাই তিনি সারাজীবন ধরেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকে কাছাকাছি নিয়ে আসার চেষ্টা করে গেছেন। রামমোহনের শিক্ষাবিস্তারের মূল লক্ষ্য ছিল দেশবাসীকে বাস্তব জগতের উপযুক্তরূপে গড়ে তোলা ও তাদেরকে সমাজকল্যাণে নিয়োগ করে দেশ ও জাতিকে প্রগতি ও উন্নতির পথে চালিত করা।

(b) পাশ্চাত্য শিক্ষার সমর্থক : রামমোহন তৎকালীন গভর্নর জেনারেল আমহার্স্টকে এক পত্র মারফত (১৮২৩ খ্রি.) ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার জন্য সরকারি অর্থ ব্যয়ের অনুরোধ জানান এর পাশাপাশি তিনি চেয়েছিলেন শিক্ষার্থীদের গণিত, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা ও প্রাকৃতিকবিদ্যা পড়ানো হোক। তিনি ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্ডার ডাফকে জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন। তিনি ক্যালকাটা বুক সোসাইটির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন।

(c) স্কুল কলেজের প্রতিষ্ঠা : দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে তিনি স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও যত্নবান হন। তিনি নিজের প্রচেষ্টায় অ্যাংলো হিন্দু স্কুল (১৮১৭ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন। বেদান্ত শিক্ষার লক্ষ্যে কলকাতায় গড়ে তোলেন বেদান্ত কলেজ (১৮২৬ খ্রি.)।

(d) বাংলা গদ্যসাহিত্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা : রামমোহন রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি ছিল— 1. বেদান্ত গ্রন্থ (১৮১৫ খ্রি.) 2. বেদান্ত সার (১৮১৫ খ্রি.) 3. ভট্টাচার্য্যের সহিত বিচার (১৮১৭ খ্রি.) 4. মাণ্ডুক্যোপনিষৎ (১৮১৭ খ্রি.) 5. মুণ্ডকোপনিষৎ (১৮১৯ খ্রি.) 6. সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক ও নিবর্ত্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ (১৮১৯ খ্রি.) 7. সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রীর সহিত বিচার (১৮২০ খ্রি.) 8. ব্রাক্ষ্মণ সেবধিঃ (১৮২১ খ্রি.) প্রভৃতি।

(e) বিবিধ সংবাদপত্র প্রকাশনা : রামমোহন সাংবাদিকতা সংবাদপত্রের পরিবেশনের ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের দিশারি ছিলেন। তিনি বাংলা, হিন্দি, ইংরাজি ও ফরাসি ভাষায় বিভিন্ন সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। বাংলা ভাষায় ‘সম্বাদ কৌমুদী’ (১৮২১ খ্রি.) এবং ফারসিতে প্রকাশিত ‘মিরাৎ-উল-আখবর’ (১৮২২ খ্রি.) ইত্যাদি ছিল তাঁর প্রকাশিত সংবাদপত্রের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন৷

আরো পড়ুন

মিথ ও লিজেন্ড বলতে কী বোঝ | অতীত বিষয়ে মানুষের ধারণাকে এরা কিভাবে রূপদান করে

পেশাদারী ইতিহাস বলতে কী বোঝো | পেশাদারী ইতিহাসের সঙ্গে অপেশাদারী ইতিহাসের পার্থক্য উল্লেখ করো

Leave a Comment

error: Content is protected !!