মার্কসবাদ কাকে বলে | মার্কসবাদের মূলনীতি আলোচনা কর

মার্কসবাদ কাকে বলে । মার্কসবাদের মূলনীতি আলোচনা কর ।
মার্কসবাদের মূল সূত্র গুলি সংক্ষেপে আলোচনা কর ।
মার্কসবাদের মূলনীতি গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো ।

উত্তর:

মার্কসবাদ

মার্কসবাদ (Marxism) } উনবিংশ শতাব্দীর দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক ও বিপ্লবী কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের তত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক অনুশীলন ও সামাজিক তত্বই হল মার্কসবাদ । এঙ্গেলস

মার্কসবাদ শব্দটি প্রথম ব্যবহার শুরু করেছিলেন। মার্কসবাদ হল একটি সামগ্রিক চিন্তাধারা ও একটি সঠিক সমাজ দর্শন। শিল্প বিপ্লবের ফলে ইউরােপীয় দেশ গুলির মালিক শ্রেণি তথা বুর্জোয়া শ্রেণির ক্ষমতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছিল অথচ তাদের দেশের শ্রমিকরাই শােষিত, নির্যাতিত, ও নিপীড়িত। কাল মার্কসের মতে সমাজের এই নানা শ্রেণীর বৈষম্যের কারণ হল উৎপাদন ব্যবস্থার বৈচিত্র। মার্কসের মূল উদ্দেশ্য হল অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে সমতা ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। তাই কাল মার্কসকে সর্বশ্রেষ্ঠ অর্থনৈতিক নিবিজ্ঞানী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি হচ্ছে উৎপাদনের উপর সামাজিক মালিকানা।

সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে উৎপাদনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যক্তিগত মুনাফা তৈরি নয়, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সকল সদস্যদের বৈষয়িক ও আত্মিক সক্তষ্টিকরণ। অর্থাৎ, সমাজতন্ত্রে উৎপাদন হচ্ছে ব্যবহারের জন্য। 

এমিল বার্ণসের মতে মার্কসবাদ হল – আমাদের এই জগৎ এবং তারই অংশ মানব সমাজ সম্পর্কে সাধারণ তত্ব। আবার লেনিনের মতে, মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি ও শিক্ষা সূচি হল মার্কসবাদ (Marxism is the system of the views and teachings of Marx)। 

মার্ক্সবাদী দার্শনিকগণ হলেন- কাল মার্কস, এঙ্গেলস, স্তালিন লেলিন, মাও-জে-দং।

মার্কসবাদী দর্শনের মূলনীতি 

1. দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ : মার্কসবাদের মূল বক্তব্য হল আমাদের এই জগত নিছকই এক বস্তুজগৎ। মন বা আত্মা বলে কিছুই নেই, বস্তুজগতই চরম বাস্তব। এই বস্তু জগতের প্রত্যেকটা উপাদান অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। মানুষ তার সংবেদন, প্রত্যক্ষণ, কল্পনা ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন বিষয়গুলি সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করে।

2. পরস্পর বিরােধী উপাদান : বস্তুজগৎ পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তন বাইরের কোন শক্তির প্রভাবে ঘটেনা। পরিবর্তনের বীজ বস্তুর মধ্যেই থাকে। প্রত্যেকটা বস্তুর মধ্যে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক এই পরস্পর বিরােধী উপাদান থাকে। 

3. উৎপাদন প্রক্রিয়া : উৎপাদন প্রক্রিয়াকে সচল রাখার জন্য দরকার হয় কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, নির্দিষ্ট জায়গা, বিভিন্ন প্রকার উপকরণে। মালিক শ্রেণীর মানুষদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং শ্রমিকদের শ্রমের ভিত্তিতে এই উপকরণ গুলিকে যথাযথ ব্যবহার করে মূলত উৎপাদন সম্ভব হয়ে থাকে।

4.শ্রেণী সংগ্রাম: উৎপাদন উপকরণের মধ্যে সম্পর্ক প্রধানত মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে স্থাপিত হয়। মালিকরা শ্রমিকদের বেশি পরিশ্রম করতে বাধ্য করে এবং বেশি মুনাফা লাভ করে, শ্রমিকদের মুনাফা থেকে বঞ্চিত করেন। ফলে পরস্পর বিরােধী একটি সম্পর্কের উদ্ভব হয়। এই পরস্পর বিরােধী সংঘর্ষকেই শ্রেণী সংগ্রাম বলে।

5. বিপ্লব ও শ্রেণীহীন সমাজ: সমাজের কোন কিছুই স্থায়ী নয়। তাই শােষক ও শােষিত সামাজিক ব্যবস্থাও বেশিদিন চলতে পারেনা। এই ব্যবস্থার পরিবর্তন করার জন্য বিপ্লবের প্রয়োজন বিপ্লবের ফলে শ্রেণী-সংগ্রামের অবসান ঘটবে। এক শ্রেণীহীন সমাজ সৃষ্টি হবে। শ্রেণীহীন সমাজে বিত্তবান এবং বিত্তহীন বলে কোন শ্রেণীবিভাগ থাকবে না। 

6) মানুষ ও সমাজের সম্পর্ক: প্রত্যেকটি ব্যাক্তিই সমাজের সম্পদ। সমাজের বুকে সকলেই নিরাপদে বসবাস করবে। সামাজিক সুযােগ-সুবিধা সবার জন্য, শুধু মাত্র কয়েকটি গােষ্ঠীর মধ্যে আবদ্ধ থাকবে না। মানুষের মধ্যে থাকবে শ্রেণি-চেতনা। জীবনের প্রধান লক্ষ্য হবে শ্রেণীহীন সমাজ সৃষ্টি করা।

শিক্ষায় মার্কসবাদী দর্শনের প্রভাব: বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় মার্কসবাদকে গ্রহণ করলে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামাের আমূল পরিবর্তন ঘটবে। শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, পাঠক্রম, শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ইত্যাদি সব কিছুর মধ্যে একটি পরিবর্তন সংঘটিত হবে।

শিক্ষার লক্ষ্য ও মার্কসবাদ : 

1) মাক্সবাদী দর্শন অনুযায়ী শিক্ষার লক্ষ্য হল শ্রেণীহীন, শােষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তােলা। সমাজে উচ্চ-নিচ ভেদাভেদ থাকবে না। এই সমাজের আদর্শ হবে সাম্য, নট মৈত্রী এবং স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা। গােষ্ঠী স্বার্থে পরিপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে গেলে বিপ্লবের প্রয়োজন। এই বিপ্লব করার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করাই হবে শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য। 

2) সকল প্রকার কাজই সম্মানজনক। সমাজের সবরকম কাজে শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তােলা এবং শ্রমিক মানে সমাজের বন্ধু এই বােধ জাগ্রত করাই হবে শিক্ষার লক্ষ্য।

3) সমাজের সমৃদ্ধি নির্ভর করে উৎপাদনের উপর। তাই শিক্ষার লক্ষ্য শুধুমাত্র তথ্য সংগ্রহ নয় প্রত্যেকটি ব্যাক্তি যাতে বিভিন্ন কাজে অংশ গ্রহণের দক্ষতা ও সামর্থ্য অর্জন সমর্থ হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে । 

4) শ্রেণীহীন সমাজ গঠনের জন্য শিক্ষাকে সর্বজনীন করতে হবে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য সাধারণ বিদ্যালয় (Common School) থাকবে। কোন বিশেষ শ্রেণী বা গােষ্ঠীর জন্য পৃথক কোন বিদ্যাল্য থাকবে না।  

শিক্ষার পাঠক্রম ও মার্কসবাদ : 

1) মার্ক্সবাদী দর্শন পাঠ শিক্ষা সর্বস্তরের জন্য আবশ্যিক। মার্কসবাদীরা মনে করতেন এই দর্শন পাঠের ফলে শ্রেণীগত বিভাজন, ধন-সম্পদের অসম বন্টন, শ্রমজীবীদের শােষণ ইত্যাদি সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা সচেতন হবে। 

2) সমাজের সামগ্রিক উন্নতির জন্য কারিগরি ও প্রযুক্তি বিদ্যার উপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তাই উচ্চমানের বিজ্ঞান সম্মত জ্ঞান আহরনের জন্য পাঠক্রমের মধ্যে অংকন, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন বিদ্যা, স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পায় ( skill development)।

3) প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা। কিন্তু মাধ্যমিক স্তরে বিদেশি ভাষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। 

4) সমাজের প্রয়ােজনীয় বিষয় গুলি বিজ্ঞান, গণিত, ভূগােল, জীব বিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূতত্ব ইত্যাদি বিষয়গুলাে পাঠক্রমের মধ্যে থাকবে। এছাড়াও এই পাঠক্রমে কমিউনিজমের ইতিহাস পাঠ আবশ্যিক করা হয়েছে। 

5) সহপাঠক্রমিক বিষয়গুলাের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। খেলাধুলা, শারীর শিক্ষা , সঙ্গীত, অংকন প্রভৃতি বিষ গুলিও পাঠক্রমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।  

শিক্ষা পদ্ধতি ও মার্কসবাদ: 

1) শিক্ষার তাত্বিক বিষয়ের ওপর গুরুত্ব না দিয়ে ব্যবহারিক জ্ঞানের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। 2) শিক্ষা শুধুমাত্র বিদ্যালয়ের চার দেওয়ালের মধ্যে জ্ঞান আহরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। শিক্ষার্থীরা কাজের মধ্য দিয়ে শিখবে (Learning by doing)।

3) শিক্ষার্থীদের কর্ম অভিজ্ঞতা বাড়ানাের জন্য শিক্ষক তাদের কৃষিক্ষেত্রে, কারখানায় নিয়ে গিয়ে হাতে কলমে কাজের মাধ্যমে বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ে সাহায্য করবেন। 

4) শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিযােগিতার মনােভাব দূর করে সহযােগিতামূলক মনােভাব সৃষ্টি করার নিয়ম মার্কসীয় শিক্ষার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। 

5) শিক্ষক শিক্ষার্থীদের যৌথভাবে বা সম্মিলিত ভাবে কাজ করার জন্য উৎসাহিত করবেন।

শিক্ষানীতি ও মার্কসবাদ:

মার্কসবাদী শিক্ষার কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ নীতি রয়েছে সেগুলি হল – 

1) শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে কোন রকম বৈষম্য থাকবে না। জাতি-ধর্ম-বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য শিক্ষার সমান অধিকার থাকবে। শিক্ষার্থীকে তাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণের সুযােগ দিতে হবে। 

2) শিক্ষা হবে সার্বজনীন ও বাধ্যতামূলক। 

3) বিদ্যালয় গুলির মধ্যে কোন পার্থক্য থাকবে না।  সকলে যাতে একই রকম শিক্ষার সুযােগ পায় তার জন্য বিদ্যালয় গুলিতে একই রকম পাঠক্রম চালু করতে হবে।

4) শিক্ষা সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। সমাজের প্রত্যেকটি মানুষকে শিক্ষিত করে তােলার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে  নিতে হবে। তাই শিক্ষার সম্পূর্ণ দায়িত্ব রাষ্ট্রের উপর থাকবে। 

5) বিদ্যালয় গুলিতে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে। তাই শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে কোন ধর্মীয় গােষ্ঠীর ভূমিকা থাকবে না। 

6) শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাজে অযথা হস্তক্ষেপ করবেন না। শিক্ষকের কাজ হবে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ প্রদান করা। IPL এবং তাদের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে সাহায্য করা।

মার্কসীয় শিক্ষাব্যবস্থায় সমাজে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকের সমান সুযােগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। নারী-পুরুষের শিক্ষার মধ্যে কোন বৈষম্য করা হয়নি। শিক্ষাকে উৎপাদনমুখী করার চেষ্টা করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে শ্রমের প্রতি মর্যাদাবােধ সৃষ্টির ব্যবস্থা করা হয়েছে। বঞ্চনা ও শােষণ সম্পর্কে ব্যক্তিকে সজাগ করার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকটা মানুষ যে সমাজেরই একটি অংশ এবং সমাজের প্রতি যে তাদের দায়িত্ব আছে সে সম্পর্কে তাদের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।

তাসত্বেও মার্কসীয় শিক্ষা দর্শনকে সর্বাঙ্গীণ সুন্দর ত্রুটিমুক্ত শিক্ষাদর্শন বলা যায় না। এ প্রসঙ্গে বার্ট্রান্ড রাসেল 461601 – ‘The education in capitalist countries suffer from domination of the rich, and the education in Russia suffers conversely from the domination of the proletariat. Children of proletarians are taught to despise the children of the bourgeois’. অর্থাৎ, ধনতান্ত্রিক দেশে যেমন শিক্ষাব্যবস্থা ধনীদের দ্বারা পরিচালিত হযে ত্রুটি যুক্ত হয়েছে তেমনি মার্কসবাদী কমিউনিস্ট রাশিয়ায় বিত্তিহীনদের দ্বারা শিক্ষা ব্যবস্থা চালিত হয়ে একইভাবে এই শিক্ষা ব্যবস্থা ক্রটি যুক্ত হয়েছে। ধনতান্ত্রিক দেশে দরিদ্র শিশুরা যেমন ঘৃণার পাত্র, সাম্যবাদী দেশগুলিতে ধ্বনি পিতা-মাতা শিশুরাও তেমনি অবহেলার পাত্র।

আরো পড়ুন

ভাববাদ (Idealism) কি | ভাববাদ সম্পর্কে দার্শনিকদের মতামত | ভাববাদ ও শিক্ষার লক্ষ্য, পাঠক্রম, পদ্ধতি

প্রয়ােগবাদ (Pragmatism) কি | প্রয়ােগবাদী দর্শনের মূলনীতি | শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োগবাদের প্রভাব

দর্শন কি | দর্শনের সংজ্ঞা দাও | দর্শনের স্বরূপ বা প্রকৃতি আলোচনা করো

যোগ দর্শন (Yoga Philosophy) | Indian Philosophy (ভারতীয় দর্শন)

সাংখ্য দর্শন (Sankhya Philosophy) | Indian Philosophy (ভারতীয় দর্শন)

Class 7 Bengali 3rd Unit Test Question Paper 2022 PDF

Leave a Comment

error: Content is protected !!