উডের ডেসপ্যাচ (1854) | 1854 সালে উডের ডেসপ্যাচ এর সুপারিশ | Wood’s Despatch in Bengali

Q: উডের ডেসপ্যাচ (1854) | 1854 সালে উডের ডেসপ্যাচ এর সুপারিশ | Wood’s Despatch in Bengali
Q: উডের ডেসপ্যাচ কি
Q: 1854 সালে উডের ডেসপ্যাচ এর সুপারিশ গুলি লেখ

উত্তর:

উডের ডেসপ্যাচ (1854)

1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয় শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং শিক্ষার অগ্রগতির জন্য এক লক্ষ টাকা ব্যয় করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কিন্তু পরবর্তী দশ বছরেও শিক্ষাক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন ঘটেনি। 1823 খ্রিস্টাব্দে শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারি নিষ্ক্রিয়তার অবসান ঘটানাের জন্য GCPI গঠন করা হয়। এই সময় প্রাচ্য পাশ্চাত্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। অবশেষে,1836 খ্রিস্টাব্দে মেকলে মিনিট ও বেন্টিঙ্কের শিক্ষাবিষয়ক প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট শিক্ষানীতির নির্দেশ পাওয়া যায়। এই সময় শিক্ষা সংক্রান্ত কতকগুলি প্রশ্ন শাসক দলের মধ্যে দানা বেঁধেছিল। তার কারণ গুলি হল – 

Sir Charles Wood

• ‘চুইয়ে নামা নীতি’র (downward filtration theory) ব্যর্থতা ও মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে দেশের জনসাধারণ যথেষ্ট সচেতন হয়ে উঠেন। সেই কারণেই কোম্পানি সরকার নতুন শিক্ষানীতির প্রযােজনীয়তা অনুভব করে। 

• সমগ্র ভারত তখন ইংরেজ কবলিত মহারানী ভিক্টোরিয়া যুগ। শিল্প ও বাণিজ্যের তখন যথেষ্ট প্রসার ঘটেছে। নতুন কল-কারখানা স্থাপনের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের বৃদ্ধি ঘটেছ।ফলে নতুন অর্থনৈতিক পেক্ষাপটে আরাে বেশি দক্ষ কর্মচারী- কেরানি, আধা ইংরেজি জানা কর্মচারী প্রযােজন হয়ে পড়ে। এই কর্মচারী তৈরির জন্য শিক্ষার প্রয়ােজনীয়তা অনুভূত হয় ।

 •মেকলে মিনিটের পরিকল্পনায় বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে প্রভুত্ব বানানাের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। সেই শিক্ষিত সম্প্রদায় আধুনিক ইউরােপীয় শিক্ষাথেকে বিপ্লব ও মুক্তির আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইংরেজ শাসনের সমালােচনা শুরু করেছিল।

1853 সালে কোম্পানির সনদ আইন নবীকরণের সময় দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক পর্যালােচনার

প্রযােজন হয়। তাই কোম্পানির বাের্ড অফ কন্ট্রোলের সভাপতি চার্লস উডের নির্দেশ ও পরামর্শ । মতাে 1854 খ্রিস্টাব্দে যে বিশেষ শিক্ষা দলিল রচিত হয় তা ভারতের ইতিহাসে উডের ডেসপ্যাচ (Wood’s Despatch) নামে পরিচিত। 

উডের ডেসপ্যাচের উদ্দেশ্য :

 1) ভারতে প্রযােজনীয় পাশ্চাত্য জ্ঞানের প্রসার ঘটানােই ছিল এই শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্।

 2) এই শিক্ষার মাধ্যমে শুধুমাত্র বুদ্ধি ও চরিত্রের বিকাশ হবে না, এর মধ্য দিয়ে যােগ্য নৈতিক বুদ্ধিসম্পন্ন বিশ্বাসী কর্মচারী সৃষ্টি হবে ।

3) ভারতবাসীরা যাতে ইংল্যান্ডের সঙ্গে সুষ্ঠু সম্পর্ক বজায় রেখে কার্যকারী শিক্ষা লাভ করতে পারে তা দেখা কোম্পানির কর্তব্য।

4)ইউরোপীয় ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে ভারতীয়দের সচেতন করে তুলতে হবে এবং ইংল্যান্ডের কারখানার জন্য প্রযােজনীয় কাঁচামালের সরবরাহ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া ও ব্রিটেনের উৎপন্ন পণ্যের জন্য ভারতের বাজারে অফুরন্ত চাহিদা সৃষ্টি করা ছিল এই শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য।

উডের ডেসপ্যাচের সুপারিশ:

1) প্রাচ্যবিদ্যা : প্রাচ্যবিদ্যার ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব এবং হিন্দু-মুসলিম আইনের ব্যাখ্যার জন্য প্রাচ্য ভাষার গুরুত্ব স্বীকার করে নিয়ে ডেসপ্যাচে প্রাচ্যবিদ্যা সম্পর্কে মন্তব্য করা হয় যে, প্রাচ্য বিজ্ঞান ও দর্শন অজস্র ভুলে পরিপূর্ণ । তাই এই ত্রুটিপূর্ণ ভারতের বিজ্ঞান ও দর্শনের পরিবর্তে উন্নততর পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও সাহিত্য বা ইউরােপীয় জ্ঞান -বিজ্ঞান প্রচার সরকারি শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য।

2) ভাষা সম্পর্কে সুপারিশ : শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে কোন ভাষা ব্যবহার করা হবে সে সম্পর্কে উডের ডেসপ্যাচে বলা হয়, উচ্চশিক্ষার প্রধান মাধ্যম হবে ইংরেজি ভাষা মাধ্যমিক স্তরে ইংরেজি ও মাতৃভাষা এবং প্রাথমিক ও দেশীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাতৃভাষাকে মাধ্যম রূপে গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে দেশীয় ভাষা ও ইংরেজি ভাষাকে ইউরােপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রচারের জন্য ব্যবহার করার কথা উডের ডেসপ্যাচে নির্দেশ দেওয়া হযেছে।

3) শিক্ষাবিভাগ স্থাপন : উডের ডেসপ্যাচে কম্পানি অধিকৃত বাংলা, বােম্বাই, মাদ্রাজ, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব এই পাঁচটি প্রদেশে একটি করে শিক্ষা বিভাগ গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয। এই বিভাগের প্রধান হবেন একজন জনশিক্ষা আধিকারিক (Director of public Instruction)। তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষাদান সম্পর্কে যথােপযুক্ত পরামর্শ দেবেন। 

4) শিক্ষার কাঠামাে : বিশ্ববিদ্যালয় হবে শিক্ষার উচ্চতর স্তর। এর নিচে থাকবে বিশ্ববিদ্যালয় স্বীকৃত উচ্চ বিদ্যালয় সমূহ। উচ্চ বিদ্যালয়ের পড়া শেষ করার পর, প্রবেশিকা পরীক্ষা দিতে হবে এবং এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযােগ পাবে। প্রবেশিকা পরীক্ষার পাঠক্রম, পরীক্ষা গ্রহণ ও ডিগ্রী প্রদান বিশ্ববিদ্যালয় করবে। সর্ব নিম্ন স্তরে থাকবে প্রাথমিক ও দেশীয় শিক্ষার প্রতিষ্ঠান সমূহ।

5) বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন : ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা সম্পর্কে দেশবাসীর আগ্রহের কথা। বিবেচনা করে কলকাতা ও মুম্বাই শহরে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা প্রস্তাব করা হয়। মাদ্রাজ কিংবা ভারতের কোন এক স্থানে যদি উপযুক্ত সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা ও ডিগ্রি লাভের উপযুক্ত ছাত্র থাকে তবে সেখানেও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি গঠিত হবে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শে এবং এগুলির পাঠ্য বিষয় নির্ধারণ, শিক্ষার মান নির্ধারণ, পরীক্ষা গ্রহণ ও ডিগ্রী প্রদান করা হবে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মতাে। বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য সিনেট থাকবে। এতে একজন চ্যান্সেলর, একজন ভাইস চ্যান্সেলর ও একজন সরকারি মনােনীত সদস্য থাকবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আইন, চিকিৎসা বিদ্যা এবং ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে।

6) অনুদান প্রথা : উডের ডেসপ্যাচে আর্থিক সাহায্য বা অনুদান পাওয়ার কতগুলি শর্ত ছিল। সেগুলি হল– a) ধর্ম নিরপেক্ষ ভাবে সুষ্ঠু শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। b) স্থানীয়ভাবে শিক্ষা পরিচালনার ব্যবস্থা করতে হবে। c) সহকারী পরিদর্শন ব্যবস্থাকে মেনে নিতে হবে। d) ছাত্র দের কাছ থেকে সামান্য বেতন নিতে হবে।

7) জনশিক্ষা ব্যবস্থা : দেশের জনশিক্ষা এতােকাল অবহেলিত হয়েছে চুইয়ে পড়া নীতির নিন্দা করে বলা হয়েছে, গণ শিক্ষার ব্যবস্থা একা বেসরকারি প্রচেস্টার দ্বারা সম্ভব নয়। তাই দেশে জনশিক্ষার প্রচারের জন্য সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। দেশের নানা স্থানে বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। ছাত্রদের উৎসাহিত করার জন্য বৃত্তি দানের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশীয় বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষার মান উন্নত করতে হবে।

৪) শিক্ষক শিখন : প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের জন্য পৃথক পৃথক শিক্ষক শিখন প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলার সুপারিশ করা হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দান, শিক্ষকতা চাকুরীকে আকর্ষনীয় করে গড়ে তােলার কথা সুপারিশ করা হয়েছে। 

9) স্ত্রী শিক্ষার প্রসার : উডের ডেসপ্যাচে স্ত্রী শিক্ষার প্রতি সরকারকে অধিকতর দৃষ্টি দেওয়ার কথা বলা হযেছে। এছাড়াও বলা হয়েছে, মেয়েদের শিক্ষার জন্য অনুদানের ব্যবস্থা করতে হবে।

10) বৃত্তি শিক্ষা : উডের ডেসপ্যাচে বৃত্তি শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়। শুধুমাত্র সাহিত্য, দর্শনের মধ্যে শিক্ষাকে সীমাবদ্ধ না রেখে বৃত্তি শিক্ষার ওপরেও জোর দেওয়া হয়। এজন্য আইন, চিকিৎসা, ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভৃতি শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে পরিচালনার সুপারিশ করা হয়।

11) মুসলিমদের শিক্ষা : মুসলিম সম্প্রদায় ছিল শিক্ষা ক্ষেত্রে সব থেকে অনগ্রসর। তাদের পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা অবলম্বনের সুপারিশ করা হয়েছিল।

12) চাকুরীর ক্ষেত্র : উডের ডেসপ্যাচে উচ্চতর চাকরির ক্ষেত্রে ইংরেজি শিক্ষায় অগ্রাধিকার ও নিম্নতর চাকরির ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের নিয়ােগের নীতিকে সমর্থন জানানাে হয়। উডের ডেসপ্যাচে ভারতের শিক্ষার সর্বনিম্ন স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনাকে তুলে ধরা হযেছি। ডালহৌসি বলেছিলেন ভারতীয় শিক্ষার জন্য এইরূপ পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা এর আগে কখনাে হয়নি। তাই ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাসে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল।

আরো পড়ুন

মনোবিজ্ঞান কি | শিক্ষা ও মনোবিজ্ঞানের সম্পর্ক কি | Psychology in Bengali

কৈশোরকাল | কৈশোরকালের বিকাশগত বৈশিষ্ট্য, চাহিদা | Adolescence in Bengali

পরিনমন কি | পরিণমনের বৈশিষ্ট্য | শিক্ষা ক্ষেত্রে গুরুত্ব কি | Maturation in Bengali

মনোযোগ কাকে বলে | মনোযোগের প্রকৃতি গুলি কি কি | Attention in Bengali

শিখন কি | শিখনের বৈশিষ্ট্য | Characteristics of Learning in Bengali

Leave a Comment

error: Content is protected !!