বাংলা ছোট গল্পে রবীন্দ্রনাথের অবদান
অথবা, বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথের অবদান
অথবা, ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথের অবদান
উত্তর:
বাংলা ছোট গল্পে রবীন্দ্রনাথের অবদান
রবীন্দ্রনাথ বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ গল্প কার তার হাতেই বাংলা ছোট গল্প পূর্ণতা লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথের সংজ্ঞায় ছোটগল্পের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে যেখানে তিনি বলেছেন- ছোট গল্পে বর্ণনা আধিক্য বা ঘটনার অতিশয্য থাকবে না। ছোটগল্প তত্ত্বকথায় ভারাক্রান্ত হবে না; এবং ছোটগল্পের পরিণতিতে একটা ব্যঞ্জনা থাকবে বা সুদূরপ্রসারী ভাবপরিমণ্ডল রচিত হবে। ধূপ পুড়ে গেলেও তার সুগন্ধ যেমন থাকে, সেতার থামলেও তার সুর যেমন মনে অনুরণন তোলে, তেমনি পাঠসমাপনের পরেও একটা গভীর নিবিড় আবেদন রেখে যায় ছোটগল্প।
পূর্ববাংলায় ভ্রমণকালে পদ্মার তীরে তীরে প্রকৃতির পটভূমিকা পল্লীজীবনের বৈচিত্র্যময় রূপ এবং সেখানে অবস্থিত সাধারণ মানুষের সুখদুঃখ হাসিকান্না আনন্দবেদনা ধরা পড়েছে তাঁর ছোটগল্পে। একদিকে প্রকৃতির সহজ প্রসন্ন প্রকাশ অন্যদিকে জীবনের আন্তরিক উপলব্ধি তাঁর গল্পকে স্বাদু করে তুলেছে। রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য মধ্যবিত্ত জীবনকেন্দ্রিক গল্পগুলিতে ঘাতপ্রতিঘাতময় সমাজচেতনা রূপ প্রকাশ পেয়েছে।
বিষয়ের বিচারে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পকে এই কটি পর্বে বিন্যস্ত করা যায়—
১. পারিবারিক গল্প : ‘শাস্তি’, ‘স্বর্ণযুগ’, ‘ঠাকুরদা’, ‘দান- প্রতিদান’, ‘দিদি’, ‘রাসমণির ছেলে’ ইত্যাদি পারিবারিক গল্প। পরিবার জীবনের আলোছায়ার মায়ায়, হৃদয়সম্পর্কের গভীরতায়, প্রেম-অপ্রেম অনুরাগ-বিরাগের টানাপোড়েনে এই গল্পগুলি নির্মিত হয়েছে। ‘শাস্তি’ গল্পের এক প্রবল উত্তেজনার মুহূর্তে বড় ভাই দুখিরামের হাতে তার স্ত্রীর মৃত্যু হলে ছোটভাই ছিদাম তার স্ত্রী চন্দরাকে সেই হত্যার দায়িত্ব নিতে বলে। চন্দরা স্বামীর কথায় স্তম্ভিত নির্বাক হয়ে যায়। স্বামীর প্রতি তীব্র অভিমানে সংসারের প্রতি তিক্ত বিদ্বেষে চন্দরা আদালতেও মৃত্যুর দায় স্বীকার করে।
স্বামী ও ভাসুর তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করলেও চন্দরা অচল অনড়। তার ফাঁসীর হুকুম হয়। ‘ঠাকুরদা’ গল্পে মিথ্যা ব্যর্থ অতীত-গৌরবেগভী এক বৃদ্ধর প্রতি এক তরুণ যুবকের ব্যঙ্গ বিদ্বেষ শেষ পর্যন্ত সমবেদনা ও মর্যাদাবোধে পরিণতি লাভ করে।
২. সামাজিক গল্প : ‘দেনাপাওনা’, ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’, ‘বিচারক’, ‘দুর্বুদ্ধি’ ‘নষ্টনীড়’, ‘হৈমন্তী’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘ভাইফোঁটা’, ‘পয়লা নম্বর’, ‘নামঞ্জুর গল্প’ ইত্যাদি সামাজিক গল্প। এই সব গল্পে রবীন্দ্রনাথ সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সংকট ও জটিলতাকে তুলে ধরেছেন। যেমন পণপ্রথার কদর্যতার বিরুদ্ধে কবির বেদনা ও ক্ষোভ তীব্রভাবে প্রকাশ পেয়েছে ‘দেনাপাওনা’ গল্পে। নারীর প্রতি অপমান ও অত্যাচারের প্রতিবাদ ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্প। নিষ্ঠুর অত্যাচারী পুলিশ প্রশাসন ও তাদের সহযোগী ডাক্তারের অমানবিকতায় অতি সাধারণ মানুষের অসহায় শোচনীয় অবস্থার চিত্র ‘দুর্বুদ্ধি’। জাতপাত এবং শ্রেণী ও বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে কবি উচ্চকণ্ঠ হয়েছেন ‘নামঞ্জুর গল্প’, ‘সংস্কার’ প্রভৃতি কাহিনীতে। ইংরেজ তোষণকারী জাতিকে তিক্ত আক্রমণ করেছেন ‘রাজটিকা’য়।
৩. প্রকৃতিবিষয়ক গল্প : প্রকৃতি ও মানুষের অন্তরঙ্গ সম্বন্ধর বিষয় কথিত হয়েছে ‘সুভা’ ‘আপদ’ ‘অতিথি’ ইত্যাদি গল্পে। প্রসঙ্গ ‘অতিথি’ গল্পটি স্মরণ করা যায়। তরুণ তারাপদ বাবা-মা-ভাই-বোনের মধ্যে থাকলে ও কোনো পারিবারিক সম্পর্ক তাকে আকৃষ্ট ও আবদ্ধ করে না। ঘরের বন্ধন তার সয় না, জন্মনক্ষত্র তাকে গৃহহীন করেছে, পারিবারিক স্নেহ-মমতাকে ছেড়ে অজ্ঞাত বহিঃপৃথিবীর স্নেহহীন স্বাধীনতার জন্য তার চিত্ত ব্যাকুল। তাই সে বারবার গৃহত্যাগ করে চলে যায়।
৪. প্রেমবিষয়ক গল্প : ‘সমাপ্তি’, ‘দালিয়া’, ‘মধ্যবর্তিনী’, ‘দৃষ্টিদান’, ‘নষ্টনীড়’ প্রভৃতি গল্প প্রেম-ভাবনায় নিবিড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এই সমস্ত গল্প গুলিতে প্রেমের বিভিন্ন মহিমা প্রকাশিত হয়েছে। যেমন- প্রেমের রহস্যময়তা, অন্তরলোকের তীব্র দহন, মনস্তাত্বিক জটিলতা ধরা পড়েছে ‘নষ্টনীড়’ গল্পে। স্বামীর প্রতি ভালোবাসায় স্থির অবিচল এক নারীর প্রবল ইচ্ছাশক্তির জয় ঘোষিত হয়েছে ‘দৃষ্টিদান’ গল্পে। রোমান্টিক প্রেমের সার্থক নিদর্শন স্বরূপ রবীন্দ্রনাথের ‘সমাপ্তি’ গল্পের উল্লেখ করা যায়। সহজ সরল হরিণশিশুর মতো চঞ্চল মৃন্ময়ীকে দেখে শহর থেকে আসা যুবক অপূর্ব মুগ্ধ হয়। ও মার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে বিয়ে করে।
মৃন্ময়ী বোঝে না প্রেম ও বিবাহ কি, সে অপূর্বর কাছে অধরা থাকে। অপূর্বর মা-ও মৃন্ময়ীকে গ্রহণ করতে পারে না। স্ত্রীর অনিচ্ছায় ও মার অভিমান-প্রসূত অনাদরে আহত বেদনার্ত অপূর্ব শহরে চলে যায়। তখন মৃন্ময়ীর মধ্যে দেখা দিল পরিবর্তন বালিকা থেকে হয়ে উঠল নারী। শেষ পর্যন্ত চঞ্চলা বালিকা প্রেমময়ীনারীরূপে স্বামীর কাছে ধরা দিল।
৫. অতিপ্রাকৃত বিষয়ক বা অলৌকিক গল্প : ‘নিশীথে’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘মণিহারা’ এই জাতীয় গল্পের নিদর্শন। অলৌকিক গল্পের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ কোনো স্থূল ভৌতিক উপাদান আনেননি, বরং অতিপ্রাকৃতাকে মনস্তাত্বিক ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য করে তুলতে প্রয়াসী হয়েছেন। ‘নিশীথে’ গল্পে নববিবাহিত দক্ষিণাবাবুর মনে প্রয়াতা প্রথমা স্ত্রীর ভাবনা এক ভয়ত্রস্ত অলৌকিক অনুভূতির সঞ্চার করে। অন্ধকার রাত্রে বকুলতলায় বনচ্ছায়াতলে পাথরের বেদীর ওপর শাসিত নববধূকে আদর-সম্ভাষণ করতে গেলে প্রয়াতা স্ত্রীর একটা দীর্ঘশ্বাস অথবা একটা মর্মভেদী হাসি কিংবা অভ্রভেদী হাহাকার যেন হাহা করে দ্রুতবেগে ছুটে যায় যা প্রকৃতপক্ষে ছিল পাখির পাথার শব্দ। নদীতীরে রাত্রিবেলায় নির্জন নিঃসঙ্গ নিষুপ্ত পরিবেশে স্ত্রীকে প্রণয়উদ্যত হলে সেই
জনমানবশূন্য নিস্তরঙ্গ স্থানে কে যেন অমানুষিক কণ্ঠে বলে ওঠে ও কে ও কে ও কে গো!” যা প্রকৃতপক্ষে এক জলবিহারী পাখির ডাক কিন্তু তা হৃদয়কে প্রকম্পিত করে তোলে। ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পে এক ব্যক্তি প্রাচীন জীর্ণ প্রাসাদের মধ্যে আসে ও সেখানকার স্বপ্নিল রহস্যময় অলৌকিক পরিবেশের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে যেন এক পাষাণ রাক্ষস তাকে গ্রাস করে নেয়। ঐ প্রাসাদে যারা তিনরাত্রি বাস করে তারা মারা যায়। কেবল মেহের আলি পাগল হয়ে প্রসাদের চারদিকে প্রদক্ষিণ করতে করতে সবাইকে চিৎকার করে বলে “তফাত যাও, তফাত যাও। সব ঝুটি হ্যায়, সব ঝুট হ্যায়।”
৬. তিনসঙ্গী : রবীন্দ্রনাথের পরিণত বয়সের লেখা তিনটি গল্পের সংকলন ‘তিনসঙ্গী’ (১৯৪১) রবীন্দ্রনাথের অন্য সব গল্প থেকে এক দুর্বার ব্যতিক্রম। এর মধ্যে ‘ল্যাবরেটরি’ (আশ্বিন ১৩৪৭) গল্পটি কঠিন দীপ্তিতে সমুজ্জ্বল। এর নায়িকা সোহিনী পঞ্জাবের মেয়ে যার আগে বিয়ে হলেও সে আসে বলিষ্ঠ বীর্যবান বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ নন্দকিশোরের কাছে এবং নতুন করে গড়ে তোলে তার জীবন। স্বামীর মৃত্যুর পর দৃঢ় কঠিন সোহিনী তার স্বামীর প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন জনের লোলুপ প্রয়াস থেকে বাঁচিয়ে রাখে। তার মেয়ে নীলা গৌরবর্ণ সুন্দরী যার বিয়ের জন্য সোহিনী একটা যোগ্য পাত্র খুঁজছিল যে ছেলে তার ল্যাবরেটরির দায়িত্ব নেবে। সে পেল রেবতীকে যে বিজ্ঞানের অত্যন্ত কৃতী ছাত্র। একদিন নীলা বাড়ীতে পার্টি দেয় সোহিনীর অনুপস্থিতিতে এবং সে ও তার বন্ধুরা সেখানে আসা রেবতীকে প্রায় কবজা করে ফেলে যাকে তারা। তাদের প্রতিষ্ঠানের সভাপতি করবে এবং নীলার সাহায্যে সব সম্পত্তি হাতিয়ে নেবে। মত্ত উচ্ছৃঙ্খল পার্টির মধ্যে সোহিনী আসে এবং ভয়ংকর কথা ঘোষণা করে যে নীলা নন্দকিশোরের মেয়ে নয়। বিমূঢ় স্তম্ভিত হয়ে নীলার মধুলোভী প্রিয়জনরা চলে যায় এবং রেবতীও তার প্রবল প্রতাপশালী পিসীমার ডাকে ‘সুড়সুড় করে’ চলে যায়। ভাবনায় প্রখর, চরিত্রচিত্রণে অসামান্য বিশেষত সোহিনীর চরিত্র যা বাংলা সাহিত্যে অনন্য। এবং ‘তিনসঙ্গী’র অন্য
দুটি গল্প ‘রবিবার’ ও ‘শেষ কথা’ সুখপাঠ্য হলেও অপর গল্প অর্থাৎ ‘ল্যাবরেটরি’র মতো উচ্চপর্যায়ের নয়। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলি পাঠ করে শেষ পর্যন্ত মনে হয়— “অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে “অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে শেষ হয়ে হইল না শেষ।”
পঞ্চাশ বছরে (১৮৯১–১৯৪০) পঁচাশিটি গল্প রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন। বাংলা ছোটগল্পের পত্তন, লালন ও পালনের কাজ করে গেছেন তিনি। আমাদের জগৎ ও জীবনের নানা সমস্যা অনুভূতি ও উপলব্ধি নিয়ে গল্প লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। গল্পের শিল্পরীতি এবং বিন্যাসও উচ্চমানের। চরিত্রের বিবর্তন, নাটকীয় সমাপ্তি, অতিপ্রাকৃত উপাদানকে মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের কাজে লাগানো, প্রকৃতির উন্মুক্ত পটভূমিকায় মানব মনের বিশ্লেষণে রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছোটগল্পকার।
রবীন্দ্র নাথের ছোট গল্প সম্পর্কে কিছু তথ্য :
১. হিতবাদী ও সাধনা পত্রিকার যুগ (১৮৯১-১৯০১) : পোস্টমাস্টার, দেনা পাওনা, খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, কাবুলিওয়ালা, ছুটি, ক্ষুধিত পাষাণ, অতিথি, কঙ্কাল, রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা, প্রভৃতি ছোটগল্প রচিত হয়েছে।
২. ভারতী ও সবুজ পত্রিকার যুগ (১৯১৪-৩০) : হালদার গোষ্ঠী, হৈমন্তী, স্ত্রীপত্র, পয়লা নভেম্বর ইত্যাদি।
৩. তিনসঙ্গী গল্প : রবিবার, শেষ কথা, ল্যাবরেটরী।
৪. স্ত্রীর পত্র : এই গল্পটি পত্র কাঠামো আঙ্গিকে রচিত।
৫. নষ্টনীড় : গল্পটি রবীন্দ্রনাথের নোভেলেট জাতীয় গল্প।
৬. রবীন্দ্রনাথের দুটি রাজনৈতিক বিষয়ক গল্প : মেঘ ও রৌদ্র, রাজটিকা, দুর্বুদ্ধি।
৭. গুপ্তধন : সমালোচকদের মতে এই গল্পটি Edgar Alan poe র “দ্য গোল্ড রাশ” এর প্রভাব আছে।
৮. দুরাশা : ১৮৯৮ সালে ভারতী পত্রিকায়।
৯. রবীন্দ্রনাথের প্রথম গল্প : ঘাটের কথা।
১০. রবীন্দ্রনাথের প্রথম গল্প সংগ্রহ : গল্পগুচ্ছ (১৯০৭)।
আরো পড়ুন
বাংলা নাট্য সাহিত্যে নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান
বাংলা উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান
বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে শ্রীরামপুর মিশনের অবদান আলোচনা করো
বাংলা নাট্য সাহিত্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদান আলোচনা করো
বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবদান
বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করো
বাংলা নাট্য সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো