বাংলা কথা সাহিত্যের বিকাশে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান

বাংলা কথা সাহিত্যের বিকাশে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান

উত্তর:

বাংলা কথা সাহিত্যের বিকাশে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এক অনন্য জীবন শিল্পী। তিনি বিস্ময়কর প্রতিভা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হন ও বিচিত্র সৃজন কর্মের দ্বারা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন। বাস্তবতার গভীরে ডুব দিয়ে জীবনের জটিলতা কে ধরতে চেয়েছেন সেই জন্য তথাকথিত রােমান্টিকতা পরিত্যাগ করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বস্তুবাদ ও বিজ্ঞান দুটিকে গ্রহণ করেছেন। শুধু তাই নয় সামাজিক সমস্যা ও ব্যক্তির পতনের কারণগুলি কে অনুসরণ করে তাকে তার কথাসাহিত্যে রূপায়নের চেষ্টা করেছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা সম্পর্কে অরুণকুমার মুখােপাধ্যায় বলেছেন -“…মানিকের গল্প পাঠককে কুল হারা জীবন রহস্যের দিকে ঠেলে দেয় না, সংগ্রামী সংকল্প কঠিন মানুষের সঙ্গে মুখােমুখি করিয়ে দেয়।….”

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় চল্লিশটি উপন্যাস লিখেছেন। তার স্বল্পায়ু জীবনের (১৯০৮-৫৬) পক্ষে বিপুল ও বিস্ময়কর সৃষ্টি সম্ভার। তার বিশিষ্ট উপন্যাস গুলি হল— দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫), পুতুল নাচের ইতিকথা (১৯৩৬), পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৩৬) শহরতলী (১৯৪১), অহিংসা (১৯৪১), অমৃতস্য পুত্ৰা (১৯৩৮), চতুষ্কোণ (১৯৪৮), প্রতিবিম্ব (১৯৪৩), দর্পণ (১৯৪৫), আরােগ্য (১৯৫৩), সার্বজনীন (১৯৫২), ছন্দপতন (১৯৫১), মাঝির ছেলে(১৯৬০)।

ক. দিবারাত্রির কাব্য:

উপন্যাসটি প্রেম ভিত্তিক নর নারীর জীবনের জটিল সম্পর্ক চিত্র। উপন্যাসের তিনটি ভাগ প্রথম ভাগ দিনের কবিতায় হেরম্ব সুপ্রিয়ার সম্পর্কের কথা ব্যক্ত হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগ রাতের কবিতায় হেরম্ব আনন্দের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেছে। তৃতীয় ভাগ দিবারাত্রির কাব্য সুপ্রিয়ার আবির্ভাব হেরম্বের মনের অন্তর্দ্বন্দ্ব কে আবার প্রবলভাবে পুনর্জীবিত করেছে। সমগ্র উপন্যাসে সুপ্রিয়ার যৌবনের উন্মাদনা, প্রেমের স্মৃতি, হেরম্বের জীবনের জটিলতা, নানা ঘাত-প্রতিঘাত এছারা প্রতিটি চরিত্র গুলির মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আর জীবনের কবিতা উভয়ের সমন্বয় জীবনের গভীরতম রহস্যের প্রকাশে উপন্যাসটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

খ. পুতুল নাচের ইতিকথা:

পুতুল নাচের ইতিকথায় পল্লীজীবনের বর্ণনা ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে৷ পল্লী জীবনের রােমাঞ্চের মায়াকে পরিহার করে লেখক দুঃখ-বেদনা দারিদ্র্যক্লিষ্ট সাধারন জীবনের জটিল কথা তুলে ধরেছেন। উপন্যাসে গাওদিয়া গ্রামের জীবনের জটিল ও সমস্যাপূর্ণ চিত্র পাওয়া যায়। 

শশী আর কুসুমের অবৈধ নীতি বহির্ভূত সম্পর্কের মধ্যেও এক আশ্চর্য স্নিগ্ধ প্রণয় চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। সেইসঙ্গে মতি ও কুমুদের উপকাহিনি উপন্যাসটিকে আরােও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। শশী মেনে নিতে পারেনি কুসুমের ভালােবাসাকে আবার ভালােবাসার অসহ্য যন্ত্রণাকেউ সহ্য করতে পারেনি। অন্যদিকে শশীর প্রত্যাশায় থাকা বেদনার হাহাকারে বিধ্বস্ত হয়ে নির্বাপিত অগ্নির হিমশীতলতা নিয়ে চলে যায় কুসুম। এও এক ধরনের আত্মার মৃত্যু এভাবেই শেষ হয় উপন্যাসের ট্রাজিক পরিনিতি ।

গ. পদ্মা নদীর মাঝি:

উপন্যাসটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ আঞ্চলিক উপন্যাস। পদ্মা কে কেন্দ্রস্থলে স্থাপন করে যে ধীবর গােষ্ঠীর জীবন এখানে চিত্রিত তা একান্তভাবেই বাস্তব নির্ভর। পদ্মা তীরবর্তী জেলেদের মান-অভিমান ঈর্ষা-চক্রান্ত দলাদলি প্রীতি-ভ্রাতৃত্ব সবকিছুই লেখক এর নিপুণ তুলিতে অঙ্কিত হয়েছে। এই উপন্যাসে জেলেদের জীবন এক সংকীর্ণ পথে আবর্তিত হয়েছে। কুবের-মালা- কপিলার জীবন এই সংকীর্ণ পথে ঘােরাফেরা করছে কুবেরের সঙ্গে কপিলার অনৈতিক সম্পর্ক রচনা করেছে সেটা শেষ পর্যন্ত দুজনেই আপন সংসারকে পরিত্যাগ করে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়িয়েছে। উপন্যাসের অন্যতম বিচিত্র চরিত্র হােসেন মিয়া ও তার সৃষ্ট দ্বীপ উপন্যাসটি কে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। তার আবিস্কৃত দ্বীপটি গ্রামের মানুষদের কাছে কল্পলােকের বার্তা বহন করে এনেছে যার মােহে আচ্ছন্ন হয়ে সেই অচেনা অজানা রহস্যময় জীবনকে বরণ করার জন্য উদভ্রান্তের মতাে ছুটে চলেছে। এটাই ছিল উপন্যাসের মূল কাহিনী। 

ঘ. জননী:

জননী উপন্যাস এ সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে প্রয়াসী হয়েছেন লেখক। জননী শ্যামার চরিত্রে মাতৃত্বের ঐশ্বর্য চিত্রিত হয়েছে একান্ত বাস্তব সুখ-দুঃখকে অবলম্বন করে। জননী উপন্যাসে মাতৃত্বের মর্যাদা প্রতিপন্ন হয়েছে। 

৬. অহিংসা:

এই উপন্যাসে আশ্রমের অধিপতি সদানন্দের ভন্ডামি, ধর্মান্ধতা, যৌন লালসা প্রভৃতির রূপ পেয়েছে। এতে আছে জীবনের বিকার ও সামাজিক ভাঙনের চিত্র।

চ. অমৃতস্য পুত্ৰাঃ:

উপন্যাসে লেখকের উদ্ভট কল্পনা প্রবণতা স্থান পেয়েছে। এই উপন্যাসে জীবনের অঙ্গীকার নেই আছে অস্বীকৃতি। তাইতাে তরঙ্গের মতাে মেয়ে গলায় দড়ি দেয় অনুপমের মত ছেলে আদর্শ যুক্ত হয়। উপন্যাসে উপন্যাসিক জীবনের চেয়ে বিকারকে বেশি করে দেখিয়েছেন। 

ছ. সহরতলী:

এই উপন্যাসে পুঁজিপতি ও মেহনতী মানুষের দ্বন্দ্ব বিশ্লেষিত হয়েছে। শিল্পপতি সত্যপ্রিয় চক্রবর্তী নির্মমতা প্রতিহিংসাপরায়ণ এবং শাসক শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেছে। অন্যদিকে যশােদা শােষিত শ্রেণীর প্রতিনিধি করেছে। যশােদা চরিত্রটি পরিকল্পনার অভিনবত্বে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

জ. ধরা বাধা জীবন:

ধরাবাধা জীবন উপন্যাসে ভুপেনের জীবনের নিঃসঙ্গতার চিত্র চিত্রিত হয়েছে। ভূপেনের স্ত্রী ও ছেলে মারা যাওয়ার পর আট বছর আগে ভালােবাসার পাত্রী প্রভাকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়না ভূপেনের পরিণতি পুতুলনাচের ইতিকথার শশীর মত। 

ঝ. চতুষ্কোণ:

এই উপন্যাসে যৌন জীবন যাপনের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ চিত্রিত হয়েছে।

ঞ. আরােগ্য:

এই উপন্যাসে কেশব ড্রাইভার এর জীবন কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। 

ট. দর্পণ:

এই উপন্যাসে সাধারণ সংগ্রামী মানুষের কঠিন শপথ ও সাহসী লড়াই এর কাহিনী পাই।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের শিল্পসাফল্য ও উপস্থাপনা কৌশল পাঠককে মুগ্ধ করে। বাস্তবের গভীর বিশ্লেষণের অভীপ্সা নিয়ে তিনি কথা সাহিত্যে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এমন শিল্পী যিনি কলম হাতে মুখােশ রচনা করেননি বরং মুখােশের আড়ালে রয়েছে যে আদিম, কৃত্রিম, সুবিধাবাদী রূপ তাকেই তিনি উন্মােচন করেছেন শিল্প জনিত দৃষ্টিভঙ্গিতে। এখানেই রবীন্দ্র-উত্তর সাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা। তাই ভূদেব চৌধুরী লিখেছিলেন “আমাদের কথা সাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নতুন আগুনের এক মস্ত মশাল।”

Leave a Comment

error: Content is protected !!