সার্জেন্ট পরিকল্পনা (1944) | সার্জেন্ট পরিকল্পনার সুপারিশ | The Sargent Plan (1944) in Bengali

সার্জেন্ট পরিকল্পনা (1944) | সার্জেন্ট পরিকল্পনার সুপারিশ

উত্তর:

সার্জেন্ট পরিকল্পনা (1944)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে শিক্ষাব্যবস্থা যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করার জন্য ভারত সরকার যুদ্ধপরবর্তী কালে ভারতীয় শিক্ষার পুনর্গঠন এর উদ্দেশ্যে শিক্ষা উপদেষ্টা পর্ষদকে একটি শিক্ষা পরিকল্পনা রচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। 1944 সালে কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা পর্ষদ যুদ্ধপরবর্তী কালে শিক্ষার উন্নয়নের জন্য একটি খসড়া পরিকল্পনা রচনা করেন। ভারত সরকারের শিক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা স্যার জন সার্জেন্ট এর নাম অনুসারে এই পরিকল্পনা নাম হয় সার্জেন্ট পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনার লক্ষ্য হল সমাজের সকল স্তরের মানুষের দৈহিক উন্নতি, মানসিক ও মনস্তাত্বিক বিকাশ, নৈতিক উন্নতি এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি।

সার্জেন্ট পরিকল্পনা কোন নতুন শিক্ষা পরিকল্পনা নয়। 1917 সালের স্যাডলার কমিশনের সময় থেকে যে সমস্ত কমিটি ও কমিশন গঠিত হয়েছে তাদের সুপারিশ গুলির সমন্বয়ে এই পরিকল্পনা রচিত হয়। ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাস এরূপ সর্বাসিক শিক্ষা পরিকল্পনা এর আগে কখনাে রচিত হয়নি। দেশের সর্বস্তরের উপযােগী শিক্ষার কথা এই পরিকল্পনায় বলা হয়েছে।

সার্জেন্ট পরিকল্পনার সুপারিশ

a) প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা : 

i. 3-5 বছর বয়সের শিশুদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। 

ii. পল্লী অঞ্চলে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে বুনিয়াদি অথবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে। যুক্ত করতে হবে এবং শহরাঞ্চলে স্বতন্ত্রভাবে নার্সারি স্কুল স্থাপন করতে হবে। 

iii. নার্সারি স্কুলের শিক্ষার ভার মহিলাদের উপর থাকবে । 

iv. প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা হবে অবৈতনিক। 

v. এই স্তরে শিক্ষার লক্ষ্য হবে শিশুদের সামাজিক অভিজ্ঞতা দান করা। 

b) বুনিয়াদি শিক্ষা : 

i. 6 – 14 বছর বয়সের ছেলেমেয়েদের জন্য সার্বজনীন, বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক বুনিয়াদি শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। 

ii. বুনিয়াদি শিক্ষার দুটি স্তর থাকবে – 6 থেকে 11 বছর বয়স পর্যন্ত নিম্ন বুনিয়াদি শিক্ষা, 11 থেকে 14 বছর বয়স পর্যন্ত উচ্চ বুনিয়াদি শিক্ষা। এই স্তরে কাজের মধ্য দিয়ে শিক্ষার নীতি গ্রহণ করা হয়।

c) মাধ্যমিক শিক্ষা : 

i. 11 বয়সে শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নির্বাচনী পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলে ছাত্রছাত্রীরা গ্রামার স্কুলে (Grammar School) পড়তে যেতে পারবে। এই নির্বাচনী পরীক্ষা থাকার দরুন দরিদ্র ছেলে মেযেরা ও শিক্ষা লাভের সুযােগ পাবে। 

ii. মাধ্যমিক স্তরে উন্নত মানের কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এই কোষগুলির সময়সীমাও বাড়াতে হবে। 

iii. শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা। তবে ইংরেজিকে দ্বিতীয় ভাষা। হিসেবে বাধ্যতামূলক করা হল। 

iv. 5 থেকে 15 বছর বয়স পর্যন্ত শিক্ষা হবে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক।  

v. 13 বছর বয়সে একটি অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করা হবে। যারা অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী ছাত্র। ছাত্রী গ্রামার স্কুল থেকে কারিগরি অথবা মডার্ন স্কুলের স্থানান্তরিত করা অধিকার শিক্ষা কর্তৃপক্ষের থাকবে। 

vi. মডার্ন স্কুলগুলিতে এমন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে যাতে এই স্কুল থেকে উত্তীর্ণ ছেলে মেয়েরা নিজেদের রুজি রােজগারের ব্যবস্থা সহজে করতে পারে।

vii. 11 থেকে 17 বছর বয়সের শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই শিক্ষাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তুতিপর্ব বলে বিবেচনা করা যাবে না। মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য দুধরনের উচ্চ বিদ্যালয় থাকবে –

• বিশুদ্ধ কলা ও বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য একাডেমিক হাই স্কুল। 

• ফলিত বিজ্ঞান, শিল্প ও বাণিজ্য শিক্ষার জন্য টেকনিকেল হাই স্কুল থাকবে। 

d) উচ্চশিক্ষা : 

i. কেবলমাত্র মেধাবী ও যােগ্য ছাত্রছাত্রীরা উচ্চশিক্ষার সুযােগ পাবে। 

ii. মাধ্যমিক শিক্ষার শেষে অধিকাংশ শিক্ষার্থী যাতে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে তার জন্য বৃত্তি ও কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা থাকবে। 

iii. মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণের পর শতকরা 15 জন ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে পারবে।

iv. কলেজে তিন বছরের ডিগ্রী কোর্স চালু করতে হবে।

v. বিশ্ববিদ্যালয়ে কারিগরি শিক্ষা বিভাগে গবেষণার ব্যবস্থা করতে হবে।

vi. বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যাল্যগুলির কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধন করার জন্য ব্রিটেনের University Grants Commission এর অনুকরনে নিখিল ভারত সংস্থা গঠন। করার কথা বলা হয়। 

e) শিক্ষক শিখন :

সার্জেন্ট পরিকল্পনা শিক্ষক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য পরিবর্তন এনেছিল। এই সুপারিশে বলা হয় – 

i. বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে আলাদাভাবে

শিক্ষক-প্রশিক্ষণ বিভাগ খুলতে হবে এবং নতুন শিক্ষক-শিখন মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। 

ii. এই সব প্রতিষ্ঠানে কেবলমাত্র যারা স্নাতক তারাই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। এক বছরের জন্য। 

iii. যারা স্নাতক তাদের এক বছরের জন্য এবং যারা স্নাতক নন সেই সব শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দু’বছরের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

iv. ট্রেনিং কলেজে পড়াকালীন শিক্ষকদের কোনাে বেতন দিতে হবে না, সরকার অর্থ সাহায্য করবে এবং দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের যথাসম্ভব অর্থ সাহায্য করা হবে । 

f) স্বাস্থ্য পরীক্ষা:

আগে কেবলমাত্র Elementary School এ ছাত্র-ছাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু তার কোন বিজ্ঞান ভিত্তিক পদ্ধতি ছিল না। এই আইনের মাধ্যমে এ বিষয়ে কতগুলি নিয়ম নীতি চালু করা হল – 

i. প্রত্যেক শিক্ষার্থী স্বাস্থ্য পরীক্ষা আবশ্যিক করা হল। 

ii. স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের বিনা খরচায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। 

iii. শিক্ষার্থীদের মধ্যাহ্নভােজের দিকে ও পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহের দিকে লক্ষ্য রাখতে হব। যাতে শিক্ষার্থীদের পুষ্টির অভাব না হয়। 

iv. সাধারণ শারীরিক ত্রুটি নিবারনের জন্য বিদ্যালয়ে বিশেষ সরকারি ক্লিনিক থাকা প্রয়োজন। যা রােগ নিবারণ ও চিকিৎসার বিশেষ সহায়ক হবে। 

v. ছাত্র-ছাত্রীরা যাতে সরকারি সাহায্যের পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করে সে বিষয়ে তাদের উৎসাহিত করতে হবে।

g) স্থানীয় প্রশাসন :

এই আইনে শিক্ষা পরিচালনার জন্য দুটি কাউন্সিলকে দায়িত্ব দেওয়া হল – কান্ট্রি কাউন্সিল এবং জয়েন্ট কাউন্সিল। শিক্ষামন্ত্রী এই জয়েন্ট কাউন্সিল গঠন করবেন। প্রশাসনিক কাজ পরিচালনার জন্য Divisional Executive নিয়োগ করা হল।  যাদের কাজ হল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার বিষয় দেখাশােনা করা। স্থানীয় প্রশাসনের ক্ষমতা বাড়ানাে হল। তাদের কাজ হল – 

i. নিজ নিজ এলাকায় নাগরিকদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশ এর ব্যবস্থা করা। 

ii. নিজ এলাকার শিশুদের সুস্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করা।  তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। বিনামূল্যে মধ্যাহ্নভােজের ব্যবস্থা করা। 

i. দৈহিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা। 

iv. সামাজিক পরিবেশ এবং ।ছাত্র-ছাত্রীদের রুচি, সামর্থ্য ইত্যাদির উপর লক্ষ্য রেখে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করা। 

v. চাকুরীরত মহিলাদের শিক্ষার জন্য স্কুল খােলা।

h) বিদ্যালয় প্রশাসন:

বিদ্যালয়ের পরিকল্পনার ক্ষেত্রে এই আইনে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছিল – 

i. Elementary School এর সংস্থাকে বলা হল ইন্সট্রুমেন্ট ম্যানেজমেন্ট এবং Secondary School এর সংস্থাকে বলা হল ইন্সট্রুমেন্ট অফ গভর্মেন্ট। 

ii. লােকাল অথরিটিকে সংগঠনের নীতি নির্ধারণের অধিকার দেওয়া হল।

iii. Rules of Management এর মাধ্যমে এলেমেন্টারি স্কুল এবং Articles of Government এর মাধ্যমে সেকেন্ডারি স্কুল গুলি পরিচালনা করার কথা বলা হয়। 

iv. প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য নিয়ম পরিবর্তন করার দায়িত্ব Local Education Authority উপর থাকলেও এদের Minister of Articles of Government এর অনুমােদন লাভ করতে হবে। 

v. প্রত্যেক Regional ও Voluntary School এর জন্য কয়েকজন ম্যানেজারের একটা সংস্থা গঠন করা হল। এদের কাজ হল স্কুলগুলি ঠিকমতাে পরিচালনা হচ্ছে কিনা তা দেখা।

Leave a Comment

error: Content is protected !!