Q: শিক্ষার লক্ষ্য | Aims of Education in Bengali
Q: শিক্ষার লক্ষ্য কি ?
উত্তর:
শিক্ষার লক্ষ্য (Aims of Education)
প্রত্যেকটি কাজের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য থাকে। উদ্দেশ্যহীন কাজে সময় ও শক্তির অপচয় ঘটে, সাফল্যের নিশ্চয়তা থাকে না। সুতরাং, শিক্ষার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকা প্রয়োজন। শিক্ষার্থী যদি না জানে কি শিখছে বা কেন শিখছে তবে সেই বিষয়ে শেখার প্রতি তার আগ্রহ থাকে না। কতগুলি তাত্বিক জ্ঞান আহরণ তার কাছে নিতান্ত অর্থহীন বলে মনে হবে। তাই যে কোন শিক্ষার একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকা প্রয়োজন।
আরিস্টোটল বলেছেন, ‘প্রতিটি মহৎ শিল্পকলার একটি কল্যাণকর মহৎ লক্ষ্য থাকে।’ যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে শিক্ষার লক্ষ্যেরও পরিবর্তন ঘটে, প্রাচীন কালে শিক্ষার লক্ষ্য ছিল, খাদ্য সংগ্রহ করা ও আত্মরক্ষার কৌশল আয়ত্ত করা। কিন্তু আধুনিক যুগের শিক্ষার লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীন বিকাশ ঘটানো। মানুষের গতিশীল জীবনধারার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার জন্য শিক্ষার লক্ষ্যও বারবার পরিবর্তিত হয়েছে। শিক্ষা হলো একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সুতরাং পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী শিক্ষাকে একটি নির্দিষ্ট অভিমুখে পরিচালিত করা প্রয়োজন।
শিক্ষার লক্ষ্যের প্রয়োজনীয়তা (Determination of Aims of Education) :
শিক্ষা একটি উদ্দেশ্যমুখী সচেতন প্রক্রিয়া। শিক্ষা পরিকল্পনা পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ এবং পরামর্শদান শিক্ষা প্রক্রিয়ার একটি বিশেষ অঙ্গ। শিক্ষার্থী যাতে যথার্থ জ্ঞান লাভ করে সমাজের একজন উপযুক্ত কর্মঠ, সভ্য নাগরিক হতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনা করা হয়ে থাকে। লক্ষ্যছাড়া কোন শিক্ষকের পক্ষেই শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট বয়স, চাহিদা অনুযায়ী পাঠক্রম ও পাঠদান পদ্ধতি নির্ধারণ করা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিচালনা করা অসম্ভব। শিক্ষার লক্ষ্যের প্রয়োজনীয়তা গুলি হল –
1) শিক্ষা একটি গতিশীল প্রক্রিয়া, সমস্ত বৌদ্ধিক কাজে যেমন একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে তেমনি শিক্ষারও একটি বিশেষ লক্ষ্য থাকা প্রয়োজন। লক্ষ্য সম্পর্কে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক উভয়েরই পরিষ্কার ধারণা না থাকলে একসময় তারা ভ্রান্ত ধারণায় বশবর্তী হয়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু থেকে সরে যেতে পারে।
2) লক্ষ্য আমাদের কাজে প্রেরণা যোগায়, ফলাফল সম্পর্কে পূর্বভাস দেয় এবং প্রেষণা সৃষ্টি করে। ফলে শিক্ষার লক্ষ্য পূর্ব নির্ধারিত না হলে শিক্ষার অভিমুখ উপেক্ষিত হবে। কারণ প্রেষণা ব্যক্তিকে লক্ষ্য অভিমুখে পরিচালিত করে।
3) শিক্ষার লক্ষ্য আমাদের সাফল্য সম্পর্কে সচেতন করে। কর্ম সম্পাদনের সঠিক পন্থা নির্ণয়ের সাহায্য করে।
4) শিক্ষার লক্ষ্য সম্পর্কে বিভিন্ন শিক্ষাবিদ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে শিক্ষার লক্ষ্যের ও পরিবর্তন হয়েছে। সমাজের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষার লক্ষ্য স্থির হয়েছে। পরিবর্তনশীলতা শিক্ষার লক্ষ্যের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
শিক্ষার বিভিন্ন লক্ষ্য :
বিবর্তনের ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি শিক্ষার কোন একটি সার্বজনীন লক্ষ্য নেই। শিক্ষার কতগুলি প্রচলিত লক্ষ্য রয়েছে। সেগুলি হল –
1) জ্ঞান অর্জন (Acquisition of Knowledge) : প্রাচীনকাল থেকে জ্ঞান অর্জনকেই শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বর্তমানকালেও শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জনই শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য বলে মনে করা হয়। জ্ঞানই মানুষের মধ্যে অজ্ঞতার অন্ধকার দূর করতে পারে। কমেনিয়াস (Comenius) বলেছিলেন, খাদ্য যেমন শরীর গঠন করে, তেমনি জ্ঞান আমাদের মনকে তৈরি করে।
2) চরিত্র গঠন (Character Formation) : চরিত্রকে বলিষ্ঠ ও কর্মঠ করাই হল শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য। শুধুমাত্র শিক্ষার্থীর পেশীর উন্নয়ন অথবা চিন্তা শক্তির উৎকর্ষ সাধন বা পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভই নয়, শিক্ষকের মৌলিক প্রয়াস হবে চারিত্রিক শক্তি ও পবিত্রতা নিশ্চিত করা।
* ডক্টর সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ বলেছেন, – ‘ভারত সহ সমগ্র বিশ্বের দুর্যোগের কারণ হল, শিক্ষার শুধুমাত্র বুদ্ধি চর্চার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় না’। তাই আধুনিক বিশ্বকে যদি বাঁচাতে হয়, তাহলে শিক্ষার নৈতিক চরিত্র গঠনের উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রদান করা উচিত।
3) সাংস্কৃতিক বা কৃষ্টিমূলক লক্ষ্য (Cultural aim) : শিক্ষার্থীকে সমাজ সংস্কৃতির ধারায় প্রশিক্ষণ দেওয়াই শিক্ষার উদ্দেশ্য। বাহ্যিক আচরণ সহ মানুষের অভ্যন্তরীণ জ্ঞান ও চিন্তার দ্বারা মানুষের ব্যক্তিত্বকে পরিমার্জিত করা এবং তা সমগ্র মানবজাতির সম্পদে রূপায়িত হওয়াকেই ব্যাপক অর্থে কৃষ্টি বা সংস্কৃতি বলে।
4) বৃত্তিমূলক লক্ষ্য (Vocational aim) : বর্তমান যুগে ব্যাপক শিল্পায়ন ও বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে শিক্ষার বৃত্তিমূলক লক্ষ্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। শিশুকে যখন বিদ্যালয়ে পাঠানো হয় তখন আশা করা হয় যেন ভবিষ্যতে সে সম্মানজনক জীবন যাপন করতে সক্ষম হয়। কারণ আজকের শিশু ভবিষ্যতের নাগরিক। তাই শিশুকে প্রথম থেকেই বৃত্তিমুখী প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশনের মতে, জীবিকা অর্জনের যোগ্যতা না থাকলে জ্ঞান অর্জন অর্থহীন।
5) ব্যক্তির বিকাশ (Individual Development) : শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হল – ব্যক্তির বিকাশ ঘটানো। ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক, সৌন্দর্যবোধ ইত্যাদির সার্বিক বিকাশকেই সুষম বিকাশ বলা হয়। পার্শিনান বলেন, শিক্ষার লক্ষ্য হবে ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যকে অবাধে বিকাশ লাভ করার সুযোগ করে দেওয়া। শিক্ষক সেই পরিবেশ রচনা করবেন। যেন কখনোই নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনে সচেষ্ট না হন।
6) অভিযোজন (Adjustment) : বৃদ্ধি ও বিকাশ হল জীবের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু শিশু যদি তার পরিবেশের সঙ্গে যথাযথভাবে অভিযোজন করতে না পারে তবে তার বৃদ্ধি ও বিকাশ কিছুই সম্ভব না। শিক্ষাবিদ হর্নি (Horne) বলেছেন, শিক্ষা মানুষকে একটি উচ্চশ্রেণীর সঙ্গতি বিধানের ক্ষমতা প্রদান করে। এই ক্ষমতার সাহায্যে ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি বিধান করে। জৈবিক ক্ষমতা অনুযায়ী যে প্রাণী যত বেশি উন্নত তার অভিযোজনের ক্ষমতাও তত বেশি।
আরো পড়ুন
সর্বশিক্ষা অভিযান | সর্বশিক্ষা অভিযানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য | Sarba Siksha Abhijan
প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও পাঠক্রম সম্পর্কে কোঠারি কমিশনের সুপারিশ