Q: বাংলা নাট্য সাহিত্যে বিজন ভট্টাচার্যের অবদান
Q: বাংলা গণনাট্য আন্দোলনে বিজন ভট্টাচার্যের অবদান
উত্তর:
বাংলা নাট্য সাহিত্যে বিজন ভট্টাচার্যের অবদান :
“গণনাট্য তখনই সম্ভব হইবে যখন গণেরা নাট্যের অনুষ্ঠান করিবে”
—উদ্ধৃত উক্তিটি যিনি করেছেন তিনি বাংলা গণনাট্য আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ বিজন ভট্টাচার্য। বাংলা নাট্যরচনার চিরাচরিত ঐতিহ্য থেকে সরে এসে সাধারণ মানুষের জীবনসমস্যার কথা সাধারণ মানুষকে দেখাবার উদ্দেশ্য নিয়ে নাটক রচনায় যাঁরা ব্রতী হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন বিজন ভট্টাচার্য — যিনি গণনাট্য আন্দোলনের পথিকৃৎ ছিলেন। তাঁর নাটক রচনার উৎস হল মানুষের প্রতি তাঁর সহমর্মিতা — যা তীক্ষ্ণ সমাজদৃষ্টি থেকে উদ্ভূত। বিশেষ করে নাটকের মধ্যে প্রগতিমূলক চিন্তার রূপায়ণে এবং তার প্রসারে বিজন ভট্টাচার্যের ভূমিকা ছিল সর্বাগ্রগণ্য।
বিজন ভট্টাচার্য একই সঙ্গে গণনাট্য ও নবনাট্য আন্দোলনের পুরোধা ব্যাক্তি। তিনি ২৫ টির ও বেশি নাটক রচনা করেছেন তার নাটক গুলিকে কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যেতে পারে-
১। পূর্ণাঙ্গ নাটক : ‘নবান্ন’ (১৯৪৪), ‘অবরোধ’ (১৯৪৭), ‘জতুগৃহ’ (১৯৬২), ‘গোত্রান্তর’ (১৯৫৯), ‘মরাচাঁদ’ (১৯৬২), ‘ছায়াপথ’ (১৯৬২), ‘মাস্টারমশাই’ (১৯৬১), ‘দেবীগর্জন’ (১৯৬৯), ‘কৃষ্ণপক্ষ’ (১৯৬৬), ‘ধর্মগোলা (১৯৬৭), ‘আজ বসন্ত’ (১৯৭০), ‘গর্ভবর্তী জননী’ (১৯৬৯), ‘সোনার বাংলা’ (১৯৭১), ইত্যাদি।
২। একাঙ্ক নাটক : ‘আগুন’ (১৯৪৩), ‘জবানবন্দি (১৯৪৩), ‘মরাচাঁদ (১৯৪৬), ‘কলঙ্ক’ (১৯৫০), ‘জননেতা’ (১৯৫০), চুল্লি (১৯৭৪), ‘হাঁসখালির হাঁস (১৯৭৭)।
৩। রূপক নাট্য : ‘স্বর্ণকুম্ভ (১৯৭০)।
৪। গীতিনাট্য : ‘জীয়নকন্যা’ (১৯৪৮)।
৫। নাট্যরূপায়ণ : ‘গুপ্তধন’ (১৯৭২), ‘নীলদর্পণ (১৯৭২)
বিজন ভট্টাচার্যের কয়েকটি বিশেষ নাটক সম্পর্কে নিম্ন আলোচনা করা হলো –
১. নবান্ন :
নাটকের চারটি অঙ্ক ও পনেরটি দৃশ্য। এই নাটক সম্পর্কে স্বয়ং নাট্যকার বলেছেন, “ঘরে যেদিন অন্ন ছিল না, নিরন্নের মুখ চেয়ে সেদিন আমি নবান্ন লিখেছিলাম। নাটক আরম্ভ করেছিলাম “১৯৪২ সালের জাতীয় অভ্যুত্থান আগস্ট আন্দোলনকে স্বাগত জানিয়ে।” এই নাটকের প্রথম ও চতুর্থ অঙ্কের সব দৃশ্য আমিনপুর গ্রামে এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় অঙ্কের সমস্ত দৃশ্য শহর কলকাতায়, শুধু দ্বিতীয় অঙ্কের চতুর্থ দৃশ্য গ্রামে সংঘটিত হয়েছে। নাটকে কৃষক সমাজের চালচিত্রকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিদেশী শাসনের অত্যাচার, দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর, স্বার্থান্বেষী চক্রের মুনাফাবাজি, কালোবাজারি জনিত আমিনপুরের কৃষকদের দুরবস্থা এবং শেষপর্যন্ত সংঘবদ্ধ প্রতিরোধের মাধ্যমে সেই দুর্দশা থেকে মুক্তির চিত্র অঙ্কিত হয়েছে নাটকে। এবং দুর্ভিক্ষ পীড়নের শেষে নতুন ধানের উৎসব—জীবনে নতুন করে বেঁচে ওঠার আনন্দ উৎসব। ‘নীলদর্পণ’ নাটকের মতো এই নাটকে শুধু অত্যাচার আর শোষণের চিত্র অঙ্কিত হয়নি, জোটবদ্ধ প্রতিরোধের মাধ্যমে যে নবজীবনের সম্ভাবনা সূচিত হয় তার ইঙ্গিত ‘নবান্ন’ নাটকে ধ্বনিত হয়েছে।
২. দেবী গর্জন :
নাট্যকার ‘দেবী গর্জন’ নাটকের ভূমিকায় জানিয়েছেন যে লালমাটির দেশ বীরভূমের পটভূমিতে আদিবাসী ও সাঁওতাল চাষীদের কৃষক আন্দোলনের ভিত্তিতে, শত্রুকে পরাহত করে, ভূমি রূপ জননীকে খুঁজে পাবার সংগ্রামী সাধনা রূপবন্ধ হয়েছে ‘দেবী গর্জন’ নাটকে। নাটক টিতে দেখা যায় প্রভঞ্জন নামে এক মধ্যস্বত্বভোগী, সে সব জমি টুকরো টুকরো করে নিজের তহশীলভুক্ত করেছে। এবং সামন্ত প্রভুদের মতো চালাচ্ছে শাসন ও শোষণ যার ফলে চাষীরা সর্বস্বান্ত হচ্ছে ও প্রভঞ্জনের ধানের গোলা ভরে উঠছে। চাষীদের অন্দরমহল ও প্রভঞ্জনের কামনায় বিধ্বস্ত হয়। কিন্তু প্রভঞ্জন শেষ পর্যন্ত নিজেকে বাঁচাতে পারল না। চাষীরা জোট বাঁধে সর্দারের ছেলে মংলা ও ভূঁইচাষী সঞ্চারিয়ার নেতৃত্বে। নাটকের শেষে মংলার হাতে প্রভঞ্জন খুন হলো দরিদ্র মানুষ প্রভুত্বের কাছ থেকে মুক্তি পায় এবং মুক্ত হয় ধরিত্রী মাতা। সমগ্র নাটকটিতে গ্রামের কৃষক নির্যাতন ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবদের চিত্র সংঘটিত হয়েছে।
৩. গোত্রান্তর :
দেশ বিভাগজনিত মানুষের দুর্দশা এই নাটকের বিষয়বস্তু। একজন উদ্বাস্তু স্কুল শিক্ষক সপরিবারে কিভাবে ভদ্র মধ্যবিত্ত জীবন থেকে বিচ্যুত হয়ে বস্তিবাসী শ্রমিক জীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়ল তারই কাহিনি নাটকে বর্ণিত। এই নাটকে দেখা যায় মধ্যবিত্ত হরেন মাস্টার উদ্বাস্তু হয়ে কলকাতার বস্তি জীবনের বাসিন্দা হয়েছে। অথচ হরেন মাস্টার বস্তি জীবনকে কিছুতে মেনে নিতে পারছে না। হরেন মাস্টারের মেয়ে গৌরী বস্তির শ্রমিক কানায়ের প্রেমে পড়ে। উভয়ের বিবাহ হয়। ধীরে ধীরে হরেন মাস্টার বস্তির জীবনকে মেনে নেয়। বস্তি উচ্ছেদের সময় জমি মালিকের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সকলকে সমবেত করে হরেন মাস্টার।
৪. গর্ভবতী জননী :
এই নাটকে বেদেদের জীবন কাহিনি রূপায়িত হয়েছে। বেদেদের রুচি, জীবিকা সংস্কার, জন্ম-মৃত্যু এই নাটকে গুরুত্ব পেয়েছে। ধরিত্রী মাতা ই হয়েছেন প্রকারান্তরে ‘গর্ভবর্তী জননী’। বেদে-জীবনের বাস্তব দৃশ্যের নিখুঁত বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে তাদের আচার-বিশ্বাস-সংস্কার নিয়ে টোটেমের বিশ্বস্ত প্রতিফলন ঘটেছে এই নাটকে।
৫. আগুন :
গণনাট্য সঙ্ঘের এটিই ছিল প্রথম প্রযোজনা। দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতায় খাদ্যাভাব কত শোচনীয় হয়ে উঠেছিল এই নাটকে তা বলা হয়েছে। পাঁচটি দৃশ্যে নাটকটি বিভক্ত। দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম এবং তাদের ক্ষুধার ভয়ঙ্করতা যথাযথভাবে বর্ণিত হয়েছে এই নাটকে।
৬. জবানবন্দি :
এই নাটকে দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতার মধ্যে গ্রামের কৃষকদের শোচনীয় অবস্থা দেখানো হয়েছে। ক্ষুধার তাড়নায় দরিদ্র কৃষকেরা গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসে। মরণাপন্ন পরাণ মণ্ডল শহরের ফুটপাতে স্বপ্ন দেখে গ্রামের চাষের কথা।
৭. হাঁসখালির হাঁস :
এটি বিজন ভট্টাচার্যের লেখা শেষ নাটক। কলকাতার পাতাল রেলের জন্য মাটি খুঁড়তে আসা শ্রমিকদের নিয়ে এই নাটকটি রচিত হয়েছে। ক্ষুধা, ঠিকাদারের অত্যাচার, বৃদ্ধ শ্রমিকের মৃত্যু, নতুন জন্ম নেওয়া সন্তানের কান্না, সবই শিল্পসাথর্কভাবে পরিস্ফুট হয়েছে এই নাটকে।
বাংলা নাট্যসাহিত্যে বিজন ভট্টাচার্যের গুরুত্ব :
বাংলা নাট্যসাহিত্যে বিজন ভট্টাচার্যের গুরুত্ব অপরিসীম—
১। সমাজ সচেতন শিল্পী বিজন ভট্টাচার্যের হাতে শ্রমিক, কৃষক, শোষণ, বিদ্রোহ, সংগ্রাম, জীবন সম্পর্কে একটা আশাবাদী চেতনা নতুন প্রত্যয়ে প্রতিফলিত হল।
২। তার নাটকে উঠে এল লৌকিক সংস্কৃতি এবং অবক্ষয়িত মধ্যবিত্ত সমাজ।
৩। গ্রামীণ কৃষক জীবন এবং তাদের বিশ্বাস ও সংগ্রাম বিজন ভট্টাচার্যের নাটকে শিল্প সার্থকভাবে পরিস্ফুট হয়েছে।
৪। তাঁর নাটকে প্রথম সত্যিকারের গণজীবনের ছবি প্রত্যক্ষ করা গেল।
৫। তাঁর নাটকে যেমন আছে দুর্গতির চিত্র, তেমন আছে সংগ্রাম ও প্রতিরোধের চিত্র।
৬। বিজন ভট্টাচার্যের নাটক শুধু মার খাওয়া নয়, বেঁচে ওঠার সঙ্কল্প, প্রতিরোধ, নবজীবনের আহ্বানগীতি নিয়েই তাঁর নাটক শেষ হয়েছে। মৃত্যু নয়, নাটকে তিনি জীবনের জয়গান গেয়েছেন।
বিজন ভট্টাচার্য প্রবলভাবেই সমাজ সচেতন। তিনি ছিলেন মাটির মানুষের নাট্যকার, তিনি প্রগতিশীল ভাবনার শরিক, অন্যায় অবিচার শোষণের অবসান চেয়েছেন নিশ্চিত প্রত্যয়ে। জোতদার মহাজনের অপরিসীম লোভ ও লালসা, কৃষকদের ওপর অত্যাচার, নারী নির্যাতন, অসহায় চাষী কৃষকদের জোট বাঁধা ও মহাজনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং তাদের হাতে অত্যাচারীর মৃত্যু : শ্রেণী সংগ্রামের এই আদর্শ বিজন ভট্টাচাৰ্যই প্রথম নির্মাণ করেন এবং সেই অর্থেই প্রগতিশীল নাট্য আন্দোলনের তিনি অগ্রণী পুরুষ। তাঁর নাটক দিয়েই ভারতীয় গণনাট্য সংঘের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল।
আরো পড়ুন
বাংলা নাট্য সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো
বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে শ্রীরামপুর মিশনের অবদান আলোচনা করো
বাংলা নাট্য সাহিত্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদান আলোচনা করো
বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবদান
বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করো
বাংলা নাট্য সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো