স্যাডলার কমিশন (Sadler Commission) | স্যাডলার কমিশনের সুপারিশ
উত্তর:
স্যাডলার কমিশন (Sadler Commission)
লর্ড কার্জনের বিশ্ববিদ্যালয় আইন গৃহীত হওয়ার দশ বছর না হতে হতেই ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কার্জনের শিক্ষা আইনের মাধ্যমে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক উন্নতি হলেও কিছু সমস্যার উদ্ভব হয়। এছাড়াও শিক্ষণধর্মী বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তােলার সাফল্যজনক প্রচেষ্টা তখনাে হয়নি। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রয়োজনীয়তাও তীব্রভাবে দেখা দিয়েছিল।
1906 সালে স্যার আশুতােষ মুখােপাধ্যায় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার সকল স্তরের উন্নয়নে আত্মনিয়ােগ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান, কর্মসূচি ইত্যাদি বিষয়ে নানা সমস্যা দেখা দেয়। 1913 সালে ভারত সরকারের শিক্ষা বিষয়ক প্রস্তাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের জন্য কিছু সুপারিশ করা হয়। সমগ্র ভারতে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় ও 185 টি কলেজ উচ্চ শিক্ষার প্রসারের পক্ষে যথেষ্ট নয়।
অর্থাৎ, পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। এই সুপারিশ গুলি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ না করা পর্যন্ত সুপারিশ গুলি কার্যকর হবে না বলে স্থির হয়।
1914 খ্রিস্টাব্দে লর্ড হােলডেন এর নেতৃত্বে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সংস্কারের জন্য রয়েল কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু সেই সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় লর্ড হােলডেন ভারতে আসতে রাজি হননি, ফলে শিক্ষা সংস্কারের সব চেষ্টাই সাময়িকভাবে স্থগিত হয়ে যায়।
1917 খ্রিস্টাব্দে বিশ্বযুদ্ধের অবস্থা অনেকটা পরিবর্তিত হওয়ায় ওই বছরই ভারত সরকার লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার মাইকেল স্যাডলারকে সভাপতি করে ‘স্যাডলার কমিশন’ গঠন করা হয়। এই কমিশন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন নামেও পরিচিত। এই কমিশনের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন স্যার আশুতােষ মুখােপাধ্যায়, স্যার জিয়াউদ্দিন আহমেদ, J. W. Gregory, Ramsay Muir, স্যার ফিলিপ হার্টগ। অনেকে মনে করেন এই কমিশন স্যার আশুতােষ মুখােপাধ্যায়ের মতামত দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।
স্যাডলার কমিশনের সুপারিশ
কমিশনের সদস্যরা বিভিন্ন আলাপ আলােচনা করে 1919 সালে একটি রিপাের্ট প্রকাশ করেন। ভারতের শিক্ষা সম্পর্কে সুদীর্ঘ ও প্রয়োজনীয় রিপাের্ট এর আগে কখনাে তৈরি হয়নি।
a) মাধ্যমিক শিক্ষা:
কমিশনের রিপাের্টে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পর্কে অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে আলােচনা করা হয়। কমিশনের মতে উন্নত মাধ্যমিক শিক্ষার উপর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নির্ভর করে। মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার না করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সংস্কার সার্থক হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার সাফল্য মাধ্যমিক শিক্ষার ওপর নির্ভরশীল। এইদিকে দৃষ্টি রেখে কমিশন মাধ্যমিক শিক্ষার কতগুলি ত্রুটি উল্লেখ করেন। সেগুলি হল –
i. মাধ্যমিক শিক্ষার মান অত্যন্ত নিম্নমানের।
ii. শিক্ষার উন্নতির জন্য প্রয়ােজনীয় অর্থের অভাব। এর জন্য সরকারি তহবিল থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা খাতে বার্ষিক অতিরিক্ত 40 লক্ষ্য টাকা ব্যয় করার সুপারিশ করা হয়।
iii. পরীক্ষা ব্যবস্থায় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের উপর বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ।
iv. বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমের দিকে লক্ষ্য রেখে মাধ্যমিক স্তরে পাঠক্রম রচনা করার ফল বৈচিত্রহীন একমুখী পাঠক্রম।
v. মাধ্যমিক স্তরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ কলেজে পড়ানাে।
vi. উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব।
b) সেকেন্ডারি বা ইন্টারমিডিয়েট শিক্ষা :
i. মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নতির জন্য কমিশন প্রস্তাব করেন, যেহেতু কলেজের প্রথম দুই বছরের পাঠ অনেকাংশে মাধ্যমিক শিক্ষার অনুরুপ তাই এই অংশটুকু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাদ দিয়ে মাধ্যমিক শিক্ষার সঙ্গে জুড়ে দিতে হবে। এই দুই বছরের শিক্ষার নাম হবে ইন্টারমিডিযেট শিক্ষা।
ii. ইন্টারমিডিয়েট শিক্ষার জন্য পৃথক কলেজ স্থাপন করতে হবে। মাধ্যমিক স্তর অতিক্রম করার পর এই ইন্টারমিডিয়েট স্তরে উত্তীর্ণ হতে হবে তবেই কলেজে প্রবেশ করা যাবে।
iii. মাধ্যমিক পরীক্ষা দুটি স্তরে গৃহীত হবে। মাধ্যমিক স্তরের পাঠের পর মেট্রিকুলেশন এবং ইন্টারমিডিয়েট স্তরে পাঠের পর বহির মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে হবে। ইন্টারমিডিয়েট শ্রেণীর শিক্ষাদানের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে থাকবে না এজন্য ইন্টারমিডিয়েট কলেজ স্থাপন করা হবে।
iv. ইন্টারমিডিয়েট স্তরে কলা, বাণিজ্য, বিজ্ঞান, কৃষ্টি, শিক্ষাতত্ব, চিকিৎসা, ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভৃতি বিষয় রাখার সুপারিশ করা হয়।
v. মাধ্যমিক, ইন্টারমিডিয়েট এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য কলেজ ও জনসাধারণের প্রতিনিধি নিয়ে পৃথক বাের্ড গঠিত হবে। এর অধিকাংশ সদস্য নির্বাচিত হবে বেসরকারী সংস্থার মাধ্যমে। এই বাের্ড একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে এবং এই বাের্ডে হিন্দু এবং মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি থাকবে।
vii. মাতৃভাষাকেই মাধ্যমিক শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হবে।
C) উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের শিক্ষা :
i. বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা সংস্কার সম্পর্কে কমিশন প্রস্তাব করেন স্নাতক কোর্স দু বছরের পরিবর্তে তিন বছর করা হবে।
ii. কলেজের সংখ্যা ও ছাত্রের সংখ্যা এত বেশি যে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে সমস্ত কলেজকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। মাধ্যমিক ও ইন্টারমিডিয়েট শিক্ষার দায়িত্ব থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে অব্যাহতি দিতে হবে। শুধুমাত্র উচ্চশিক্ষার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রকৃত শিক্ষা কেন্দ্রে পরিণত করা সম্ভব।
iii. স্নাতক স্তরের কোর্স মূলত সাহিত্য ধর্মী ও তত্বগত। কারিগরি ও বৃত্তিদানের কোন ব্যবস্থা নেই। তাই স্নাতক স্তরে বিভিন্ন ধরনের কারিগরি ও বৃত্তি শিক্ষার প্রবর্তন করতে হবে।
iv. স্নাতক স্তরে পাস কোর্সের পাশাপাশি অনার্স কোর্সের প্রবর্তন করতে হবে। পাস ও অনার্স কোর্সে ভারতীয় আধুনিক ভাষা পঠন-পাঠনের সুযােগ সৃষ্টি করতে হবে।
v. ভারতীয় ভাষা চর্চাকে উৎসাহিত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ভাষায় অধ্যাপক নিয়ােগের ব্যবস্থা করতে হবে। কলেজে টিউটোরিয়াল ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে।
vi. বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম, পঠন-পাঠন ব্যবস্থা একমুখী। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কেরানি সৃষ্টির কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। তাই দেশের উন্নতির জন্য, শিল্প ও সমৃদ্ধির জন্য বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ এর দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়কেই নিতে হবে।
vii. কলেজে শিক্ষকদের বেতন খুব কম হওয়ার এবং চাকরির কোন নিরাপত্তা না থাকায়, কোন যােগ্য ব্যক্তি চাকরি গ্রহণ করতে চান না। তাই প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষণের জন্য একটি শিক্ষাবিভাগ (Education Department) স্থাপনের পরামর্শ দেওয়া হয় ।
viii. কমিশন পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কারের সুপারিশ করেন। B.A. এবং I.A. পরীক্ষায় শিক্ষা একটি বিষয় হিসেবে গ্রহণ করা হবে।
ix. বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিক কাজকর্মে জর্জরিত। অনুমােদন দান ও পরীক্ষা গ্রহণ নিয়ে সর্বদা ব্যস্ত থাকে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কানুন ও সরকারি হস্তক্ষেপের পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় গুলি যাতে সরকারি বিভাগে রূপান্তরিত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে এবং একাডেমি বিষয়ের দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপর দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
x. প্রয়ােজন অনুসারে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ওপর গুরুত্ব আরােপ করতে হবে।
xi. কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে এমনভাবে সংস্কার করতে হবে যাতে এটি একটি প্রকৃত শিক্ষণ ধর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। গ্রামাঞ্চলের কলেজ গুলিকে এমন ভাবে উন্নত করতে হবে যাতে এগুলি এক একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যাল্য রূপে গড়ে উঠতে পারে।
xii. ছাত্র-ছাত্রীদের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য Director of Physical Education নিয়োগ ও ছাত্রমঙ্গল সংস্থা স্থাপনের সুপারিশ করা হয়।
xiii. মেয়েদের শিক্ষার জন্য একটি বিশেষ বাের্ড স্থাপনের কথা বলা হয়। 15-16 বছরের মেয়েদের জন্য স্কুল স্থাপনের সুপারিশ করা হয়।
xiv. কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পরিচালন ব্যবস্থায় যাতে অধিকতর প্রাধান্য পান সেজন্য পরিচালন সমিতি গুলিতে তাদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানাের সুপারিশ করা হয়।
xv. অধ্যাপক নিয়ােগ, পাঠক্রম নির্ধারণ, পরীক্ষাগ্রহণ, ডিগ্রী বিতরণ প্রভৃতি শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয় গুলি পরিচালনার জন্য একটি একাডেমিক কাউন্সিল গঠন এবং বিভিন্ন বিষয়ের জন্য Faculty and Board of studies গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়।
xvi. প্রশাসনিক কাড়াকড়ি কম করার জন্য ও সিন্ডিকেট এর পরিবর্তে ব্যাপক প্রতিনিধিত্বমূলক কোর্ট (Court) এবং ক্ষুদ্র কার্যকারী সমিতি (Small Executive Committee) গঠনের সুপারিশ করা হয়।
xvii. প্রতিটি বিষয়ের জন্য স্নাতকোত্তর স্তরে বিষয় বিভাগ (Department) স্থাপন ও বিভাগীয় প্রধান (Department Head) নিয়ােগ করতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একজন পূর্ণ সময়ের বেতনভুক্ত উপাচার্য (Vice chancellor) নিয়ােগের সুপারিশ করা হয়।
xviii. কমিশন ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কর্মসূচির মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য একটি অন্তবিশ্ববিদ্যালয় বাের্ড (Inter University Board) এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয় চাকুরী কমিশন (University Service Commission) গঠন করার সুপারিশ করা হয়।
আরো পড়ুন
উডের ডেসপ্যাচ (1854) | 1854 সালে উডের ডেসপ্যাচ এর সুপারিশ | Wood’s Despatch in Bengali
প্রকৃতিবাদ কাকে বলে | শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকৃতিবাদী দর্শনের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করো
সনদ আইন (1813) | সনদ আইনের উদ্দেশ্য | সনদ আইনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
শিক্ষা মনােবিজ্ঞানের প্রকৃতি আলোচনা করো | Nature of Educational Psychology in Bengali