শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা কী ও তার বৈশিষ্ট্য | Characteristics of Child-Centric Education in Bengali
উত্তর:
শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা (Child-Centric Education)
আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান ও প্রথম উপাদান হল শিশু বা শিক্ষার্থী। যে শিক্ষা ব্যবস্থার সমগ্র আয়োজনই শিশুর জীবন বিকাশের জন্য পরিকল্পিত ও পরিচালিত হয় সেই শিক্ষা ব্যবস্থাকে শিশু কেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা বলা হয়। শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার প্রধান উপাদান হল শিশু। শিশুর সামগ্রিক বিকাশ ঘটানাে হল শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু প্রাচীনকালে শিক্ষাক্ষেত্রে শিশুকে প্রাধান্য দেওয়া হতাে না। শিশু কখন শিখবে, কি ভাবে শিখবে, কেন শিখবে, কি শিখবে ইত্যাদি বিষয় গুলি স্থির করতেন শিক্ষক ও অভিভাবকরা। শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ,চাহিদা, ও সামর্থের উপর গুরুত্ব দেওয়া হতাে না। তাদের কতগুলি তাত্বিক বিষয় শেখানাে হতাে। প্রাচীন দার্শনিকরা এই গতানুগতিক ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার তীব্র প্রতিবাদ করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রকৃতিবাদী দার্শনিক রুশাে তার এমিল (Emile) গ্রন্থে বলেন, “Everything is good as it comes from the hands of the Author of Nature, but everything degenerates in the hands of man” প্রকৃতির হাত থেকে যা আসে তাই ভাল, মানুষের হাতের ছোঁয়ায় সব কিছু খারাপ হয়ে যায়।
তার মতে শিক্ষার লক্ষ্য হবে, শিশুকে সক্রিয় করে তােলা এবং তার দৈহিক ও মানসিক ক্ষমতা গুলি যথােপযুক্ত ভাবে ব্যবহার করতে সাহায্য করা। গতানুগতিক শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন করে তিনি নেতিবাচক শিক্ষার কথা বলেন। তার মতে শিশুদের মৌখিক তাত্বিক শিক্ষাদানের পরিবর্তে তারা যাতে নিজেরা আবিষ্কার করে অথবা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে শিখতে পারে তার সুযােগ দিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার যে সমস্ত বৈশিষ্ট্য আমরা দেখতে পাই তার প্রথম সূত্রপাত রুশাের আদর্শের মধ্য দিয়েই ঘটেছিল। তাই রুশােকে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার জনক বলা হয়।
শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য :
আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য গুলি হল
1) মনস্তত্বের প্রযােগ : প্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে বিভিন্ন শিক্ষাবিদগণ মনােবিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার কথা বলেছিলেন। তার মধ্যে পেস্তালৎসী হলেন অন্যতম। তিনি প্রথম শিক্ষাকে মনােবিজ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত করার কথা বলেন (I wish to psychologies education)। তার মতে ‘শিশুর মানসিক শক্তি ও সামর্থের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষণ পদ্ধতি রচনা করা।’ তাই আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা মনস্তত্বের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। শিক্ষার পদ্ধতি, শৃঙ্খলা, ধারণা, পাঠক্রম ইত্যাদি সবকিছুই মনস্তত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।
2) অবাধ স্বাধীনতা : শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিশুর ওপর বাইরে থেকে কোন কিছু জোর করে চাপিয়ে না দিয়ে, শিশুকে অবাধ স্বাধীনতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। মন্তেশ্বরীর মতে, প্রত্যেক শিশুই নিজস্ব ক্ষমতা ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মায়। তাই শিক্ষার লক্ষ্য হবে শিশুর আগ্রহ, চাহিদা ও সামর্থ্য অনু্যায়ী তাকে পরিবেশের সাথে সার্থক অভিযােজনের সাহায্য করা। শিশুকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে স্বয়ং শিক্ষার সুযােগ দিতে হবে। তাই মন্তেশ্বরী শিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষক হলেন পরিচালক। শিক্ষকের কাজ হল শিশুর কাজে বাধা না দিয়ে তাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা।
3) সক্রিয়তা : আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীর সক্রিয়তার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে শিক্ষার্থীরা কেবল নিস্ক্রিয় ভাবে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের পাঠ গ্রহণ করে না, নানা রকম কাজ কর্মের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে তারা শিক্ষা লাভ করে থাকে। গান্ধীজীর বুনিয়াদি শিক্ষা এবং কিলপ্যাট্রিকের প্রজেক্ট পদ্ধতি সক্রিয়তা ভিত্তিক শিক্ষার যথার্থ উদাহরণ।
4) মুক্ত শৃঙ্খলা : শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার আর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল মুক্ত শৃঙ্খলা। এখানে শিশুর উপর কোন কিছু জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে মুক্ত শৃঙ্খলা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর ফলে শিশুর আচরণের মধ্যে অন্তর্জাত শৃঙ্খলা স্বাভাবিক ভাবেই বিকশিত হবে। তাই বিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য শাসন করার প্রযােজন নেই।
5) সমন্বয়িত পাঠ্যক্রম : আধুনিক পাঠক্রম কোন একটি তত্বের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয় না। এই পাঠক্রমে দার্শনিক, মনস্তাত্বিক, বৈজ্ঞানিক ও সমাজবিদ্যার সমন্বয় ঘটেছে। বিভিন্ন তত্বকে কেন্দ্র করে শিক্ষার পাঠক্রম তৈরি হয়ে থাকে। তাই এই পাঠক্রমকে সমন্বয়িত পাঠক্রম বলা হয়। এটি শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
6) শ্রুতি দর্শন মুলক উপকরণের ব্যবহার : শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার একটি বৈশিষ্ট্য হল শ্রেণীতে শিক্ষাদানের সময় বিভিন্ন শিক্ষা সহায়ক উপকরণের ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে ভূগােল, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার সময় প্রজেক্টর, চার্ট, মডেল ও অন্যান্য শ্রুতি দর্শন মূলক উপকরণের সাহায্যে শিক্ষা দেওয়া হয়।
7) সৃজনশীলতা : শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিশুর সৃজন প্রবণতাকে কাজে লাগানাে হয়েছে। ছবি আঁকা, বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজ, মাটি দিয়ে জিনিস বানানাে ইত্যাদি কাজের মধ্য দিয়ে শিশুর সৃজনশীলতার বিকাশ সাধনের চেষ্টা করা হয়।
8) সহযােগিতাভিত্তিক শিক্ষা : শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিযােগিতার পরিবর্তে পারস্পরিক সহযােগিতার মনােভাব তৈরি করার চেষ্টা করা হয়। প্রতিযােগিতা, হিংসা ও স্বার্থপরতার জন্ম দেয়। তাই বিদ্যালয়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের সহযােগিতা মূলক কাজের ভিত্তিতে শিক্ষা দান করলে তাদের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও ভালােবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়। গান্ধীজীর বুনিয়াদি শিক্ষায় যৌথ কর্মের মধ্য দিয়ে শিক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই শিক্ষার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থী শ্রমের প্রতি মর্যাদা, সহযােগিতা, স্বাবলম্বন প্রভৃতি গুণাবলী আয়ত্ত করে।
9) শিক্ষক শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্পর্ক : বর্তমানে শিক্ষক হলেন শিক্ষার্থীর বন্ধু, পথপ্রদর্শক ও পরামর্শদাতা। শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠনে ও ব্যক্তিত্ব বিকাশে শিক্ষক প্রযােজনমতাে শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। শিক্ষকের প্রতি ভীতির পরিবর্তে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক আজ অনেক সহজ, সরল ও প্রীতিপূর্ণ।
10) অভিজ্ঞতা ভিত্তিক শিক্ষা : বাস্তব অভিজ্ঞতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায়। সমবায় সমিতি, কৃষ্টি মূলক ক্লাব ও বিদ্যালয়ের অন্যান্য অনুষ্ঠানমূলক কাজের পরিচালনার মধ্য দিয়ে একটি সমাজ ধর্মী পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এই ধরনের পরিবেশে শিশু বিভিন্ন সামাজিক অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকে যা তাদের ভবিষ্যতে সুনাগরিক হয়ে উঠতে সাহায্য করে।
11) ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষন পদ্ধতি : শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার প্রত্যেক শিশুকে তার নিজস্ব আগ্রহ, ক্ষমতা অনুসারে বিকাশের সুযােগ দেওয়া হয়। শিক্ষক প্রত্যেক শিশুর ওপর ব্যক্তিগত ভাবে নজর দিয়ে থাকেন। এখানে শিক্ষন পদ্ধতি সম্পূর্ণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক। শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা শিক্ষার্থীর সামর্থ্য, আগ্রহ, বুদ্ধি, চাহিদা ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয় |
আরো পড়ুন
শিক্ষণ কি | শিক্ষনের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য | What is Teaching | Nature and Characteristics of Teaching
মনোযোগ কাকে বলে | মনোযোগের প্রকৃতি গুলি কি কি | Attention in Bengali