ভাববাদ (Idealism) কি | ভাববাদ সম্পর্কে দার্শনিকদের মতামত | ভাববাদ ও শিক্ষার লক্ষ্য, পাঠক্রম, পদ্ধতি
অথবা, ভাববাদ (Idealism) কি ? ভাববাদ সম্পর্কে দার্শনিকদের মতামত লেখো ।
অথবা, ভাববাদ ও শিক্ষার লক্ষ্য, পাঠক্রম, পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করো
উত্তর:
ভাববাদ (Idealism)
দর্শন হল নতুন চিন্তাভাবনার উৎস। শিক্ষা ছাড়া দর্শন তার চিন্তাভাবনাকে কার্যকারী করতে অক্ষম। শিক্ষা দর্শনের ধ্যান-ধারণা ও উদ্দেশ্যকে পরীক্ষা করে বাস্তবে প্রয়োগ করে। তাই শিক্ষাকে দর্শনের গবেষণাগার বলা হয়। দর্শন শিক্ষার লক্ষ্য, শিক্ষার পদ্ধতি, পাঠক্রম, শিক্ষকের কর্তব্য ইত্যাদি নির্ণয়ের সাহায্য করে। প্রকৃতপক্ষে দর্শন শিক্ষার তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দুটি দিকেই প্রভাবিত করে। তাই দর্শন এবং শিক্ষা হল একে অপরের পরিপূরক। একটিকে বাদ দিয়ে অপরটিকে ভাবা যায় না। প্রাচীনকাল থেকেই শিক্ষার লক্ষ্য ও প্রকৃতি কি হবে তা নিয়ে বিভিন্ন দার্শনিকগণ বিভিন্ন চিন্তা ভাবনা করেছেন। বিভিন্ন দার্শনিকদের চিন্তাভাবনা পৃথক হওয়ায় তাদের মতবাদের ও পার্থক্য দেখা গেছে। শিক্ষা দর্শনের কতগুলি প্রচলিত মতবাদ হল –
• ভাববাদ (Idealism)
• প্রকৃতিবাদ (Naturalism)
• প্রয়োগবাদ (Pragmatism)
• মার্কসবাদ (Marxism)
ভাববাদ (Idealism) দার্শনিক মতবাদ গুলির মধ্যে ভাববাদ বা আদর্শবাদ হল প্রাচীনতম দার্শনিক মতবাদ। আদর্শবাদ বা ভাববাদের ইংরেজি প্রতিশব্দ হল Idealism। ইংরেজি Idea শব্দ থেকে Idealism কথাটির উৎপত্তি হয়েছে। ভাববাদী দার্শনিকরা মানুষ এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে এক ভাবমূলক সত্তার অংশ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তাদের মতে ভাব জগৎ বা আধ্যাত্মিক জগতের অধীশ্বর হলেন ঈশ্বর। মানবসত্তার লক্ষ্য হল এই ব্রহ্ম বা ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা। ব্রহ্ম বা ঈশ্বর যেমন চিরন্তন সত্য, তেমনি জীবনের মূল্যবােধ গুলিও চিরন্তন সত্য। ভাববাদী দার্শনিকগণ হলেন প্লেটো সক্রেটিস, ফিটকে, হেগেল, কান্ট, ফ্রয়েবেল, পেস্তালৎসী, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমূখ। ভাববাদী দার্শনিকরা মনে করেন মানুষ একটা আধ্যাত্মিক সত্তা নিয়ে জন্মায়, আর শিক্ষার মধ্য দিয়েই তার প্রকৃত আত্ম উপলব্ধি হয় ।
ভাববাদ সম্পর্কে বিভিন্ন দার্শনিকদের মতামত :
স্বামী বিবেকানন্দের মতে – মানুষের মধ্যে যে পূর্ণতা রয়েছে তার উন্মেষ সাধনই হয় শিক্ষা। (Education is the manifestation of perfection already in man)।
মনােবিদ Rusk এর মতে – মানুষের মধ্যেই কেবল ধর্মনীতি ও আধ্যাত্মিকতা দেখা যায়। কোন আন্তব অস্তিত্বের ব্যাখ্যা ভাববাদের স্থান পায়না। (Morality and religion are peculiar to man and differentiate him from animals।
সক্রেটিস বলেছেন – মানুষই সবকিছুর নির্ধারক ( Man is the measure of all things )।
হেগেলের মতে – ঈশ্বর ছাড়া জগত নেই। আর জগত ছাড়া ঈশ্বর নেই।
মনােবিদ রস বলেছেন – ভাববাদ ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য পাঠক্রমের একটি কাঠামাে ঠিক করছেন যা, যেকোনাে সম্পূর্ণ ও আদর্শ শিক্ষার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
ভাববাদের প্রধান সূত্র :
i. এই দৃশ্যমান জগতের বাইরে আরাে একটি জগত আছে তা হল আধ্যাত্মিক জগৎ। আধ্যাত্মিক জগৎ জড় জগৎ অপেক্ষা অধিকতর সত্য এবং বাস্তব। ভারতীয় দর্শনের মতে, আত্মাই সব, জড়বস্তু কিছুই নয়। আমাদের মন বা আত্মা এই জগতে সৃষ্টি করেছে।
ii. ব্যক্তির আত্মা ঈশ্বর বা পরমাত্মার অংশমাত্র। ব্যক্তি যখন এই পরমাত্মার সঙ্গে একাত্মতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় তখন তার মােক্ষ লাভ হয়।
iii. সত্য শিবম ও সুন্দরকে লাভ করাই হল মানব জীবনের চরম লক্ষ্য।
iv. নতুন করে কোন আদর্শই সৃষ্টি করা যায় না। পৃথিবীতে আগে থেকেই থাকে। মানুষ তার পুনরাবৃত্তি করে মাত্র।
v. নৈতিক ও কৃষ্টিগত বিষয় লাভই সর্বাপেক্ষা শ্রেয়।
vi. মানুষ তার নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সম্পর্কের দারা তার প্রাকৃতিক পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করবে।
ভাববাদ ও শিক্ষার লক্ষ্য :
ভাববাদ শিক্ষার তাত্ত্বিক ও প্রায়োগ উভয় দিকের উপর প্রভাব বিস্তার করে। ভাববাদী শিক্ষা দার্শনিকরা মনে করেন শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হল আত্ম উপলব্ধি (Self Realization) করা। শিক্ষা শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় মানুষের জন্য নয়। সমাজের প্রত্যেকটি মানুষকে শিক্ষা দিতে হবে, তবেই সমাজের উন্নতি হবে। ভাববাদী শিক্ষাদর্শন ব্যক্তির বিকাশের সাথে সাথে সমাজের কল্যাণের উপর সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। তাদের মতে শিক্ষার লক্ষ্য হবে এই চরম আদর্শকে (Absolute Ideal) লাভ করা। যে আদর্শ হল স্বয়ংসম্পূর্ণ ও নীতি সম্পন্ন। তাই ভাববাদীদের মতে শিক্ষার লক্ষ্য গুলি হল – ভাববাদ ও শিক্ষার লক্ষ্য : ভাববাদ শিক্ষার তাত্ত্বিক ও প্রায়োগ উভয় দিকের উপর প্রভাব বিস্তার করে। ভাববাদী শিক্ষা দার্শনিকরা মনে করেন শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হল আত্ম উপলব্ধি (Self Realization) করা। শিক্ষা শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় মানুষের জন্য নয়। সমাজের প্রত্যেকটি মানুষকে শিক্ষা দিতে হবে, তবেই সমাজের উন্নতি হবে। ভাববাদী শিক্ষাদর্শন ব্যক্তির বিকাশের সাথে সাথে সমাজের কল্যাণের উপর সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। তাদের মতে শিক্ষার লক্ষ্য হবে এই চরম আদর্শকে (Absolute Ideal) লাভ করা। যে আদর্শ হল স্বয়ংসম্পূর্ণ ও নীতি সম্পন্ন। তাই ভাববাদীদের মতে শিক্ষার লক্ষ্য গুলি হল –
i. আত্মপলব্ধি – শুদ্ধ জ্ঞান, ভক্তি ও কর্মের দ্বারা এই আত্মউপলব্ধি হয়ে থাকে।
ii. ব্যক্তিত্বের উন্নতি সাধন – মানুষের জীবন দুর্লভ ও মূল্যবান। এটি ঈশ্বরের সৃষ্টি। তাই ব্যক্তির আত্মবিকাশ সাধনই হল প্রধান কর্তব্য।
iii. সার্বজনীন শিক্ষা – প্রত্যেকটা মানুষই ঈশ্বরের সন্তান। তাই সমাজের প্রত্যেকটা মানুষের জন্য শিক্ষা চাই। তবেই সমাজের উন্নতি সম্ভব।
iv. নৈতিক বােধের উন্মেষ – নৈতিক বােধ আমাদের ভালাে-মন্দ বিচার করতে শেখায়। শিক্ষার মাধ্যমে শিশুর মধ্যে নৈতিক চেতনা সৃষ্টি করতে হবে। যাতে তারা খারাপ বিষয় ত্যাগ করে ভালােবিষয় গ্রহণ করতে পারে।
v. সৃজনশক্তির বিকাশ -কোন জীবই পরিবেশকে নিষ্ক্রিয় ভাবে গ্রহণ করেনা। মানুষ তার প্রয়ােজনে পরিবেশকে নিজের সৃজনীশক্তি দিয়ে পরিবর্তিত করতে পারে। তাই নতুন আবিষ্কার ও সৃজনীশক্তির বিকাশ হল শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য।
VI. কৃষ্টির উন্নতি – মানুষ উন্নত কৃষ্টির স্রষ্টা। কৃষ্টির উন্নতি সাধন শিক্ষার দ্বারাই সম্ভব।
ভাববাদ ও পাঠক্রম :
ভাববাদীরা মানুষকে সবকিছু কেন্দ্র বলে মনে করেন মানুষের ধর্মীয়, নৈতিক, বৌদ্ধিক ও নান্দনিক বিকাশ সাধনকেই শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য বলে মনে করেন। তাই তারা প্রাকৃতিক বিজ্ঞান অপেক্ষায় মানব সম্পর্কিত পাঠক্রমের উপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন । ভাববাদীদের মতে ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য পাঠক্রমের মধ্যে এই বিষয়গুলিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে –
i. বলিষ্ঠ দেহ ,মন গঠনের জন্য পাঠক্রমের মধ্যে থাকবে – শারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, ব্যায়াম ইত্যাদি।
ii. বৌদ্ধিক উন্নতির জন্য – সাহিত্য, বিজ্ঞান, অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগােল ইত্যাদি।
iii. নৈতিক ও ধর্মীয় উন্নতির জন্য – ধর্ম শাস্ত্র ও নীতিশাস্ত্র।
iv. নান্দনিক বােধের উন্মেষর জন্য – চারুকলা, কবিতা, সঙ্গীত, অঙ্কন প্রভৃতি।
ভাববাদ ও শিক্ষার পদ্ধতি :
বাংলা ভাববাদী শিক্ষার লক্ষ্য হল শিশুর মধ্যে যে সুপ্ত সম্ভাবনা থাকে শিক্ষার মাধ্যমে তার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন করা। শিক্ষক হবেন চরিত্রবান। শিক্ষার্থীরা তার গুরু কে অনুসরণ করে চলবে এবং গুরুর যত্ন ও পরামর্শে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটবে। ভাববাদীদের শিখনের পদ্ধতি গুলি ছিল – i. প্রশ্ন মূলক ii. আলােচনা মূলক iii. বক্তিতামূলক iv. অনুকরণ মূলক।
প্রাচীনকালে আশ্রম গুলােতে প্রশ্ন উত্তরের মাধ্যমে, আলােচনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করা হত। দার্শনিক প্লেটো, অ্যারিস্টোটল এই পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষা দিতেন। আবার আধুনিক ও প্রগতিশীল ভাববাদী শিক্ষক পেস্তালৎসী, ফ্রয়েবেল প্রভৃতি শিক্ষাবিদগণ শিশুর আত্ম সক্রিয়তার (Self Activity) ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তারা শিক্ষা পদ্ধতিকে মনস্তত্বের উপর ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। শিশুর স্বাভাবিক প্রবণতা খেলা করা। তাই তিনি থেলাভিত্তিক শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ফ্রয়েবেলের কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে শিশুদের খেলার মাধ্যমে শিক্ষার সুযােগ দেওয়া হয়েছিল।
ভাববাদ ও শৃঙ্খলা :
ভাববাদী দার্শনিকরা মনে করেন আত্মজ্ঞান লাভের জন্য কঠোর শৃঙ্খলার দরকার। কঠোর শৃঙ্খলা ছাড়া আত্মউপলব্ধি সম্ভব নয়। তবে ভাববাদী দার্শনিকরা শিশুদের মুক্ত স্বাধীনতার বিরােধী হলেও সম্পূর্ণ স্বাধীনতা হরণের পক্ষপাতি নন। তারা শিক্ষার্থীদের স্বনির্ভর-স্বাধীন চিন্তাশীল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষে পরিণত করতে চান। শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা তাদের শিক্ষার চরম লক্ষ্য। তবে জীবন গঠনের সময় কঠোরতার প্রয়ােজন। তাই তারা প্রয়ােজনবােধে শিক্ষার্থীর কল্যাণের জন্য শিক্ষকের হস্তক্ষেপ বাঞ্ছনীয় বলে মনে করেন।
ভাববাদ ও শিক্ষক :
শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষকের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। শিক্ষক হবেন আদর্শ পরায়ন, চরিত্রবান ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। শিক্ষার্থী শিক্ষকের জীবন অনুসরণ করে চলবে। শিক্ষকের পরামর্শ ও নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করলেই শিক্ষার্থীদের আত্মউপলব্ধি সহজ হবে ।
আরো পড়ুন
গঠনবাদ | শিখনের গঠনবাদ তত্ত্ব | ভিগটস্কির শিখন মতবাদ | Constructivism in Bengali
মার্কসবাদ কাকে বলে | মার্কসবাদের মূলনীতি আলোচনা কর
প্রয়ােগবাদ (Pragmatism) কি | প্রয়ােগবাদী দর্শনের মূলনীতি | শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োগবাদের প্রভাব
দর্শন কি | দর্শনের সংজ্ঞা দাও | দর্শনের স্বরূপ বা প্রকৃতি আলোচনা করো
যোগ দর্শন (Yoga Philosophy) | Indian Philosophy (ভারতীয় দর্শন)
সাংখ্য দর্শন (Sankhya Philosophy) | Indian Philosophy (ভারতীয় দর্শন)
Class 9 English 3rd Unit Test Question Paper 2022 PDF With Answers