প্রাচীন ভারতের ভাষাতত্ত্ব চর্চায় পাণিনির অবদান | The Great Grammarian Panini in Bengali

প্রাচীন ভারতের ভাষাতত্ত্ব চর্চায় পাণিনির অবদান | The Great Grammarian Panini in Bengali

উত্তর:

প্রাচীন ভারতের ভাষাতত্ত্ব চর্চায় পাণিনির অবদান

প্রাচীন ভারতের ভাষাতত্বচর্চার কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় পাণিনির কথা। খ্রিঃ পূঃ পঞ্চম শতাব্দীতে রচিত ‘অষ্টাধ্যায়ী’ প্রাচীন ভারতের শ্রেষ্ঠ ব্যাকরণরূপে আজও বিবেচিত। উদিচ্য ও মধ্যদেশের মানুষের মুখের ভাষা কে গ্রহণ করেই পাণিনি অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন। সংস্কৃত ভাষাকে কেন্দ্র করে তিনি যেভাবে ভারতবর্ষে তথা সমগ্র পৃথিবীতে ‘বর্ণনামূলক’ ভাষাবিজ্ঞানের জন্ম দিয়েছিলেন, তার স্বীকৃতি আধুনিক যুগে পাশ্চাত্যের ভাষাবিজ্ঞানীরা স্বীকার করেছেন। তাঁর আমলেই প্রাচীন ভারত ভাষাবিজ্ঞানচর্চায় উচ্চ শিখরে উঠেছিল।

পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণ’ আটটি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রত্যেকটি অধ্যায়ে চারটি পদ আছে। এই ব্যাকরণের প্রথম অধ্যায়ে আছে অনেকগুলি সংজ্ঞার ব্যাখ্যা ও পরিভাষায় পরবর্তী অধ্যায়সমূহের সূত্রগুলি ব্যাখ্যার নিয়মের আলোচনা। দ্বিতীয় অধ্যায়ে সমাস, কারক ও বিভক্তি নিয়ে আলোচনা আছে। তৃতীয় অধ্যায়ে কৃৎ প্রত্যয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায়ে তদ্ধিত প্রতায়, ষষ্ঠ ও সপ্তম অধ্যায়ে স্বরাঘাত ও ধ্বনি পরিবর্তনের নিয়ম নীতির আলোচনা আছে এবং অষ্টম বা শেষ অধ্যায়ে স্বরাঘাতবিধি ও সন্ধির নিয়ম আলোচিত হয়েছে।

তাঁর ব্যাকরণে চার হাজার সূত্র আছে মোট আটটি অধ্যায়ে। এর মধ্যে আড়াই হাজার সূত্র পাণিনির নিজের। আর বাকি দেড় হাজার কাত্যায়নের ‘বার্তিক সূত্র’। এই সূত্রগুলিকে সাতটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা- (১) সংজ্ঞা (definition) (২) পরিভাষা (Interpretation) (৩) বিধি (general rule) (৪) বিশেষ নিয়ম (particular rule) (৫) অপবাদ (exception) (৬) অধিকার (governing rule) (৭) অভিদেশ (extertion rule)। সুত্রগুলির নির্মাণ কৌশলে ও বিন্যাসে ব্যাকরণটি সংক্ষিপ্ত ও সংহত হয়েছে। অষ্টাধ্যায়ীতে যে সব সুত্র আমিছে তার মধ্যে কতকগুলি প্রধান সূত্র (Main laws) এবং কতগুলি উপসুত্র (Sub laws ) আছে। অধিকার সুত্রগুলি, উপসূত্রগুলিকে পরিচালনা নিয়ন্ত্রণ করে। তবে প্রত্যেকটি উপসুত্রের সঙ্গে প্রধান সূত্র গুলি পাঠ্য হিসেবে যুক্ত।

পাণিনির ব্যাকরণে সংক্ষিপ্ততা সাধনের জন্য একটা কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। সেটা হল ব্যবহৃত সূত্রগুলির মধ্যে অনেকক্ষেত্রে পুরো বাক্য ব্যবহার না করে শুধু কতগুলি বর্ণের সাহায্যে সংক্ষেপে বীজগণিতের সূত্রের মতো প্রতীকধর্মী সূত্র রচিত হয়েছে। কিন্তু এই সুত্রগুলি সংক্ষিপ্ত। ফলে সংক্ষিপ্ততার জন্য শিক্ষার্থীর কাছে এগুলি অর্থহীন ধ্বনিসমষ্টি (non-sense sound) বলে প্রতিভাত হয়।

পাণিনির ব্যাকরণ চিন্তার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গণবিভাগ। মূল বিষয়টুকু তিনি ‘অষ্টাধ্যায়ী’ অধ্যায়ে উল্লেখ করে ‘গণপাঠ’ গ্রন্থে তার বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। যে সব ধাতু একই রকম নিয়ম অনুসরণ করেও একই রকম ক্রিয়ারূপ লাভ করে সেগুলিকে তিনি একটি গণে বিন্যস্ত করেছেন। সংস্কৃতের সব ধাতুকে ১০টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন—যে সব ধাতুর রূপ ‘ভূ’ ধাতুর মতো তাদের জ্বাদিগণীয় বলা হয়েছে। ‘তুদ’ ধাতুর মতো হলে ‘তুদাদিগিণীয়’ বলা হয়েছে।

পাণিনি বাক্যকে ভাষার প্রথম বৃহত্তম একক রূপে (Unit) গ্রহণ করে বিশ্লেষণ করেছেন। এবং বাক্যকে ক্রমশ ক্ষুদ্রতর এককের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তিনি বাক্যের বিভিন্ন অংশকে ‘পদ’ বলেছেন। পদের মধ্যে বিভিন্ন অংশ জুড়ে আছে ক্রিয়া। এই ক্রিয়ার মূল অংশ হল ধাতু। তবে পাণিনি ক্রিয়া ছাড়া নামশব্দের বিশ্লেষণে ও তার মূলেও ধাতুই পেয়েছেন। পাণিনির মতে সব শব্দই এমনকী নামশব্দ ধাতু থেকেই নিষ্পন্ন। পাণিনির এই তত্ত্বকে ভাষাতত্ত্ববিদরা “root theory” বলেছেন।

পাণিনির বিন্যাসরীতি অপূর্ব। যেমন আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে রূপতত্ত্বের আলোচ্য বিষয় হল কৃৎ প্রত্যয়। কিন্তু কৃৎ প্রত্যয় আলোচনার সাথে সাথে তৃতীয় অধ্যায়ে পাণিনি স্বরাঘাতের আলোচনাও করেছেন। কিন্তু এই স্বরাঘাত রূপতত্ত্বের নয়, ধ্বনিতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়। কিন্তু পাণিনি রূপতত্ত্বের সাথে ধ্বনিতত্ত্বের কিছু আলোচনাও সেরে নিয়েছেন। আবার সন্ধি রূপতত্ত্বের বিষয় না হলেও তিনি রূপতত্ত্বের বিভিন্ন প্রসঙ্গের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। অনেকে এটিকে ত্রুটিপূর্ণ মনে করেছেন। কিন্তু পাণিনির মতে বিষয় বিন্যাসের নিজস্ব রীতি এটি।

পাণিনি পৃথিবীর প্রথম এককালিক বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানী। কারণ তিনি সংস্কৃত ভাষার এককালের রূপ বিশ্লেষণ করলেও ওই ভাষার বিভিন্ন কালের বিবর্তনের ইতিহাস আলোচনা করেননি। তিনি শুধু ভাষায় গঠনের ওপর ভিত্তি করে পদের সংজ্ঞা দিয়েছেন। আবার পদ কি নিয়ে গঠিত, তা উল্লেখ করেছেন। তবে পদের অর্থ বা ভাবের প্রসঙ্গ তিনি আনেননি। এজন্য তাকে গঠন সর্বস্বতাবাদী ভাষাবিজ্ঞানী বলা হয়। তবে অনেকক্ষেত্রে পদের অর্থের সাহায্য নিয়েও সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন— পূর্বপদের অর্থ প্রধানরূপে প্রতিয়মান হয় যে সমাসে তাকে অব্যয়ীভাব সমাস বলা হয়। আবার তৎপুরুষ সমাসের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে—উত্তরপদের অর্থ প্রধানরূপে প্রতীয়মান হলে তৎপুরুষ সমাস হবে। এখানে অর্থের সাহায্য নিয়ে সংজ্ঞা রচনা করা হয়েছে। আসলে তিনি ভাষার অর্থের ওপর যেমন গুরুত্ব দিয়েছেন তেমনি গঠনের ওপরেও। তবে পাণিনিকে গঠনসর্বস্বতাবাদী নিঃসন্দেহে বলা না গেলেও নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তিনি বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানী শুধু প্রাচীন ভারতের নয়— পাণিনি সারা পৃথিবীর প্রথম বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানী। ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানীরা (যেমন ড. সত্যস্বরূপ মিশ্র) স্বীকার করেছেন বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানে সংস্কৃতে তাঁর অবদানকে—”the first descriptive grammar of language, being the sanskrit grammar of Panini…”.

— এছাড়া পাশ্চাত্যের ভাষাবিজ্ঞানীরা পাণিনিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছেন যে পাণিনির ব্যাকরণ মানব মনীবার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তিভয়। পাশ্চাত্য দেশে পাণিনির ব্যাকরণের একটা সংস্করণ বের করেন এই সংস্করণ শুধু পাশ্চাত্য দেশের বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানীদের ওপরই পড়েনি, আধুনিক রূপান্তরমূলক সৃজনমূলক ভাষাবিজ্ঞানী চমস্কির ওপরও পরেছে। পাণিনির ব্যাকরণে চমস্কির ‘Deep Structure’ ও ‘Surface Structure’-এর তত্ত্ব দেখেছেন অনেকেই। সুতরাং সব মিলিয়ে বলা যায় সারা বিশ্বের ভাষাতত্বের ইতিহাসে মহামনীষী পাণিনি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক।

আরো পড়ুন

বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে শ্রীরামপুর মিশনের অবদান আলোচনা করো

বাংলা নাট্য সাহিত্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদান আলোচনা করো

বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবদান

বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করো

বাংলা নাট্য সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো

Leave a Comment

error: Content is protected !!