শিক্ষার সঙ্গে দর্শনের সম্পর্ক আলোচনা করো

Q: শিক্ষার সঙ্গে দর্শনের সম্পর্ক আলোচনা করো ।
Q: শিক্ষা ও দর্শনের সম্পর্ক আলোচনা করো।
Q: দর্শন শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ কি ? 
Q: শিক্ষার বুৎপত্তিগত অর্থ কি ? 

Ans:

দর্শন কি ? 

দর্শন হল এমন একটি বিষয় যা জীবন ও জগত সম্পর্কিত সমস্ত প্রশ্ন ও তার উত্তর খুঁজে পেতে সহায়তা করে। 

দর্শন শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ কি ? 

দর্শন শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হল philosophy। এটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘philos’ এবং ‘sophia’ থেকে ‘Philos’ শব্দের অর্থ হল ‘অনুরাগ’ বা ‘ভালােবাসা’ (Loving) এবং ‘sophia’ শব্দের অর্থ ‘জ্ঞান’ বা ‘প্রজ্ঞা’ (knowledge বা wisdom)। অর্থাৎ, Philosophy শব্দের অর্থ হল ‘জ্ঞান বা প্রজ্ঞার প্রতি অনুরাগ বা ভালবাসা’। আবার, দর্শন শব্দটি সংস্কৃত ‘দৃশ’ ধাতু থেকে এসেছে যার অর্থ হল দেখা। কিন্তু এখানে দর্শন শব্দটি তত্ব দর্শন – জগৎ ও জীবের স্বরূপ উপলব্ধি করা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সত্যের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি বা তার সাক্ষৎকারই দর্শন। সেই কারণে ভারতীয় দৃষ্টিতে যার সত্যের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি হয়েছে, যার তত্ব সাক্ষাৎকার ঘটেছে, যিনি এই বিশ্বজগত ও জীবনের স্বরূপ জেনেছেন তিনিই দার্শনিক।

শিক্ষা কি ? 

শিক্ষা হল এমন একটি প্রক্রিয়া যা ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ গুণাবলীর পরিপূর্ণ বিকাশে সহায়তা করে, কুসংস্কারমুক্ত করে, উদার করে, মার্জিত করে, পরিবর্তনশীল পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। এককথায় দায়িত্বশীল সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তােলে। 

শিক্ষার বুৎপত্তিগত অর্থ 

শিক্ষা শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃত শাস্’ ধাতু থেকে। যার অর্থ হল শাসন করা, নিয়ন্ত্রণ করা এবং নির্দেশ দান করা। শিক্ষা শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ ‘বিদ্যা’। বিদ্যা শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘বি’ ধাতু থেকে। যার অর্থ হল জ্ঞান অর্জন করা বা জানা। শিক্ষা শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Education। ‘Education’ শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ভাষাবিদগণ চারটি ধারণা প্রকাশ করেছেন।

শিক্ষার সঙ্গে দর্শনের সম্পর্ক 

শিক্ষা ও দর্শন অত্যন্ত নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। এরা পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। একই মুদ্রার দুই পিঠ। দর্শনকে বাদ দিয়ে যেমন শিক্ষা গড়ে উঠতে পারেনা, তেমনি শিক্ষা ছাড়া দর্শনের পাণ্ডিত্য বা জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। দার্শনিক মাত্রই সত্যানুসন্ধানী ও জ্ঞান অনুসন্ধানী। আর যেকোনাে ধরনের জ্ঞান অর্জন করতে হলে শিক্ষার প্রযােজন। যেকোনাে শিক্ষাব্যবস্থার ভিত মূলত দার্শনিক চিন্তা ভাবনার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। শিক্ষা সম্পর্কিত যাবতীয় সমস্যা ও তার সমাধান করতে সাহায্য করে দর্শন। শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখা, সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করা, শিক্ষার নতুন নতুন দিক আবিস্কার করা, শ্রেণিকক্ষের বিভিন্ন সমস্যা যেমন – শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, নির্দেশদান, কৌশল, শিক্ষা পরিচালনা উদ্দেশ্য ও কার্যকারিতা ইত্যাদি বিষয়গুলি ও দর্শনের সাথে যুক্ত। এমনকি শিক্ষণ – শিখন পদ্ধতি ও কৌশল আবিষ্কার করা হয় দার্শনিক পদ্ধতি প্রযােগ করে। শিক্ষা হল ব্যক্তির সুপ্ত সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে বাস্তবমুখী করার সামগ্রিক প্রক্রিয়া। আর দর্শনের কাজ হল বাস্তবমুখী চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটানাে। সুতরাং শিক্ষা এবং দর্শন পরস্পর পরস্পরের সম্পর্কযুক্ত। একটিকে বাদ দিলে অপরটি অর্থহীন।

শিক্ষা ও দর্শন যে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত সে সম্পর্কে বিভিন্ন চিন্তাবিদগণ বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন | সেগুলি হল – John Dewy এর মতে, দর্শন হল সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি সমন্বিত শিক্ষার একটি তত্ববিশেষ (Philosophy is generalised theory of education)। তিনি মনে করেন যে শিক্ষা হল একটি গবেষণাগার যেখানে দর্শনের তত্বগুলির যাচাই করা হয়ে থাকে। John Adams বলেছেন, শিক্ষা হল দর্শনের গভীর অভিব্যক্তি (Education is the dynamic side of philosophy) James Francis Ross বলেছেন, দর্শন ও শিক্ষা হল একিই মুদ্রার দুই দিক, প্রথমটি হল ধ্যানের দিক শেষটি হল কর্মের দিক। (Philosophy and Education are the two sides of a coin, the former is the contemplative side while the later is the active side) সুতরাং, এই আলােচনা থেকে বলা যায় দর্শন এবং শিক্ষা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। প্রকৃতপক্ষে দার্শনিক সত্যগুলির প্রতিষ্ঠা, প্রসার ও স্থায়িত্ব লাভ করেছে শিক্ষার মধ্য দিয়ে। তাই শিক্ষা ছাড়া দর্শনের কোন ব্যবহারিক উপযােগিতা নেই। আর দর্শন ছাড়া শিক্ষার অস্তিত্ব থাকতে পারে না।

শিক্ষা ও দর্শন যে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত তার কতগুলি দিক নিচে আলােচনা করা হল – 

1) জীবনের গতি নির্ধারণে: মানব জীবনের গতি প্রকৃতি নির্ধারণ করা দর্শন ও শিক্ষার কাজ। শিক্ষার উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীর সুপ্ত সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তােলা। আর দর্শনের কাজ হল আধুনিক বাস্তবধর্মী শিক্ষার মাধ্যমে জীবনের যথার্থ গতি সৃষ্টি করা। যার মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণ সাধিত হয়।

2) মুক্তচিন্তার বিকাশ সাধন: দর্শন মানুষের চিন্তার বিকাশ ঘটায় আর শিক্ষা ব্যাক্তির মুক্তচিন্তাকে বাস্তবে রূপদান করে। কাজেই দর্শন ও শিক্ষা উভয়ই ব্যাক্তিকে মানব উন্নয়নে সহায়তা করে। জন ডিউই বলেছেন, Life is a by product activities and education is born out of those activities. অর্থাৎ, যে সক্রিয়তার মাধ্যমে ব্যাক্তি তার জীবনের প্রয়ােজন মেটাচ্ছে, সেই প্রক্রিয়াই তার শিক্ষার কাজে সহায়তা করছে।

3) ব্যক্তি চেতনার উন্নয়ন: দর্শন ব্যক্তি চেতনাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে, যার প্রভাব শিক্ষাক্ষেত্রে পড়ে। মানবীয় চেতনা যেদিকে প্রভাবিত হয়, ব্যক্তির শিক্ষাও সেই দিকে ধাবিত হয়। কাজেই ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের ব্যাক্তি চেতনার প্রয়োগে দর্শনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। (The art of education will never attain complete clearness without philosophy) অর্থাৎ, শিক্ষা শিল্প, দর্শন ছাড়া কখনই সম্পূর্ণতা পেতে পারে না।

4) শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণ: শিক্ষার একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য রযেছে। লক্ষ্য ছাড়া শিক্ষা অর্থহীন। শিক্ষার লক্ষ্য নির্ভর করে চিরাচরিত ও সমসাময়িক জীবন দর্শনের উপর। তাই যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে শিক্ষার লক্ষ্যেরও পরিবর্তন হচ্ছে। শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারিত হয় দার্শনিক চিন্তা ধারার ওপর ভিত্তি করে অভিজ্ঞতা যদি শিক্ষামূলক হয় তবে শিক্ষাক্রমকে অবশ্যই দার্শনিক চিন্তা ভাবনার অনুসারী হতে হবে। (If experience is to be educative, action must be supplemented by reflection) 

5) পাঠক্রম নির্ধারণ: শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণের পর কিভাবে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানাে হবে পাঠক্রম হল সেই লক্ষ্য অভিমুখী পথ। লক্ষ্য পূরণের বিষয়বস্তু ও ক্রিয়াকলাপ নির্দেশ করে এই পাঠক্রম। পাঠক্রম নির্বাচনের ক্ষেত্রে দার্শনিকদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। দর্শনই জীবনের প্রয়ােজনীয়তা ও চাহিদার ওপর ভিত্তি করে পাঠক্রমের গতি প্রকৃতি ও বৈচিত্র্যতা নির্ধারণ করে। শিশুর মধ্যে কোন কোন ক্ষেত্রে কর্মক্ষমতার বিকাশ ঘটানাের দরকার তা নির্ধারণ করে দর্শন। দর্শন হল একটি কাঠামাে যার ওপর ভিত্তি করে শিক্ষা সৌধ গড়ে উঠেছে। 

6) মূল্যবােধের বিকাশ: দর্শন হল জীবনের মৌলিক মূল্যবােধের গবেষণাগার। আর শিক্ষা এই গবেষণার ফলাফলকে বাস্তবায়ন করে জীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে গড়ে তােলে। দর্শন শিক্ষাকে গতিশীল করে রাখতে সহায়তা করে। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন, “The unexamined life is not worth living.” অর্থাৎ, অপরীক্ষিত জীবন যাপন করার কোনাে মূল্য নেই। তিনি জগতের সমস্ত কিছুকে পরীক্ষা করেছিলেন। সমস্ত কিছুকে অনুসন্ধান করেছিলেন। তার কাছে দর্শন হল জীবনকে পরীক্ষা করা। 

7) শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি নির্ধারণ: শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি হল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিশুর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি। আধুনিক শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক নতুন নতুন শিক্ষণ পদ্ধতি, শিক্ষা সহায়ক উপকরণ ব্যবহার করা হয়। দার্শনিকগণ শিক্ষার লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই শিক্ষণ পদ্ধতিগুলি কেন এবং কিভাবে প্রযােগ করা হবে তার প্রাথমিক জ্ঞান দান করে। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি প্রণয়ন ও তার ব্যবহার দর্শন দ্বারা প্রভাবিত। 

8) মূল্যায়ন: শিক্ষাক্ষেত্রে মূল্যায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিক্ষার লক্ষ্য স্থির করার পর শিক্ষার সঠিক পথে অগ্রগতি হচ্ছে কিনা তা যাচাই করার জন্য মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ, শিক্ষার লক্ষ্যের পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যায়ন করা হযে থাকে। শিক্ষার লক্ষ্য যেহেতু দার্শনিক চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত, সেহেতু সমগ্র মূল্যায়ন প্রক্রিয়াটিও দর্শন দ্বারা প্রভাবিত। সুতরাং, এই আলােচনা থেকে বলা যায় শিক্ষা এবং দর্শন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। শিক্ষা ও দর্শন হল জীবন প্রবাহের দুটি দিক একটি ব্যবহারিক এবং অপরটির হল তাত্বিক। উভয়েরই লক্ষ্য একই। শিক্ষা সবসময় জীবন কেন্দ্রিক। অপরদিকে দর্শনও জীবন কেন্দ্রিক। জীবনকে বাদ দিয়ে কোন দর্শন হয় না। তাই ব্যক্তিজীবনকে কেন্দ্র করেই শিক্ষা ও দর্শনের উদ্ভব উভয়ে।

আরো পড়ুন

প্রেষণা কি | প্রেষণার সংজ্ঞা দাও | প্রেষণার বৈশিষ্ট্য

বুদ্ধি কি | বুদ্ধির সংজ্ঞা দাও | বুদ্ধির কাজ কি | বুদ্ধির বৈশিষ্ট্য কি

শিক্ষন ও শিখনের মধ্যে পার্থক্য লেখো

শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো

গিলফোর্ডের SOI মডেল বা বুদ্ধির ত্রিমাত্রিক তত্ত্ব

Class 7 Geography 3rd Unit Test Question Paper 2022 PDF

Leave a Comment

error: Content is protected !!