কোহলবার্গের নৈতিক বিকাশের তত্ত্ব | Kohlberg’s Moral Development Theory in Bengali

Q: কোহলবার্গের নৈতিক বিকাশের তত্ত্ব | Kohlberg’s Moral Development Theory in Bengali

উত্তর:

কোহলবার্গের নৈতিক বিকাশ :

ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণার্থে কাঙ্খিত অপ্রত্যাশিত আচরনাবলি অনুসরণ করাই হল নীতিবোধ এর পরিচয়। যেমন- শিক্ষক হিসেবে আমরা প্রত্যাশা করি ছাত্ররা সৎ, সত্যবাদী, দয়ালু, জ্ঞানী, ন্যায় পরায়ণ, সাহসী প্রভৃতি গুণাবলীর অধিকারী হবে। আমরা প্রত্যাশা করি সমস্ত ক্ষেত্রে ছাত্রদের আচরণে এসব গুণাবলী প্রতিফলিত হবে এটাই হলো নীতিবোধ। 

কোহলবার্গের নৈতিক বিকাশের তত্ত্ব (Kohlberg’s Moral Development Theory) :

কোহলবার্গ আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের জন্য শিশুদের নৈতিক বিকাশের উপর তার গবেষণা পত্র দাখিল করেন। তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার পর হার্বাট বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন, যেখানে তিনি সারা জীবন ধরে নৈতিক বিকাশের উপর গবেষণা করছিলেন। 

কোহলবার্গের নৈতিক বিকাশের পর্যায় (Stages of Moral Development) :

কোহলবার্গের নৈতিক বিকাশের তিনটি পর্যায় এর কথা উল্লেখ করেছেন-

1. প্রাক প্রথাগত পর্যায় (Pre-Conventional stage) 4 বছর থেকে 10 বছর :

এই পর্যায়ে শিশুদের নৈতিক আচরণ প্রধানত স্বার্থ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। শাস্তি এড়ানো এবং ব্যক্তিগত সন্তুষ্টি আনয়নের উদ্দেশ্যে শিশুরা নৈতিক আচরণ করে। এই পর্যায়ে জ্ঞানমূলক বিকাশ এমন পর্যায়ে পৌঁছায় না, যার দ্বারা শিশু নৈতিক ভালো-মন্দ বিচার করতে পারে। প্রাক-প্রথাগত পর্যায়ের দুটি স্তর দেখা যায়-

প্রথম স্তর : শাস্তি ও বাধ্যতা – স্বাস্থ্যের জন্য অন্যের বাধ্য হয় এবং নিয়ম নীতি অনুসরণ করে। কোনরকম নৈতিক বিচার দ্বারা প্রভাবিত হয় না।

দ্বিতীয় স্তর : ইচ্ছা মতো আচরণ – কেবলমাত্র স্বার্থ রক্ষার জন্য শিশুরা নিয়ম মেনে চলে। নির্দিষ্ট আচরণ করবে তা সে বিচার করে না। অর্থাৎ নীতি বিকাশে আত্মকেন্দ্রিকতা দেখা যায়। যেমন- তুমি আমার বই ছিঁড়েছ, আমি তোমার পুতুল ভাঙবো বা আমার সাইকেল ব্যবহার করলে তোমার বৈদ্যুতিক খেলনা আমাকে দিতে হবে ইত্যাদি।

2. প্রথাগত পর্যায় (Conventional stage) 10 থেকে 13 বছর : 

এই বয়সে বালক ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের নিকট থেকে সমর্থন প্রত্যাশা করে। তারা শুধু সমাজের নিয়ম-নীতি মেনে চলে তাই নয়, সমাজ নির্ধারিত আচরণের মানকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করে। এই পর্যায়ের ও দুটি স্তর আছে- 

তৃতীয় স্তর : এই বয়সের বালকেরা অপরের সমর্থন আকাঙ্ক্ষা করে। যেমন- ভালো ছেলে, ভালো মেয়ে ইত্যাদি শুনতে এরা চায়। আমরা তার আচরণ সম্পর্কে কি মনে করছি তার দ্বারা বালক নিজের আচরণ বিচার করে।

চতুর্থ স্তর : নিয়ম-নীতি প্রাধান্য পায়। আইন সমাজ ধর্ম নৈতিকতা আচরণকে নিয়ন্ত্রিত করে। এই বালকেরা আইন সংগত সমাজ-সমর্থিত আচরণ কর্তব্য এই বলে মনে করে।

3. উত্তম-প্রথাগত পর্যায় ( Post-Conventional Stage) 13 বছর এবং তার বেশি :

এই বয়সেই প্রকৃত নৈতিকতা দেখা দেয়। নীতিবোধ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে অন্যদের উপর নির্ভর করে না। সুসংগত বিবেকের উপরে সে আস্থা রাখে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ৷

পঞ্চম স্তর : নৈতিক বিকাশের এই স্তরের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল নীতি সংক্রান্ত কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যাক্তি যুক্তি আশ্রয় নেয়। আইন তার আচরণ কে নিয়ন্ত্রণ করে। সে জানে আইন সমগ্র সমাজ দ্বারা স্বীকৃত, তাই আইন কে সামনে রেখেই তার নৈতিক আচরণ প্রকাশ পায়।

ষষ্ঠ স্তর : এই স্তরে নৈতিক আচরণের ক্ষেত্রে ব্যক্তির বিবেক খুব সক্রিয় হয়। কোন আইন বা সামাজিক চুক্তি দ্বারা নয়। ব্যক্তির আচরণ নিয়ন্ত্রণ হয় তার বিবেকের দ্বারা। সকলের কল্যান হয় এমন আচরন সে করে এবং নিজের আচরণে তা প্রকাশ ঘটে। একেই সর্বজনীন নীতি বলে। কোহলবার্গের মতে, অনেকেই এই স্তরে পৌঁছতে পারেনা, কারণ এর জন্য প্রয়োজন উচ্চস্তরের বিমূর্ত চিন্তনের ক্ষমতা।

কোহলবার্গের নৈতিক বিকাশের প্রেক্ষিতে ব্যক্তিদের দুই ভাগে ভাগ করেছেন A টাইপ ও B টাইপ।

A টাইপের ব্যাক্তিদের নৈতিকতা নিয়ন্ত্রিত হয় কর্তৃত্ব এবং নিয়মের দ্বারা এবং B টাইপের ব্যাক্তিদের নৈতিকতা নির্ভর করে তাদের আদর্শ ও উন্নত বিকাশের দ্বারা। 

A টাইপের ব্যক্তির নীতিবোধের উপর আবেগ এর ভূমিকা অধিক অন্যদিকে B টাইপের ব্যক্তিদের নীতিবোধের উপর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভূমিকা বেশি।

সমালোচনা :

কোহলবার্গের নৈতিক বিকাশের তত্ত্ব সব শিশু এবং সব পরিস্থিতিতে সত্য কিনা সেই বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ শিশুদের নৈতিক বিকাশের পার্থক্যের ওপর পিতা-মাতার ভূমিকা প্রমাণিত হয়েছে। যেসব পিতা-মাতা শিশুদের কঠোর শাসনের মধ্যে রাখেন বা শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে শিশুর নৈতিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের থেকে উন্নত স্তরের হল যে সমস্ত পিতা মাতা শিশুদের সঙ্গে নৈতিক বিষয়ে আলোচনা করেন তাদের সন্তানদের নৈতিক পরিনমন। কোহলবার্গের নৈতিক বিকাশ সম্পর্কিত তত্ত বালকদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, কারণ তিনি বালকদের উপর পরীক্ষা করেন বালিকাদের তিনি বিবেচনা করেননি। অথচ দেখা গেছে যে, নৈতিক বিকাশে বালক-বালিকাদের মধ্যে পার্থক্য আছে।

আরো পড়ুন

ব্রুনারের শিখন তত্ত্ব | আবিষ্কার মূলক শিখনের শিক্ষাগত তাৎপর্য | Bruner’s Learning Theory in Bengali

পিয়াজেঁর জ্ঞানমূলক বিকাশের তত্ত্ব | Piaget’s Theory of Cognitive Development

এরিকসনের মনোসামাজিক বিকাশের তত্ত্ব | Eriksons psychosocial devlopment theory in Bengali

অধিবিদ্যা কি | এরিস্টটলের অধিবিদ্যা | দার্শনিক আলোচনায় অধিবিদ্যা | Metaphysics in Bengali

প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও পাঠক্রম সম্পর্কে কোঠারি কমিশনের সুপারিশ

শিক্ষার পরিধি গুলি আলোচনা করো

শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো

শিক্ষা কি | শিক্ষার ধরন | শিক্ষার বুৎপত্তিগত অর্থ | শিক্ষা সম্পর্কে শিক্ষাবিদ ও দার্শনিকদের অভিমত

Leave a Comment

error: Content is protected !!