গান্ধীজির বুনিয়াদি শিক্ষা | ওয়ার্ধা পরিকল্পনা কি | বুনিয়াদি শিক্ষার বৈশিষ্ট্য | Gandhiji’s Basic Education in Bengali
উত্তর:
গান্ধীজির বুনিয়াদি শিক্ষা (Gandhiji’s Basic Education) :
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের 7টি প্রদেশে জাতীয় কংগ্রেস, মন্ত্রিসভা গঠন করে দেশের শাসনভার গ্রহণ করে। এই মন্ত্রিসভা থেকে দাবি করা হয় ভারতে সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার। এই শিক্ষার জন্য প্রয়োজন ছিল প্রচুর অর্থের। কিন্তু সেই পরিমাণ অর্থ প্রাদেশিক সরকারের হাতে ছিলনা। এই জটিল সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এলেন গান্ধীজি, তার জাতীয় শিক্ষা পুনর্গঠন পরিকল্পনা নিয়ে। গান্ধীজি জনগণের সংস্পর্শে এসে দেখেছিলেন দেশের মানুষ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। তিনি বুঝেছিলেন দেশকে জাগাতে হলে ইংরেজি শিক্ষার পরিবর্তে এমন এক ধরনের শিক্ষার প্রবর্তন করা প্রয়োজন যা দেশবাসীকে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করবে। পুঁথিগত শিক্ষা জীবন অনুপযোগী হচ্ছে। জীবন জীবিকার কোন কাজেই লাগছে না। গান্ধীজী নঈতালিম শিক্ষা পরিকল্পনায় প্রচলিত গতানুগতিক শিক্ষার পরিবর্তে নতুনভাবে শিক্ষা পুনর্গঠনের ধারণা দেখতে পাওয়া যায়। এই শিক্ষা শিল্প কেন্দ্রিক। এই শিক্ষাব্যবস্থায় একটি শিল্পকে কেন্দ্র করে অন্যান্য বিষয় শেখানোর কথা বলা হয়েছে। শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা। শিক্ষা হবে স্বনির্ভর। শিল্প থেকে যা আয় হবে তা দিয়ে শিক্ষার ব্যয়ভার নির্বাহ করা হবে। শিক্ষাকে গ্রামীণ অর্থনীতির উপযোগী করে তুলতে হবে।
ওয়ার্ধা পরিকল্পনা :
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে হরিজন পত্রিকায় প্রথম গান্ধীজীর শিক্ষা পরিকল্পনা প্রকাশিত হয়। তিনি বলেন শিক্ষা বলতে আমি বুঝি শিশুর দেহ, মন ও আত্মার সর্বাঙ্গিক বিকাশ সাধন। সাক্ষরতা হল শিক্ষার একটি পথ মাত্র। আমি প্রয়োজনীয় এবং উপযোগী শিক্ষার মধ্যে দ্বিতীয় পথে শিক্ষার সূচনা করতে চাই। ওই বছর অক্টোবর মাসে ওয়ার্ধায় গান্ধীজীর সভাপতিত্বে সর্বভারতীয় শিক্ষা সম্মেলনের আহ্বান করা হয়। ওই পরিকল্পনাই ওয়ার্ধা পরিকল্পনা নামে পরিচিত। নতুন এই শিক্ষা পরিকল্পনাটি কার্যকারী রূপ দেওয়ার জন্য সম্মেলনে যে প্রস্তাব গুলি গৃহীত হয় সেগুলি হল –
1) ইংরেজি ভাষাকে বর্জন করে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
2) সমগ্র জাতির জন্য ৭ বছরব্যাপী বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
3) অবৈতনিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটাই হাতের কাজ শেখানো হবে। অন্য সব বিষয় ওই কেন্দ্রীয় শিল্পের সঙ্গে যুক্ত করে পড়ানো হবে।
4) শিক্ষার ব্যয়ভার ধীরে ধীরে এই শিক্ষা থেকে উঠে আসবে।
এই সকল প্রস্তাবকে সামনে রেখে জাকির হোসেনের সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠন হয়। এই কমিটির নাম দেওয়া হয় জাকির হোসেন কমিটি। কমিটি সবদিক বিচার বিশ্লেষণ করে বুনিয়াদি শিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে উপযুক্ত শিক্ষক তৈরি করার জন্য ওয়ার্ধায় বিদ্যামন্দির ও ট্রেনিং স্কুল প্রতিষ্ঠিত করে। ওয়ার্ধার সঙ্গে যুক্ত ছিল বলে এই পরিকল্পনা ওয়ার্ধা পরিকল্পনা নামেও পরিচিত।
বিভিন্ন প্রদেশে পরীক্ষামূলক ভাবে বুনিয়াদি শিক্ষার কাজ শুরু করার জন্য, ওয়ার্ধায় তিন সপ্তাহ ব্যাপী শিক্ষাবিদদের এক আলোচনা সভা হয়। জাকির হোসেন কমিটি এই নতুন শিক্ষা পরিকল্পনাকে বুনিয়াদি শিক্ষা বলেন। এই শিক্ষাই হবে ভবিষ্যৎ জীবন ধারণের ভিত্তি ভূমি। এই বুনিয়াদি শিক্ষার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে দেশে শিক্ষার ইমারত। জাকির হোসেন কমিটি বুনিয়াদি শিক্ষার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হল –
বুনিয়াদি শিক্ষার বৈশিষ্ট্য :
1) শিক্ষা হবে শিল্প কেন্দ্রিক ও স্বনির্ভর। শিক্ষার্থীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ভিত্তি এই শিক্ষার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠবে।
2) মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হবে।
3) শিক্ষার সঙ্গে গ্রাম্য শিল্প ও ভবিষ্যৎ বৃত্তির মধ্যে সমন্বয় গড়ে তুলতে হবে।
4) সাত বছর পর ছেলেমেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করতে হবে।
5) পাঠক্রমের মধ্যে থাকবে সুতাকাটা, চামড়ার কাজ, কাঠের কাজ, কৃষি ইত্যাদি। সঙ্গে মাতৃভাষা, গণিত, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, পৌর বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সাধারণ বিজ্ঞান, চারু শিল্প, সঙ্গীত ও ইংরেজির পরিবর্তে হিন্দি ভাষা।
বুনিয়াদি শিক্ষার লক্ষ্য (Aim of Basic Education) :
1) বুনিয়াদি শিক্ষার পাঠক্রমের মধ্যে নতুনত্ব ও প্রগতিশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। যেহেতু বুনিয়াদি শিক্ষা হাতের কাজের মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হয় তাই এটিকে শিল্প কেন্দ্রিক শিক্ষাও বলা হয়।
2) বুনিয়াদি শিক্ষার বৈশিষ্ট্য হল অনুবন্ধ পদ্ধতিতে শিক্ষাদান। মূল বিষয়কে কেন্দ্র করে অন্যান্য পাঠ্য বিষয়গুলি শিক্ষার্থীরা শিখবে। যেমন মূল বিষয় হল সুতা কাটা। এই শিল্পটিকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থী যে সকল বিষয়গুলি শিখবে সেগুলি হল-
i) কোন জমিতে তুলার বীজ বপন হয়, কিভাবে জমি চাষ হয় তা শিখবে কৃষিবিদ্যায়।
ii) কোন কোন দেশে তুলা জন্মায়, তার জন্য কিরূপ আবহাওয়া ও মাটির প্রয়োজন তা শিখবে।
iii) তুলা তৈরীর ইতিহাস সম্পর্কে জানবে।
iv) চরকার সাহায্যে সুতা কাটার মাধ্যমে শিক্ষার্থী অন্যান্য যাবতীয় জ্ঞান অর্জন করবে।
3) শিক্ষার্থীদের ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে যৌথভাবে কাজ করতে হবে এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক শিক্ষা লাভ হবে।
4) গান্ধীজী বিশ্বাস করতেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে সত্যবাদিতা, আত্ম সংযম, সরল জীবনযাপন, আত্মনির্ভরতা ইত্যাদি গড়ে তোলা দরকার। বুনিয়াদি শিক্ষার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীকে সমস্ত রকম কাজ যেমন – জল তোলা, জামা কাপড় কাচা, বাসন মাজা, ঘরদর পরিষ্কার রাখা, বাগান তৈরি, মাটির কাজ ইত্যাদি শেখানোর মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের চরিত্র গঠন হয় যা এই শিক্ষার একটি বিশেষ উদ্দেশ্য।
5) গান্ধীজী শিক্ষার ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব স্বীকার করলেও সত্যের অনুসন্ধান ও উপলব্ধিকেই প্রকৃত শিক্ষার লক্ষ্য বলে মনে করতেন। তিনি বুনিয়াদি শিক্ষার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার কথা বলেছেন।
নঈ তালিম শিক্ষা (Nai – Talim Education) :
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনে এই শিক্ষার পরিকল্পনার কিছু সংস্কার সাধন করা হয়। গান্ধীজি তার শিক্ষা পরিকল্পনায় ৭ থেকে ১৪ বছর বয়সের বাইরের অর্থাৎ এর থেকে কম বা বেশি বয়সের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য নঈ তালিম পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। এতে চারটি স্তরের কথা বলা হয়েছে।
1) সাত বছরের কম ছেলেমেয়েদের জন্য প্রাক বুনিয়াদি শিক্ষা।
2) ৭ – ১৪ বছর বয়সের ছেলেমেয়েদের জন্য বুনিয়াদি শিক্ষা।
3) ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে ছেলেমেয়েদের জন্য উচ্চ বুনিয়াদি শিক্ষা।
4) প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য নঈ তালিম শিক্ষা।
আরো পড়ুন
প্রকৃতিবাদ কাকে বলে | শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকৃতিবাদী দর্শনের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করো
সনদ আইন (1813) | সনদ আইনের উদ্দেশ্য | সনদ আইনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
শিক্ষা মনােবিজ্ঞানের প্রকৃতি আলোচনা করো | Nature of Educational Psychology in Bengali