শিক্ষা ক্ষেত্রে শ্রীরামপুর ত্রয়ীর অবদান | Contribution of Srirampur Trio in Education

শিক্ষা ক্ষেত্রে শ্রীরামপুর ত্রয়ীর অবদান | Contribution of Srirampur Trio in Education

উত্তর:

শিক্ষা ক্ষেত্রে শ্রীরামপুর ত্রয়ীর অবদান

মুঘল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই। ফলে রাষ্ট্রীয় ভাঙ্গন শুরু হয়। রাষ্ট্রীয় ভাঙ্গনের ফলে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ভাঙ্গন দেখা দেয়। দেশব্যাপী অরাজকতা দেখা দেয়। এই অরাজকতার সুযোগ নিয়ে ইউরোপীয় বণিকরা এদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়িয়ে তোলে। শিক্ষা ব্যবস্থাও তার পৃষ্ঠপোষকতা হারায়। 

শ্রীরামপুর ত্রয়ী
শ্রীরামপুর ত্রয়ী

ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে বণিকরা ভারতে এসেছিলেন ব্যবসা-বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে। ফলে ব্যবসা ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়ে যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অন্যান্য কোম্পানিদের হটিয়ে নিজেরাই একচেটিয় বাণিজ্যিক অধিকার লাভ করে। অন্যান্য বণিকদের মত খ্রিস্টান মিশনারীরা এদেশে এসেছিলেন তাদের ধর্ম প্রচারের জন্য। মিশনারিদের প্রচেষ্টায় ভারতে শুরু হয় প্রথম পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার। তাই ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনে খ্রিস্টান মিশনারীদের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

1800 খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে উইলিয়াম কেরি, উইলিয়াম ওয়ার্ড ও মার্শম্যান এই তিনজন মিশনারি একত্রে মিলিত হয়ে শিক্ষা ও ধর্ম প্রচারে নিযুক্ত হয়েছিলেন। এই তিনজনকে একত্রে ‘শ্রীরামপুর ত্রয়ী’ নামে অভিহিত করা হয়। কেরি ছিলেন ধর্ম প্রচারক, ওয়ার্ড ছিলেন দক্ষ মুদ্রণ শিল্পী এবং মার্শম্যান ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক।

এই তিন জনের চেষ্টায় খুব অল্প সময়ের মধ্যে শ্রীরামপুর মিশন নানা দিক থেকে উন্নতি লাভ করে। এই মিশন বাংলা শিক্ষা ও সংস্কৃতি জগতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে।

শ্রীরামপুর মিশন যদিও খ্রীষ্টান মিশনারিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ধর্ম প্রচার করা। কিন্তু অন্যান্য মিশনের কার্যাবলীর সঙ্গে এই মিশনের কার্যাবলীর যথেষ্ট পার্থক্য ছিল। ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে শ্রীরামপুর মিশন স্থাপন হলেও, এদেশীয় ভাষায় বাইবেল প্রচার করার জন্য তাঁরা বাংলা গদ্যের অনুশীলনে ব্রতী হন। কিন্তু তাদের কাজ ধর্ম প্রচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তাদের কাজের দ্বারা বাঙালির জীবনে নতুন চেতনার সঞ্চার হয়েছিল।

শিক্ষা বিস্তারের কাজে শ্রীরামপুর ত্রয়ীর ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কেরি এবং তার সহযোগীরা জনশিক্ষা প্রচারের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যালয় স্থাপন করেন। 1800 সালে শ্রীরামপুরে ইউরোপীয় ছেলেমেয়েদের জন্য দুটি আবাসিক বিদ্যালয় এবং স্থানীয় ছেলেমেয়েদের জন্য একটি অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়াও 1804 সালে কাটোয়া, দিনাজপুরে একটি করে এবং যশোরে চারটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

1817 সালের মধ্যে মিশনারিরা, হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান, ২৪ পরগনা, ঢাকা, যশোর, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, দিনাজপুর আজমির প্রভৃতি স্থানে বিদ্যালয় স্থাপন করেন। মিশনের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তৎকালীন বড়লাট হেসটিং রাজস্থানে একটি হিন্দি বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য বার্ষিক 6000 টাকা অনুদান মঞ্জুর করেন।

শ্রীরামপুর মিশন পরিচালিত বিদ্যালয় গুলিতে যে পাঠক্রম অনুসরণ করা হত তাতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের জ্ঞানের সংমিশ্রণ ঘটানো হয়। এই পাঠক্রমের মধ্যে ছিল দেশীয় ভাষা ও ব্যাকরণ, প্রাথমিক গণন ও গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোল, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, ইতিহাস, নীতি শিক্ষা প্রভৃতি।

শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা। এ প্রসঙ্গে মার্শম্যান বলেছিলেন “শিক্ষার্থীদের নিজের ভাষায় জ্ঞানের মাধ্যমে উন্নত করাই হবে শিক্ষার লক্ষ্য।”

শ্রীরামপুর মিশন উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব মেটানোর জন্য তাদের নিজেদের তত্ত্বাবধানে ১৮১৮ সালে একটি নর্মাল স্কুল স্থাপন করেন। যেখানে শিক্ষকতা করতে আসা প্রত্যেক শিক্ষককে এই নর্মাল স্কুলে প্রশিক্ষণ নিতে হত। যাতে পরবর্তীকালে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে শিক্ষাদান করতে পারে।

ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে শ্রীরামপুর মিশন ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে Calcutta Benevolent Institution স্থাপন করেন এবং তাদের চেষ্টায় শিরামপুরে একটি ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের জন্য ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর কলেজ স্থাপন করেন। এটি ছিল ভারতবর্ষের সর্বপ্রথম ইংরেজি মিশনারী কলেজ।

নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্য কেরি ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এছাড়াও তিনি অনাথ নারীদের জন্য অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন । শ্রীরামপুর মিশনের উদ্যোগে নারী শিক্ষার উদ্দেশ্যে ফিমেল জুডেলাইন সোসাইটি ও লেডিস অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময় শহরের বাইরে ও অনুন্নত অঞ্চলে নারী শিক্ষার প্রসারের জন্য ৩১ টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়।

আরো পড়ুন

শিক্ষণ কি | শিক্ষনের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য | What is Teaching | Nature and Characteristics of Teaching

শিখন ও পরিনমনের মধ্যে পার্থক্য ও সম্পর্ক কি | Difference and Relation between Learning and Maturation in Bengali

শিখনের গেস্টাল্ট তত্ব | শিক্ষাক্ষেত্রে গেস্টাল্ট তত্বের প্রয়ােগ | Gestalt Theory of Learning in Bengali

গঠনবাদ | শিখনের গঠনবাদ তত্ত্ব | ভিগটস্কির শিখন মতবাদ | Constructivism in Bengali

মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশনের বা মুদালিয়ার কমিশনের ত্রুটি গুলি কি কি

লর্ড কার্জনের শিক্ষানীতি | Lord Curzon-Educational Policy in Bengali

ব্যতিক্রমধর্মী শিশু | ব্যতিক্রমধর্মী শিশুর সংজ্ঞা ও শ্রেণিকরণ | বিশেষ শিক্ষা | Special Education in Bengali

Leave a Comment

error: Content is protected !!