বাংলা সাহিত্যে ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের অবদান
উত্তর:
রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলার ঔপন্যাসিকদের মধ্যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) বিশেষ স্বাতন্ত্রের দাবী করতে পারেন। প্রকৃত বাংলা উপন্যাসের প্রচলিত ধারা থেকে তিনি এক স্পর্ধিত ব্যতিক্রম। তিনি রোমান্সপ্রবণ ঔপন্যাসিক রূপে সমধিক পরিচিত। বিভূতিভূষণ প্রকৃতিপ্রেমিক শিল্পী ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো তাঁকেও বলা যায় “the highest priest of Nature – প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সাধক”।
বিভূতিভূষণ জীবন-সচেতন শিল্পী। তিনি রোমান্টিক কিন্তু তা সবসময় জীবন থেকে সরে যাওয়া নয়, জীবনের গভীরে নিবিষ্ট হওয়া। তাই মানব মনের হাসিকান্না আনন্দবেদনার অফুরান উৎসারণ তাঁর রচনায় পাওয়া যায়; জীবনের সমস্যা সংকটও সেখানে তীব্র হয়ে দেখা দেয়’।
তার রচিত উপন্যাস গুলি হল- ‘পথের পাঁচালী’ (১৯২৯), ‘অপরাজিত’ (১ম ও ২য় ১৯৩২), ‘দৃষ্টিপ্রদীপ’ (১৯৩৫), ‘আরণ্যক’ (১৯৩৯), ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ (১৯৪০), ‘বিপিনের সংসার’ (১৯৪১), ‘দুই বাড়ী’ (১৯৪১), ‘অনুবর্তন’ (১৯৪২), ‘দেবযান’ (১৯৪৪), ‘কেদার রাজা’ (১৯৪৫), ‘অথৈ জল’ (১৯৪৭), ‘ইছামতী’ (১৯৫০), ‘অশনি সংকেত’ (১৯৫৯, মৃত্যুর পর প্রকাশিত) ইত্যাদি।
বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের উপন্যাসসমূহ :
নিম্নে কয়েক টি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:-
১. ‘পথের পাঁচালী’ নির্মিত হয়েছে একটি অসহায় দরিদ্র অথচ উচ্চমানসিকতাসম্পন্ন ছোট পরিবারকে কেন্দ্র করে। হরিহর সর্বজয়া এবং তাদের বালিকা কন্যা দুর্গা ও শিশুপুত্র অপুর জীবনের বেদনাঘন ও আনন্দময় অনুভূতি নিয়ে কাহিনী গ্রথিত। ‘পথের পাঁচালী’ প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতি ও মানুষের নিবিড় অন্তরঙ্গতার শিল্পালেখ্য।
২. ‘আরণ্যক’ আঠারো পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত বিহার প্রদেশের অরণ্য-অঞ্চলের পটভূমিকায় উপস্থাপিত প্ৰকৃতি মানবজীবনের কাহিনী। এক যুবক চাকরী নিয়ে কলকাতা থেকে বিহারের পূর্ণিয়া জেলায় আসে ও জঙ্গলমহালে কাজ শুরু করে। প্রথমে সে কর্মকোলাহলময় প্রাণচঞ্চল শহর থেকে দূরে এসে খুশী হয়নি। কিন্তু ক্রমে নির্জন প্রকৃতি অরণ্য-পর্বতময় পরিবেশ তাকে মুগ্ধ আচ্ছন্ন করে ও অরণ্য-প্রান্তরের নিবিড় মায়াময় আকর্ষণে সে ধরা পড়ে।
৩. “আদর্শ হিন্দু হোটেল’ সুখপাঠ্য কাহিনী যাতে দেখানো হয়েছে একজন সৎ নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ-পাচক হোটেলে কাজ করতে করতে হোটেল মালিক হবার স্বপ্ন দেখে ও তা পূরণ হয়। মানুষের সততা নিষ্ঠা আন্তরিকতা, আপন কর্মের প্রতি আনুগত্য ও সকলের সঙ্গে সহৃদয় সম্পর্ক রাখা যে একজন মানুষের বাসনা পূর্তিতে সহায়ক হয় জীবনের এই সরল সত্য ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ উপন্যাসে কথিত হয়েছে।
৪. ‘বিপিনের সংসার’ উপন্যাসে বিপিনের জীবনকে দুই বিবাহিতা কতখানি প্রভাবিত করেছে তা বিবৃত হয়েছে। মানী এবং শাস্তি এই দুই বিবাহিতা রমণীর কথা এখাঁনে এসেছে। এছাড়া এই উপন্যাসে আরও অনেকগুলো প্রণয়ের কথা এসেছে; যেমন বিপিনের বিধবা ভগ্নী বীনার সঙ্গে পটলের প্রেম, গ্রাম্য পণ্ডিত বিশ্বেশ্বরের সঙ্গে বাগদীর মেয়ের প্রেম, বিনোদ চাটুজ্জের সঙ্গে জামিনী গোয়ালিনীর প্রেম ইত্যাদি।
৫. ‘দেবযান’ অধ্যাত্মলোকের কথা। মর্ত্যমায়া কাটাবার পর মানুষ অন্য লোকে যায়। যারা শুদ্ধমুক্ত আত্মা তারা যান এক উন্নতলোকে আলোকিত আনন্দময় চিরসুন্দরের রাজ্যে যেখানে পবিত্র সত্তা বিদ্যমান। এখানে দেবতাদের সুন্দর সুনীল জ্যোতির্বিমণ্ডিত দেহ, তাদের অঙ্গের রূপ ও জ্যোতিতে সব আলোকিত, সর্বত্র অমৃতের নির্ঝর প্রবাহিত হচ্ছে। এদের অনেক অনেক উর্ধ্বে ঈশ্বরের অধিষ্ঠান যিনি অনন্ত শয্যায় অনন্ত নিদ্রায় মগ্ন। সেই অনন্তলোকের বার্তা দেবযান।
৬. অপরাজিত : ‘পথের পাঁচালী’ যেখানে শেষ, ‘অপরাজিত’ সেখান থেকে শুরু। ‘পথের পাঁচালীর শেষে অপু অপরাজিত জীবনের সন্ধান পেতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে। ‘অপরাজিত’তে অপু তরুণ তবুও শৈশবের স্বপ্নকে হারায়নি।
৭. দৃষ্টিপ্রদীপ : ‘দৃষ্টিপ্রদীপ’ অনেকটা শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’র ঢঙে লেখা, জিতুও মালতীর প্রেম উপখ্যান ব্যর্থ প্রেমের স্মৃতি, প্রকৃতিচিত্তা—সব মিলিয়ে এ উপন্যাসে একটা রোমান্টিক পরিবেশ লক্ষ্য করা যায়। ‘মালতীর চরিত্রর সঙ্গে ‘শ্রীকান্ত’র কমললতার অনেক মিল দেখা যায়।
৮. দুই বাড়ী : উপন্যাসটি স্বপ্নের জলছবি। এই উপন্যাসের নায়ক নিধিরাম মোক্তারি পাশ করে কিছু উপার্জনের আশায় তার বাবার বন্ধু যদু মোক্তারের কাছে উপস্থিত হয়েছে। তার বড় প্রাপ্তির আশা ছিল না, সে অল্পেই খুশি ছিল। নিত্য নৈমিত্তিক অভাব, গ্লানি, দুঃখ দেখে নিধিরাম যখন ক্লান্ত তখন সে পেয়েছে মঞ্জুরীর মতো উদারমনা নারীকে। এরপর নিধিরামের জন্মান্তর ঘটেছে। তার জীবনে এসেছে আর এক নারী হৈম। কিন্তু শেষপর্যন্ত সবকিছুই তার স্বপ্ন থেকে গেছে।
৯. অনুবর্তন : উপন্যাসটি শিক্ষকসমাজের জীবনচর্যার কাহিনি। শিক্ষকের আদর্শ, কর্মপন্থা, টিউশানি প্রভৃতি বাস্তব চিত্র তিনি এই উপন্যাসে এঁকেছেন। শিক্ষকদের সামাজিক অবস্থানকে ও তাদের অন্তঃসারশূন্য অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে অনেকটা রিপোর্টারের মতো রূপ দিয়েছেন লেখক।
১০. ইছামতী বিভূতিভূষণের সাহিত্য জীবনের শেষ পর্বের রচনা। বিংশ শতকের প্রথমার্ধের ইছামতী নদীশাসিত গ্রামবাংলার এক সার্থক চিত্র এই উপন্যাসে লিপিবদ্ধ। ‘ইছামতী’ একটি বস্তুনিষ্ঠ সামাজিক দলিল। সুন্দরী ইছামতীর কূলে সুন্দরে-অসুন্দরে মিশ্রিত যে ঘটমান জীবননাট্য তা-ই চিত্রিত হয়েছে উপন্যাসে। এটি একটি মহাকাব্যিক উপন্যাস।
বিভূতিভূষণের শিল্পবৈশিষ্ট্য :
বিভূতিভূষণের শিল্পবৈশিষ্ট্যগুলি আমরা উল্লেখ করতে পারি।
১. বিভূতিভূষণ ভিন্নধর্মী লেখক। তাঁর সৃষ্টির রথচক্র মৃত্তিকাকে ছুঁয়েও মালিন্যদৃষ্ট হয় না—তা অমূর্ত সাধনায় দ্যুতিময়।
২. তিনি রোমান্স-প্রবণ কবিপ্রাণ ঔপন্যাসিক। রোমান্সের অপরূপ মায়া ও কবিত্বের কল্পনায় দীপ্তিতে তাঁর রচনা সমুদ্ভাসিত।
৩. তিনি বাস্তবতাকে অবহেলা করেননি—মানুষের সুখ দুঃখ হাসিকান্নার প্রকাশে তিনি দক্ষ। তিনি বিদ্রোহ প্রতিবাদী বা দ্বন্দুসংক্ষুব্ধ নন, বরং শান্ত স্থির স্থিতধী।
৪. বিভূতিভূষণ প্রকৃতিপ্রেমিক। প্রকৃতির এত সূক্ষ্ম সুন্দর অনুপম বর্ণনা অন্য কোনো বাঙালী ঔপন্যাসিকদের মধ্যে দেখা যায় না। কবি জীবনানন্দর সঙ্গে তাঁর তুলনা চলে, তবে জীবনানন্দের কবিতায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার চূড়ান্ত রূপ পাওয়া যায়, বিভূতিভূষণ ইন্দ্রিয়কে ভালবেসে ও তার মধ্যে অতীন্দ্রিয়কে অন্বেষণ করেছেন।
৫. বিভূতিভূষণ অলৌকিক রসের সাধকও বটে। অতীন্দ্রিয় জীবন অতিলৌকিক সত্তার পরিচয় তিনি লাভ করেছেন। অমূর্ত অধ্যাত্ম পরম জীবনের স্বরূপ তাঁর সামনে প্রতিভাত হয়েছে; আবার তন্ত্রসাধনার ভয়ংকর রূপও ধরা পড়েছে তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে।
৬. কাহিনীর রূপনির্মিতিতেও তিনি স্বতন্ত্র। কাহিনীর নিটোল বৃত্ত তাঁর সাহিত্যে স্বল্প। ভাষারীতিতেও চাকচিক্য বা বাগ বৈদগ্ধ নেই। তাঁর কাহিনীর ভাষা সরল আন্তরিকতায় গভীরতায় হৃদয়কে প্রকাশ করে ও চৈতন্যকে উন্মীলিত করে।
আরো পড়ুন
বাংলা ছোট গল্পে রবীন্দ্রনাথের অবদান
বাংলা নাট্য সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো
বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে শ্রীরামপুর মিশনের অবদান আলোচনা করো