Q: শিক্ষার উপাদান গুলি সম্পর্কে আলোচনা করো | Factors of Education in Bengali
Q: শিক্ষার উপাদান গুলি কি কি
Q: শিক্ষার উপাদান বলতে কী বোঝো
উত্তর:
শিক্ষার উপাদান (Factors of Education) :
আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার কয়েকটি প্রয়োজনীয় অঙ্গ বা উপাদান রয়েছে, এইগুলি হল : (ক) শিক্ষার্থী (Pupil), (খ) শিক্ষক (Teacher), (গ) পাঠ্যক্রম (Curriculum) এবং (ঘ) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (Educational institutions)। এই চারিটির সমন্বয়কে এককথায় শিক্ষার উপাদান বলা হয়। এই উপাদানগুলির পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শিশুর শিক্ষা হয়ে থাকে। এইগুলি পৃথকভাবে নীচে আলোচিত হল।
(ক) শিক্ষার্থী (Pupil) :
ইমারসান (Emerson) বলেছেন – শিক্ষার্থীকে শ্রদ্ধা করার মধ্যেই রয়েছে শিক্ষার রহস্য। এই শিক্ষার্থী দেহ-মন বিশিষ্ট একটি জৈবিক সত্তা। তার বুদ্ধি, প্রক্ষোভ, আগ্রহ, প্রবৃত্তি, চাহিদা এবং বিশেষ মানসিক ক্ষমতা রয়েছে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মধ্যে কতকগুলি সহজাত বৈশিষ্ট্য থাকে। কিন্তু সে তার পরিবেশের সঙ্গে ক্রমাগত প্রতিক্রিয়া করে নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য অর্জন করে থাকে।
তার পরিবেশ দু-ধরনের হতে পারে – প্রাকৃতিক এবং সামাজিক। ভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশে তার দৈহিক গঠন এবং জীবনযাত্রা প্রণালী বিভিন্ন হতে পারে। পরিবার, বিদ্যালয়, গ্রাম, শহর, ধর্মায়তন, সমাজ, সংঘ এইসব নিয়ে শিক্ষার্থীর সামাজিক পরিবেশ। এই পরিবেশ আবার সতত পরিবর্তনশীল। নিত্য পরিবর্তনশীল পরিবেশে শিক্ষার্থীকে সার্থক অভিযোজনে সমর্থ করে তোলাই শিক্ষার লক্ষ্য।
শিক্ষা শিক্ষার্থীর আচরণের মধ্যে বাঞ্ছিত পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে। মানুষের শৈশব অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়। পরিবার, বিদ্যায়তন, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্মায়তন, সংঘ – সমিতি প্রভৃতি শিক্ষার্থীর শিক্ষায় সহায়তা করে এবং এইগুলির সঙ্গে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তার জ্ঞান বৃদ্ধি হয়।
প্রাচীনকালে শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীর ভূমিকা ছিল গৌণ। শিক্ষকের ভুমিকা ছিল মুখ্য। শিক্ষার্থী অবনত মস্তকে শিক্ষকের জ্ঞানে নিজেকে পূর্ণ করত। শিক্ষক যা বলতেন তাই সে বার বার আবৃত্তি করে শিখত। তার সক্রিয় চিন্তা বা যুক্তির কোনো স্থান ছিল না। শিক্ষক ছিলেন দাতা, সে ছিল গ্রহীতা।
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থী হল কেন্দ্রবিন্দু। শিক্ষক তার মিত্র এবং পরামর্শদাতা মাত্র। শিক্ষার্থীর প্রবণতা, সামর্থ্য, আশা-আকাঙক্ষা, ক্লান্তি বিরক্তি ইত্যাদি মনস্তাত্বিক গুণাবলি বিচার করে শিক্ষক তাকে শিক্ষা দেবেন। তার ভিতর যেসব সহজাত ক্ষমতা ও বিশেষ সামর্থ্য আছে সেগুলিকে বিকশিত করে তোলাই হবে শিক্ষক এবং শিক্ষকের মূল লক্ষ্য। এই জন্য শিক্ষা হল একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া (bipolar process)। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং সহযোগিতার মধ্যে শিক্ষাদান সার্থক হয়ে উঠবে। তাই বর্তমান। শিক্ষাকে বলা যায় শিশুকেন্দ্রিক ( paedo centric)। শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিশু সক্রিয় হয়, তার মধ্যে দ্বিগু ও যুক্তি ক্ষমতার বিকাশ ঘটে। এই শিক্ষায় কোনোরূপ দমন পীড়ন শাক্তিদানের বিধি না থাকায় শিশু অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করে, এবং শিক্ষা তার কাছে প্রীতিপ্রদ ও আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে।
(খ) শিক্ষক (Teacher) :
শিক্ষাস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর হলেন শিক্ষক। শিক্ষক জাতিসংগঠক। তিনি ভবিষ্যতের নাগরিকদের স্রষ্ঠা। যদিও আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীর স্থান সর্বপ্রথম তবু শিক্ষকের মর্যাদা আজও কিছু কম নয়।
প্রাচীনকালে এই পুস্তক এত সুলভ ছিল না। তাই শিক্ষা ছিল প্রধানত গুরুমুখী। শিক্ষক ছিলেন জ্ঞানের স্বর্ণখনি। শিক্ষার্থী যত্ন ও অধ্যবসায়ের দ্বারা সেই জ্ঞানে স্বর্ণকণা সংগ্রহ করে নিত। শিক্ষক ছিলেন দাতা, শিক্ষার্থী ছিল নিষ্ক্রিয় গ্রহীতা মাত্র। শিক্ষক ছিল দ্বিমুখী প্রক্রিয়া (bipolar process)। শিক্ষক সারাজীবন অধ্যয়ন করতেন এবং তা শিক্ষণীয় বিষয়ে তিনি ছিলেন সুপণ্ডিত। সারাজীবন ধরে তিনি যে জ্ঞান সঞ্চয় করতেন, তাই বিদ্যার্থীদের মধ্যে অকাতরে বিলিয়ে দিতেন৷
আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় অবশ্য শিক্ষকের স্থানের কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। তিনি তার উচ্চ আসন ত্যাগ করে শিক্ষার্থীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তার বন্ধু ও পরামর্শদাতা হিসেবে। শিক্ষক – শিক্ষার্থীর মধ্যে দূরত্ব কমেছে। পারস্পরিক সম্পর্ক হয়েছে অনেক প্রীতিপ্রদ ও সন্ত্রাসমুক্ত।
আদর্শ শিক্ষকের গুণাবলি :
আদর্শ শিক্ষকের গুণাবলিকে মোটামুটি তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়—
(১) ব্যক্তিগত গুণাবলি : শিক্ষক সু-স্বাস্থ্যের অধিকারী হবেন। শিক্ষক বিকলাঙ্গ হলে শিক্ষণে সাহায্য লাভ করা কঠিন। তাঁর দৃষ্টি হবে তীক্ষ্ণ। শ্রেণির সকল ছাত্রের আচরণের প্রতি তিনি লক্ষ রাখবেন। তাই বাচনভঙ্গি ও কন্ঠস্বর ভালো হওয়া প্রয়োজন। তার উচ্চারণ সুস্পষ্ট হবে, জনপিপাসু হবেন। চিন্তায় ও আচরণে প্রগতিশীল হবেন। কোনো কুসংস্কার তার মধ্যে থাকবে না। তিনি সুবিবেচক হবেন। কোনো বিশেষ শিক্ষার্থীর প্রতি তার পক্ষপাতিত্ব থাকবে না। তার জীবনাদর্শ হবে খুব উন্নত।
(২) পেশাগত গুণাবলি : শিক্ষক হিসেবে তাঁর শিক্ষণীয় বিষয়গুলি সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান থাকা দরকার। আধুনিক প্রদীপন ব্যবহারের কৌশল শিক্ষককে জানতে হবে। এ ছাড়া আধুনিক মূল্যায়ন পদ্ধতি সম্পর্কেও তার জ্ঞান থাকা দরকার। তিনি সহ-পাঠ্যক্রমিক কাজগুলি পরিচালনার নিয়ম – নীতিগুলি জানবেন। আবার মনস্তত্বের জ্ঞান না থাকলে উপযুক্ত শিক্ষক হওয়া যায় না। তাই সাধারণ মনোবিজ্ঞান, শিশু – মনোবিদ্যা ও সামাজিক মনোবিদ্যার জ্ঞান থাকা শিক্ষকের একান্ত প্রয়োজন।
(৩) নাগরিকের গুণাবলি : শিক্ষা হল সামাজিক প্রক্রিয়া। সুতরাং শিক্ষকের মধ্যে সামাজিকতার সকল গুণ থাকা দরকার। তিনি সমাজের কৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন। নাগরিকের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হবেন। জাতীয় সংহতি রক্ষায় তিনি সর্বদা সচেষ্ট হবেন। তার পক্ষে গভীর জাতীয়তাবোধ থাকলেও আন্তর্জাতিকতা বোধের কখনোই অভাব হবে না।
শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্য :
সমাজে শিক্ষকের একটি বিশিষ্ট স্থান রয়েছে। সুতরাং তার কাজ বিদ্যালয়ের চার দেয়ালের মধ্যে শুধু সীমাবদ্ধ হতে পারে না। তিনি শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জনে সাহায্য করবেন, তাকে শিক্ষামূলক নির্দেশনা দেবেন, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিকল্পনা রচনা করবেন, শিক্ষার্থীর জীবনাদর্শ গঠনে সাহায্য করবেন এবং তার পুরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করবেন। এ ছাড়া তিনি শিক্ষার্থীকে সমাজের রীতি, নীতি ও কৃষ্টির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন। অর্থাৎ, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকের দায়িত্ব অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
(গ) পাঠ্যক্রম (Curriculum) :
পাঠ্যক্রম হল শিক্ষার আর একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। সাধারণ অর্থে পাঠ্যক্রম বলতে আমরা বুঝি শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেসব বিষয়গুলি পড়ানো হয় তার সমষ্টিকে (course of study)। এই পাঠ্যক্রম সাফল্যের সঙ্গে অনুশীলন করে শিক্ষার্থী পরীক্ষায় কৃতকার্য হলে আমরা মনে করি শিক্ষার লক্ষ্য পূর্ণ হল। কিন্তু শিক্ষার ধারণা আধুনিককালে সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হবার ফলে পাঠ্যক্রমের ধারণাও বদলে গেছে। এখন আর পাঠ্যক্রমকে ইতিহাস, ভূগোল, গণিত প্রভৃতি বিষয়ের তালিকা বলে মনে করা হয় না। প্রকৃতপক্ষে পাঠ্যক্রম হল শিক্ষার্থীর আশা – আকাঙ্ক্ষা এবং সমাজের চাহিদার এক সমন্বিত রূপ। পাঠ্যক্রম শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব বিকাশে সাহায্য করবে শুধু তাই নয়, এর মধ্যে সমাজ কৃষ্টির এবং সমাজের আশা – আকাঙক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। তাই আধুনিক পাঠ্যক্রমে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব বিকাশের কর্মসূচির সঙ্গে সামাজিক প্রয়োজনীয় উৎপাদনাত্মক কাজ, সমাজসেবা প্রকল্প প্রভৃতি পাঠ্যক্রমের বিশেষ অঙ্গ হয়েছে।
(ঘ) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (Educational Institution) :
শিক্ষার যথোপযুক্ত পরিবেশের অভাবে, শিক্ষার তিনটি উপাদান – শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং উপযুক্ত পাঠ্যক্রম থাকা সত্ত্বেও, শিক্ষাকার্য সুসম্পন্ন হতে পারে না। বিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ যদি সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর না হয়, যদি বিদ্যালয়টি একটি কারখানার পাশে স্থাপিত হয়, তবে শিক্ষার্থীর পাঠ্যাভাসে বিঘ্ন ঘটে। শিক্ষকের পক্ষেও পাঠদান সম্ভব হয় না ।
তা ছাড়া শিশুর শিক্ষা শুধু বিদ্যালয়েই সীমাবদ্ধ নয়। সে পরিবার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র, সমিতি প্রভৃতির কাছ থেকেও নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এ ছাড়া সংবাদপত্র, বেতার, টেলিভিশন, প্রদর্শনী, সিনেমা, যাত্রা, থিয়েটার প্রভৃতিও তার জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে। এইসমস্ত মাধ্যমগুলিই শিক্ষার উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়।
(ঙ) শিক্ষার উপাদানগুলির পারস্পরিক সম্বন্ধ (Interelation between Factors of Educatios) :
উপরে শিক্ষার উপাদানগুলি পরস্পর-পরস্পরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। একটিকে বাদ দিয়ে অপরটি সার্থক হয় না। তা ছাড়া শিক্ষার উপাদানগুলির কোনোটাই স্থায়ী নয়। শিক্ষক, পাঠ্যক্রম, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ নিয়ত পরিবর্তনশীল। একটির পরিবর্তন হলে অপরটিরও পরিবর্তন করা প্রয়োজন হয়। নীচে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, পাঠ্যক্রম ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক আলোচিত হল ।
১) শিক্ষার্থী – শিক্ষকের সম্পর্ক : শিক্ষার উপাদানগুলির মধ্যে শিক্ষার্থীর স্থান প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকের সংস্পর্শে আসার ফলে শিক্ষার্থী তাঁর অভিজ্ঞতা ও জীবনাদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয়। আবার, শিক্ষক শিক্ষার্থীকে পরামর্শ ও পরিচালনা করতে গিয়ে নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। শিক্ষার্থী যখন পাঠ অনুশীলন করতে গিয়ে নানা প্রশ্ন করে, শিক্ষককে তার উত্তর দিতে হলে বিষয়টি সম্পর্কে আরও গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে হয়। ফলে তার নিজের জ্ঞান বৃদ্ধি হয়। আবার, শিক্ষার্থী যদি শিক্ষকের সঙ্গে সহযোগিতা না করে, তবে তার ব্যক্তিত্ব বিকাশের সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। সুতরাং শিক্ষক – শিক্ষার্থীর পারস্পরিক ক্রিয়া – প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়েই কেবল শিক্ষাপ্রক্রিয়া গতিশীল হতে পারে।
২) শিক্ষার্থী – পাঠ্যক্রমের সম্পর্ক : গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীর আশা – আকাঙক্ষা, চাহিদাকে ভিত্তি করে পাঠ্যক্রম রচিত হয় না। তাত্ত্বিক কতকগুলি জ্ঞান, শিক্ষার্থীর প্রয়োজনে আসুক বা না আসুক তার উপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে শিক্ষার পাঠ্যক্রম যথাসম্ভব শিক্ষার্থীর জীবনোপযোগী করে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত আগ্রহ, প্রবণতা ও চাহিদাকে ভিত্তি করেই আধুনিক পাঠ্যক্রম রচিত হয়ে থাকে। সুতরাং পাঠ্যক্রম যেমন একদিকে শিক্ষার্থীর পঠন পাঠন কাজকে প্রভাবিত করে তেমনি অন্যদিকে শিক্ষার্থীর চাহিদাও পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তু সংশোধন ও পরিবর্তন করে থাকে।
৩) শিক্ষক ও পাঠ্যক্রমের সম্পর্ক : শিক্ষক তার যুক্তি ও অভিজ্ঞতার সাহায্যে একটি পাঠ্যক্রম প্রস্তুত করেন। পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তু যদি শিক্ষার্থীর উপযোগী ও আকর্ষণীয় হয় তবেই পাঠ্যক্রমটি অনুসরণ করা শিক্ষকের পক্ষে অসুবিধা হয় না। কিন্তু পাঠ্যক্রমটি যদি এমন হয় যে তা বর্তমান বিদ্যালয় পরিবেশে সার্থক করে তোলা সম্ভব নয়, তখন শিক্ষক তার পরিবর্তন করতে বাধ্য হন। সুতরাং এখানেও শিক্ষক ও পাঠ্যক্রমের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান।
৪) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অন্য উপাদানের সম্পর্ক :
ভালো শিক্ষার পরিবেশ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাঠ্যক্রমের সুষ্ঠু পরিচালনা শিক্ষার্থীর সামাজিক জীবনবিকাশ ও শিক্ষকের পাঠদানকে সাফল্যমণ্ডিত করতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ যদি শিক্ষার অনুকুল না হয় তবে সুশিক্ষকের প্রয়াস, শিক্ষার্থীর আগ্রহ, অধ্যবসায় অথবা ভালো পাঠ্যক্রম কাজে লাগে না। বিদ্যালয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে যদি ভালো পাঠাগার, পরীক্ষনাগার, শিক্ষাপকরণ, উপযুক্ত পাঠ্যক্রম, আদর্শপরায়ণ ছাত্রপ্রেমী শিক্ষকবৃন্দ এবং শিক্ষাগ্রহণে আগ্রহী ছাত্রছাত্রী থাকে তবেই সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষা সার্থক হতে পারে। সুতরাং এ কথা বলা যায় যে, শিক্ষার বিভিন্ন উপাদানগুলি পারস্পরিক ক্রিয়া – প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত।
(চ) শিক্ষার উপাদান ও শিক্ষার লক্ষ্য :
১) আধ্যাত্মিক ও নৈতিক লক্ষ্য : শিক্ষার লক্ষ্য যাই হোক না কেন তার কার্যকারিতা শিক্ষার বিভিন্ন উপাদানের উপর নির্ভর করে। শিক্ষার লক্ষ্য যদি প্ৰধানত আধ্যাত্মিক ও নৈতিক হয়, তবে শিক্ষায়তনের পরিবেশে তার প্রতিফলন দরকার। বিদ্যালয়ে নিয়মিত প্রার্থনা সভা, মহাপুরুষদের বাণী পাঠ, তাঁদের চরিত্রের অনুধ্যান, আধ্যাত্মিক আলোচনা ইত্যাদি পাঠ্যক্রমের অঙ্গ হবে। শিক্ষক নিজে আদর্শপরায়ণ ও নীতিবান হবেন এবং শিক্ষার্থীদের চরিত্র গঠনে সাহায্য করবেন।
২) বৃত্তিমুখী লক্ষ্য : শিক্ষার লক্ষ্য যদি বৃত্তিমুখী হয় তবে পাঠ্যক্রমে তার ব্যবস্থা থাকবে। বৃত্তি সম্পর্কে উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিযুক্ত হবেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সমন্বিত কর্মশালার ব্যবস্থা থাকবে। শিক্ষার্থীদেরও শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
৩) সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য : আবার শিক্ষার লক্ষ্য যদি সমাজতান্ত্রিক হয় তবে শিক্ষার্থীদের সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতিগুলি সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। বিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসনের (self govt) মধ্য দিয়ে তারা সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ হবে। সামাজিক কৃষ্টির সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটিয়ে দিতে হবে। নাগরিকত্ব বোধ যাতে তাদের বৃদ্ধি পায় সেই অনুযায়ী পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তুও নির্ধারিত হবে।
৪) বলিষ্ঠ দেহ গঠন : শিক্ষার লক্ষ্য যদি বলিষ্ঠ দেহ (sound body) গঠন করা হয় তবে শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত শারীর – শিক্ষকের মাধ্যমে খেলাধুলা, ড্রিল, প্যারেড, জিমনাস্টিকস ইত্যাদি শিক্ষা দিতে হবে। শিক্ষার পাঠ্যক্রমও সেইভাবে নির্ধারিত হবে। মোটকথা, শিক্ষার বহুমুখী লক্ষ্যের সঙ্গে শিক্ষার পরিবেশ, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও পাঠ্যক্রমের সমতা থাকা দরকার। শিক্ষার উপাদানগুলির মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া – প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষাপ্রক্রিয়া গতিশীল হয় এবং শিক্ষার লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়।
আরো পড়ুন
প্রকৃতিবাদ কাকে বলে | শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকৃতিবাদী দর্শনের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করো
সনদ আইন (1813) | সনদ আইনের উদ্দেশ্য | সনদ আইনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
শিক্ষা মনােবিজ্ঞানের প্রকৃতি আলোচনা করো | Nature of Educational Psychology in Bengali