প্রশ্নঃ জীবনী সাহিত্য কাকে বলে?
প্রশ্নঃ জীবনী সাহিত্যের বৈশিষ্ট্যগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
প্রশ্নঃ একটি সার্থক বাংলা জীবনী সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর:
জীবনী সাহিত্যের সংজ্ঞা :
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম একটি শাখা জীবনচরিত বা জীবনী সাহিত্য। জীবনচরিতের ইংরেজি প্রতিশব্দ বায়োগ্রাফি। জীবনী সাহিত্য বা Biography বলতে আমরা সাধারণভাবে বুঝি কোনো ব্যক্তি বিশেষের জীবনবৃত্তান্তকে, তার চরিত্রকে সুবিন্যস্তভাবে লিপিবদ্ধ ও বিশ্লেণ করা। সুতরাং জীবনচরিতের সংজ্ঞা হিসেবে আমরা বলতে পারি –
কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির জীবনকথাকে অবলম্বন করে যখন জীবনীকার কোনো গ্রন্থ প্রণয়ন করেন তাকে বলা হয় জীবন চরিত বা Biography বা জীবনী সাহিত্য।
তবে অবশ্যই মনে রাখতে হবে জীবনচরিত যাকে নিয়ে লেখা হবে তাঁর জীবনে আনুপূর্বিক পরিচয় জীবনীকারকে পেতে হবে এবং তিনি কাহিনী এমনভাবে সাজাবেন যাতে করে মানুষটির জীবনের বাইরের ও ভেতরের চেহারাটি পাঠকের মনের পর্দায় সমানভাবে প্রতিভাত হয়।
জীবনী সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য :
ভালো মানের জীবনী সাহিত্য নির্মাণে লেখককে বেশ কিছু বিষয় স্মরণ রাখতে হয়। আমরা সূত্রাকারে তার পরিচয় তুলে ধরলাম –
ক. জীবনী সাহিত্য হল ব্যক্তি জীবনের ঘটে যাওয়া ইতিহাস। তাই লেখককে অত্যন্ত সচেতন ভাবে তথ্য সংগ্রহ করে জীবনী সাহিত্য রচনা করতে হবে কেননা – ব্যক্তিজীবনের পরিচয় উন্মোচনের পাশাপাশি এটি একটি ঐতিহাসিক দলিলও বটে।
খ. কথা সাহিত্যের চরিত্রের বিবর্তনের মতো যদি ব্যক্তিজীবনকে সাহিত্যরসে জারিত করে বিবর্তন ঘটানো যায়, তবে জীবনী সাহিত্যটি মাধুর্যমন্ডিত হয়ে উঠবে।
গ. অতিরিক্ত তথ্যভার বর্জন করে অথচ তথ্যবিকৃতি না ঘটিয়ে চরিত্রকে এমনভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে হবে যাতে তিনি জীবনচরিত পাঠে আনন্দ পান।
ঘ. লেখককে নিরপেক্ষ থেকে জীবনচরিত রচনায় মনোনিবেশ করতে হবে। কোনো রকম নীতি আদর্শ বা নিজস্ব মতামত তিনি চাপিয়ে দেবেন না।
ঙ লেখককে মনে রাখতে হবে জীবনচরিতটি যেন ‘Perfect pattern of well told life’ কে বজায় রাখে। না হলে মূল জীবনীটি সুপরিস্ফুট হবে না।
চ. জীবনচরিতের ক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতিতে কালক্রম অনুসরণ করলে তা সর্বাঙ্গসুন্দর হয়।
একটি বাংলা জীবনী সাহিত্য :
রবীন্দ্রনাথের ‘চরিত্রপূজা’ গ্রন্থখানি জীবনী সাহিত্যের উজ্জ্বল আলেখ্য। এখানে রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর ও দেবেন্দ্ৰ নাথ ঠাকুর এই তিনজনকে নিয়ে আলোচনার মধ্য দিয়ে গ্রন্থখানি পূর্ণতা পেয়েছে।
‘রামমোহন রায়’ প্রবন্ধটি ১৯৯১ সালের ৫ মাঘ, রাজা রামমোহন রায়ের স্মরনার্থ সভায় সিটি কলেজ গৃহে পঠিত। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন “বর্তমান অর্থ সমাজের ভিত্তি স্থাপন করিয়াছেন রামমোহন রায়। আমরা সমস্ত বঙ্গবাসী তাঁহার সম্পত্তির উক্ত অধিকারী। তাঁহার নির্মিত ভবনে বাস করিতেছি।” এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ রামমোহনের আত্ম ধারণাশক্তির অসামান্যতাকে বুঝিয়েছেন, তিনি জানিয়েছেন শিক্ষা বলো, রাজনীতি বলো, কর্মভাষা বলো, বঙ্গসাহিত্য বলো, সমাজ বলো, ধর্ম বলো, কেবলমাত্র হতভাগ্য স্বদেশের মুখ চাহিয়া তিনি সমস্ত বিষয়েই কাজ করেছিলেন। এই রামমোহন ভারত পথিক, সংস্কার বিমুখ হিন্দুধর্ম ও সমাজকে তিনি রক্ষা করেছিলেন। এখানে অন্যের দায় নেই, আছে মুক্ত চিন্তা, আর আছে রামমোহনের অন্তজীবন ও কর্মকান্ডের সুনিপুন বর্ণনা। যার মধ্য দিয়ে তিনি রামমোহনের জীবন চরিতের সারাংশ ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
‘চরিত্রপূজায়’ দ্বিতীয় পর্যায়ে বিদ্যাসাগর চরিত সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে। ১৩০২ সালের ১৩ই শ্রাবণ বিদ্যাসাগরের স্মরণসভায় এটি তিনি পাঠ করেছিলেন। তিনি লিখেছেন – বিদ্যাসাগরের জীবনবৃত্তান্ত আলোচনা করিয়া দেখিলে এই কথাটি বারংবর মনে উদয় হয় যে তিনি যে বাঙালী বড়লোক ছিলেন তাহা নহে, তিনি যে রীতিমত হিন্দু ছিলেন তাহা নহে। তিনি তাহা অপেক্ষাও অনেক বেশি বড় ছিলেন। তিনি যথার্থ মানুষ ছিলেন। বিদ্যাসাগর বাংলাভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী, তাঁর প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা। বিদ্যাসাগরের পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ, পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মাতা ভগবতী দেবীর কথা উঠেছে এই প্রবন্ধে। বিদ্যাসাগর চরিত্রের ‘অজেয় গৌরব ও অক্ষয় মনুষ্যত্বের প্রতি রবীন্দ্রনাথ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। এখানে তথ্য বিশ্লেষণ হয়েছে সাহিত্য রসে সম্পৃক্ত হয়ে।
‘মহর্ষির জন্মোৎসব’, মহর্ষির আত্ম্যকৃত উপলক্ষ্যে প্রার্থনা, মহাপুরুষ প্রবন্ধগুলির মধ্যে দিয়ে মহর্ষির অন্তরের সত্যের স্মৃতি ফুটিয়ে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ, বিপুল ঐশ্বর্যের মধ্যে থেকেও অমৃতের জন্য গভীর আকুতি তাঁর ধ্যান সুন্দর মূর্তিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
অর্থাৎ এসকল প্রবন্ধে জীবন চরিতের তথাকথিত ঘটনা বা অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ হয়নি। রবীন্দ্রনাথ এখানে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন চরিত্রের অন্তরতম সত্য ও ভাবগত সত্য, তাই জীবন চরিত্র ‘চরিত্রপুজা’ জীবনী সাহিত্যের মর্যাদায় উন্নিত হয়েছে।
আরো পড়ুন
বাংলা কাব্য সাহিত্যে বিহারীলাল চক্রবর্তীর অবদান
বাংলা নাট্য সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো
বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে শ্রীরামপুর মিশনের অবদান আলোচনা করো