প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও পাঠক্রম সম্পর্কে কোঠারি কমিশনের সুপারিশ

প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও পাঠক্রম সম্পর্কে কোঠারি কমিশনের সুপারিশ

উত্তর:

প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও পাঠক্রম

প্রথম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত থাকবে। 

শিক্ষার লক্ষ্য : 

প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য গুলি হল – 

• শিশুর মধ্যে স্বাস্থ্যসম্মত অভ্যাস গড়ে তােলা। 

সামাজিক সচেতনতা বােধ গড়ে তােলা।

• শিক্ষার্থীর প্রাক্ষোভিক, নান্দনিক বৌধিক বিকাশ ও সৃজনশীলতা বিকাশে সাহায্য করা। 

• পরিবেশ সম্পর্কিত বিষয়ে আগ্রহী করে তােলা। 

• ন্যায় অন্যায়, ভালাে-মন্দ বােধ, সঠিক বিচার করার জন্য নীতিবােধ গড়ে তােলা।

• শিশুদের মধ্যে সঠিক চিন্তার বিকাশ ঘটানাে এবং শিশুকে স্পষ্ট ভাবে লিখতে ও উচ্চারণ করতে সক্ষম করে তােলা। 

• জাতীয় সংহতি, জাতীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণ ইত্যাদি চারিত্রিক বিকাশে সাহায্য করা।

প্রাথমিক শিক্ষার কাঠামাে :

কমিশন প্রাথমিক শিক্ষার স্তর কে দুটি পর্যায়ে ভাগ করার কথা বলেছেন – a) নিম্ন প্রাথমিক ও b) উচ্চ প্রাথমিক।

প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও পাঠক্রম

a) নিম্ন প্ৰাথমিক : নিম্ন প্রাথমিক স্তরে শিশু শিক্ষা শুরু হবে ছয় বছর বয়স থেকে। প্রথম শ্রেণী থেকে চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত চার বা পাঁচ বছরের নিম্ন প্রাথমিক শিক্ষা।

b) উচ্চ প্রাথমিক : পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সময় কাল হবে 3/4 বছরের।

পাঠক্রম : 

নিম্ন প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রম :

• নিম্ন প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ভাষা হবে একটি মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা 

• গণিত শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। 

• বিজ্ঞান এবং সমাজবিজ্ঞান মূলক বিষয়ের প্রাথমিক ধারণা দিতে হবে।

• ক্লাস ফোরের শিক্ষার্থীদের Roman Alphabet এর শিক্ষা দিতে হবে, এছাড়াও থাকবে ম্যাপ, চাট, রাশিবিজ্ঞানে তালিকা শেখানাে ইত্যাদি।

• শিশুদের সৃষ্টিশীলতা প্রকাশের জন্য সঙ্গীত, কলা ও নাটক ইত্যাদি।

• কর্মশিক্ষার মধ্যে থাকবে, কাগজ কাটা 

• কার্ডবাের্ড কাটা, মাটির জিনিস তৈরি বাগান তৈরি ইত্যাদি।

• সমাজসেবামূলক কাজের মধ্যে থাকবে ক্লাস রুম পরিস্কার করা, স্কুল সাজানাে প্রভৃতি। 

• শিশুদের ভালাে স্বাস্থ্য অভ্যাস গড়ে তােলার জন্য শিক্ষা দেওয়া হবে।

উচ্চ প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রম :

• এই স্তরের দুটি ভাষা থাকবে – মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা, হিন্দি অথবা ইংরেজি।

• গণিতের মধ্যে থাকবে পাটিগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতি গণিতের বিভিন্ন সূত্র ,যুক্তিমূলক চিন্তন, সমীকরণ ও গ্রাফ সম্বন্ধে ধারণা ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

• বিজ্ঞানের মধ্যে থাকবে পদার্থবিদ্যা, ভূবিদ্যা, জীবন বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান।

• সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে থাকবে ইতিহাস, ভূগােল ও পৌর বিজ্ঞান।

• কর্ম শিক্ষার মধ্যে থাকবে ছবি আঁকা, বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজ, কৃষি খামার তৈরি, ওয়ার্কশপ, বাঁশের কাজ, চামড়ার কাজ, মাটির কাজ, সেলাই, বাগান তৈরী, মডেল তৈরি ইত্যাদি।

• শিক্ষার্থীদের দৈহিক বিকাশের জন্য থাকবে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা ও শরীরচর্চার ব্যবস্থা। এই স্তরে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ অনুযায়ী খেলাধুলার ব্যবস্থা করতে হবে, মেয়েদের জন্য থাকবে কম পরিশ্রম যুক্ত খেলা।

প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : 

প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে – 

১) সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : এই ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমস্ত দায়িত্ব সরকার বহন করে থাকে। শিক্ষকদের বেতন ও আনুষঙ্গিক খরচ সরকার বহন, নিয়ম-কানুন, পাঠক্রম, পাঠ্যপুস্তক সরকার দ্বারা নির্দিষ্ট, এখানে শিক্ষার্থীদের বিনা পয়সায় পড়ানাে হয়। গ্রামাঞ্চলে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলি বেশি জনপ্রিয়। 

২) বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : এ ধরনের বিদ্যালয় পরিচালনা এবং তার ব্যায়ভার বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বহন করে থাকে। এখানে শিক্ষার্থীদের বেতন দিয়ে পড়াশােনা করতে হয়। এখানে সরকারের কোন হস্তক্ষেপ থাকেনা, শহর ও মফস্বলে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলি বেশি জনপ্রিয়।

৩) এক শিক্ষক পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : একজন শিক্ষক দ্বারা বিশেষ পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করে থাকেন, গ্রামাঞ্চলে এই ধরনের বিদ্যালয় দেখা যায়। 

৪) বুনিয়াদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : গান্ধীজীর বুনিয়াদি ভাবধারায় প্রাথমিক শিক্ষার কথা উল্লেখ করেছিলেন, এখানে বুনিয়াদি পাঠক্রম কে অনুসরণ করা হয়, বর্তমানে এই ধরনের বিদ্যালয়ের সংখ্যা খুবই কম।

 ৫) প্রথামুক্ত প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : যে সমস্ত শিক্ষার্থী প্রথাগত বিদ্যালয়ে আসতে পারে না, বিভিন্ন কাজের সাথে যুক্ত, তাদের সুবিধামতাে পড়াশােনার জন্য এই ধরনের ব্যবস্থা করতে হবে, যেমন – বিভিন্ন ধরনের সাক্ষরতা কেন্দ্র ও নৈশ বিদ্যালয়।

প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে কমিশনের সুপারিশ: 

• সংবিধানের নির্দেশ মত 14 বছর বয়স পর্যন্ত প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীর বাধ্যতামূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। 

• প্রাথমিক শিক্ষার অনুন্নয়ন ও অপচয় এমনভাবে কমাতে হবে, যারা বিদ্যালয়ে ভর্তি হবে তাদের মধ্যে ৪০ জন শিশু যাতে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। 

• যেসব শিশু 14 বছর পূরণ হয়নি, যারা বৃত্তি শিক্ষা গ্রহণ করতে চায় তাদের জন্য বৃত্তি শিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

• যে সকল শিক্ষার্থীদের বয়স 11 থেকে 14 বছরের মধ্যে কিন্তু তারা কোনাে কারণে বিদ্যালয়ে আসতে পারে না। বিভিন্ন কারণে তারা প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করতে পারে না। তাদের জন্য সাক্ষরতা শিবিরের ব্যবস্থা করতে হবে।

• নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা এমনভাবে করতে হবে, যেখানে নিম্ন প্রাথমিক শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের এক মাইলের বেশি দূরত্বে যেতে হবেনা এবং উচ্চ প্রাথমিক এর ক্ষেত্রে এক থেকে তিন মাইলের মধ্যে বিদ্যালয় থাকবে। 

• যেসব শিক্ষার্থী নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করার পর, তারা পড়াশােনা করতে চায়, কিন্তু আর্থিক কারণে বা অন্য কোন কারণে প্রথাগত শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে না, তাদের জন্য আংশিক সময়ের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

• নারী শিক্ষা বিষয়ে কমিশন বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছেন, নারী শিক্ষার জন্য সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার মান উন্নয়নের উপর বিশেষ নজর রাখতে হবে।

• উচ্চ প্রাথমিক স্তরে মৌখিক ও লিখিত পরীক্ষা গ্রহণের সুপারিশ করেছেন, প্রতিটি ছাত্রের জন্য সর্বাত্মক পরিচয় পত্র (Cumulative Record Card) রাখার প্রস্তাব করেছেন।

• প্রাথমিক স্তরে সমাজসেবামূলক কর্মসূচি গ্রহণ এবং কর্ম অভিজ্ঞতার উপর গুরুত্ব দিতে হবে।

যদি কোন শ্রেণীতে 10 জন এবং বিদ্যালয়ে মােট 40 জন ভিন্ন ভাষার ছাত্র-ছাত্রী থাকে তাহলে তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে।

আরো পড়ুন

শিক্ষার লক্ষ্য | Aims of Education in Bengali

অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষা বা অপ্রথাগত শিক্ষা | Informal Education In Bengali

প্রাচীন অনুবর্তন কাকে বলে | প্যাভলভের প্রাচীন অনুবর্তন তত্ত্ব | Classical Conditioning

মুদালিয়ার কমিশনের সুপারিশ | Mudaliar Commission (1952-53) in Bengali

বৃদ্ধি ও বিকাশের মধ্যে পার্থক্য | জীবন বিকাশের বিভিন্ন স্তর | Difference between Growth and Development

রাধাকৃষ্ণন কমিশন বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন | Radhakrishnan commission (1948-49) in Bengali

Leave a Comment

error: Content is protected !!