ভারতে রেলপথ প্রবর্তনের উদ্দেশ্য উল্লেখ করো | সেই সঙ্গে রেলপথ প্রবর্তনের প্রভাব আলোচনা করো
উত্তর:
1853 খ্রিস্টাব্দের 16 এপ্রিল লর্ড ডালহৌসি ভারতে প্রথম রেলপথ স্থাপন করেন। 21 মাইল দীর্ঘ এই রেলপথ স্থাপিত হয়েছিল বোম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত।
ভারতে রেলপথ প্রবর্তনের উদ্দেশ্য :
1) সামরিক কারণ : ভারতের দূরবর্তী স্থানে দ্রুত সেনাবাহিনী প্রেরণ এবং সৈন্যদের প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী, রসদ ও অর্থ প্রেরণের জন্য রেলপথ স্থাপন ছিল অপরিহার্য।
2) যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন : যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করে বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও বিকাশ ঘটানো ছিল রেলপথ স্থাপনের অন্যতম উদ্দেশ্য।
3) কাঁচামাল প্রেরণ : রেলপথ পরিবহণের মাধ্যমে দেশের কাঁচামাল বিভিন্ন বন্দরে পৌঁছে দেওয়া ছিল রেলপথ মাধ্যমের একটি উদ্দেশ্য।
4) ব্রিটিশ পণ্য ভারতে প্রেরণ : ইংল্যান্ডের কারখানায় উৎপাদিত শিল্প সামগ্রী অতি সহজে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছে দেওয়া ও রেলপথ স্থাপনের অন্যতম উদ্দেশ্য।
5) বিদ্রোহ দমন : দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন বিদ্রোহ দমন এবং যুদ্ধকালে সৈন্যবাহিনীর কাছে খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম প্রেরণ প্রভৃতি কাজে দ্রুতগামী রেলপথ ব্যবস্থার প্রয়োজন দেখা দেয়।
6) প্রশাসনিক উদ্দেশ্য : ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে কার্যকরী ব্রিটিশ প্রশাসন বজায় রাখার জন্যও রেলপথের মতো আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা প্রয়োজন।
7) জরুরী পরিস্থিতির মোকাবিলা : দুর্ভিক্ষ, মহামারী বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রভৃতি জরুরী পরিস্থিতিকালীন সময়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য রেল পরিবহন খুবই আবশ্যিক ছিল।
8) ব্রিটেনের শিল্প কাঠামোর উন্নয়ন : রেলপথের মাধ্যমে শিল্প কাঠামো গঠন করে ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হয়েছিল। এর দ্বারা ব্রিটেনের শিল্প কাঠামোকে উন্নত করে তোলা হয়েছিল।
9) ব্রিটিশ পুঁজির বিনিয়োগ : ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের ফলে প্রচুর সঞ্চিত উদবৃত্ত পুঁজি ব্রিটিশ শিল্পপতিরা নিরাপদ ও লাভজনক বাণিজ্যে বিনিয়োগ করার জন্য আগ্রহী হয়েছিল। তারা এক্ষেত্রে ভারতের রেলপথ নির্মাণকে বেছে নেয়।
10) মুনাফা অর্জন : ভারতে রেলপথ ব্যবস্থা চালু হলে ইঞ্জিন, মালগাড়ি ও রেলপথের সরঞ্জাম বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করতে পারবে বলে মনে করে ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা।
উপসংহার : ভারতে রেলপথ প্রবর্তনে ব্রিটিশদের আসল উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসায়িক স্বার্থ পূরণ করা এবং ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিতকে আরো সুদৃঢ় করা। কারণ রেলপথ স্থাপনের মাধ্যমে তারা একদিকে ভারতীয়দের বিদ্রোহকে যেমন দ্রুত দমন করতে পারবে সংশ্লিষ্ট স্থানে সেনা বাহিনী প্রেরণের মাধ্যমে অন্যদিকে পুঁজি বিনিয়োগ করে উচ্চ মুনাফা অর্জন করতে পারবে।
ভারতে রেলপথ প্রবর্তনের প্রভাব :
সদর্থক প্রভাব
1) বাণিজ্যের উন্নতি : রেলপথের মাধ্যমে ভারতের বিভিন্ন বাণিজ্য কেন্দ্রগুলির মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় এক অঞ্চলের পণ্য অন্য অঞ্চলে সহজেই সরবরাহ করা সম্ভব হয়। ফলে মূল্য স্তরে আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস পায় এবং দেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়।
2) আমদানি ও রপ্তানি বৃদ্ধি : রেলপথের মাধ্যমেই ভারতের সম্পদ অতি সহজে ইংল্যান্ডে পাচার হয়ে যায়। অপরদিকে, বিলিতি পণ্যে ভারতীয় বাজার ছেয়ে যায়।
3) কর্মসংস্থান : ভারতে রেলপথের প্রসার বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। দেশের ভূমিহীন কৃষক শ্রেণি অদক্ষ রেলশ্রমিকের কাজে নিয়োজিত হয়।
4) জীয়তাবাদের প্রসার : রেলপথ স্থাপনের অনিচ্ছাকৃত সুফলস্বরূপ ভারতে জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটে। নানান ভাষা ও সংস্কৃতিসম্পন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সহজ যোগাযোগ স্থাপিত হলে প্রাদেশিকতার অবসান ঘটে এবং জাতীয় ঐক্যের ধারণা সুদৃঢ় হয়।
নঞর্থক প্রভাব
1) সম্পদের বহির্গমন : গ্যারান্টি ব্যবস্থার মাধ্যমে রেলপথ নির্মাণের ফলে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় অর্থ ইংল্যান্ডে পাচার হতে থাকে।
2) অবশিল্পায়ন : রেল যোগাযোগের ফলে ভারত ইংল্যান্ডের কারখানাগুলির কাছে খোলাবাজার এবং কাঁচামাল সরবরাহের উৎসে পরিণত হয়। ইংল্যান্ড জাত সস্তা অথচ টেকসই শিল্পপণ্যের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পরে ভারতীয় কুটির শিল্প ধ্বংস হয়ে যায়।
3) জলসেচের অবনতি : রেলপথ নির্মাণের সঙ্গে অপরিকল্পিত বাঁধ ও সেতু নির্মাণ, জল ভরাট প্রভৃতি প্রক্রিয়া যুক্ত থাকায় একদিকে নদীর পরিবহনযোগ্যতা হ্রাস পায়, অন্যদিকে জলসেচ ব্যাহত হয়।
4) ভারী শিল্পের বিকাশ ব্যাহত : কার্ল মার্কস রেলপথকে ভারতের আধুনিক শিল্পের অগ্রদূত বলে মনে করলেও বাস্তবে হয়নি। রেলইঞ্জিন ও অন্যান্য ভারী যন্ত্রপাতি ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করা হলে ভারতে ভারী শিল্পের বিকাশ ব্যাহত হয়েছিল।
আরো পড়ুন
মিথ ও লিজেন্ড বলতে কী বোঝ | অতীত বিষয়ে মানুষের ধারণাকে এরা কিভাবে রূপদান করে
পেশাদারী ইতিহাস বলতে কী বোঝো | পেশাদারী ইতিহাসের সঙ্গে অপেশাদারী ইতিহাসের পার্থক্য উল্লেখ করো